বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভয়ঙ্কর এন্টিবায়োটিক দূষণে নদনদী

| প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

মানব বর্জ্য এবং এন্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের স্বাস্থ্যবিদরা এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের নানাবিধ কুফল ও সমূহ আশঙ্কার কথা বলছেন। এখন আন্তর্জাতিক গবেষণায় বিশ্বব্যাপী এন্টিবায়োটিক দূষণের একটি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের নদনদীর পানিতে কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০০গুণের বেশী এন্টিবায়োটিক দূষণের মাত্রা ধরা পড়েছে। অনলাইন ভ্যানগার্ডে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত পরি্েবশগত দূষণ বা বিষক্রিয়া সংক্রান্ত একটি গবেষণা জরিপে বিশ্বের ৭২টি দেশের নদনদী থেকে সংগৃহিত ৭১১টি নমুনার দুইতৃতীয়াংশেই উদ্বেগজনক মাত্রার এন্টিবায়োটিক দূষণ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার দূষণ কবলিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া ও পাকিস্তানের নদনদী থেকে সংগৃহিত পানির নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক দূষণ ধরা পড়েছে। পরিবেশগত দূষণ এবং সুপেয় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোতে এন্টিবায়োটিকসহ নানাবিধ জৈব পদার্থ ও ভারী রাসায়নিক বর্জ্যরে দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। শিল্প কারখানা এবং মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নদনদীর দূষণ রোধে আমাদের নগর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হচ্ছে। 


নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর পানিতে ৩০০ গুণের বেশী মাত্রার এন্টিবায়োটিক দূষণের চিত্র দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত। হঠাৎ করেই দেশের নদ নদীগুলো এমন অবস্থায় উপনীত হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের দখলবাজি, শিল্প ও মানববর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার অপরিনামদর্শিতার কারণে বিশেষত ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব রকম উপযোগিতা হারিয়েছে। নদীগুলোর দূষণের মাত্রা এতই বেশী যে, এগুলোর পানি এখন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পরিশোধন করেও সুপেয় করা যাচ্ছে না। নদনদী ও পরিবেশে রাসায়নিক বর্জ্য ও এন্টিবায়োটিক দূষণের প্রভাব এখন আমাদের খাবার পানি ও খাদ্যবস্তুতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে ঢাকায় বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহকৃত খাবার পানি এবং প্যাকেটজাত তরল দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে সিসাসহ বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক এবং এন্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ধরা পড়েছে। টেট্টাসাইক্লিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, মেট্টোনিডাজলের মত এন্টিবায়োটিক, রাসায়নিক ও মানববর্জ্য, মাটিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, পোল্ট্রি ও পশুখাদ্যে ও পরিচর্যায় হরমোন- এন্টিবায়োটিকের নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের মাশুল দিচ্ছি আমরা। অনতিবিলম্বে এন্টিবায়োটিক ও রাসায়নিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নদনদীর পানি, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও কৃষি ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ও ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবায় যত্রতত্র এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে নানাবিধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, রাজধানী শহরের নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার হলেও এ থেকে উত্তরণের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উদ্যোগ থাকলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতীরের দখলবাজি উচ্ছেদে জোর দেয়া হলেও বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা ছাড়াই শত শত কলকারখানা চালু থাকায় নদনদীর পানি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে হাজারিবাগের টেনারিশিল্প পুরাণ ঢাকা থেকে থেকে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সেখানেও টেনারিবর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে ধলেশ্বরী নদী এখন বুড়িগঙ্গার ভাগ্য বরণ করতে চলেছে বলে জানা গেছে। অথচ সিইটিপি বা কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত টেনারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক সুবিধা নিশ্চিত করেই সাভারে টেনারিশিল্প স্থানান্তরের কথা ছিল। সে প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে নদনদীগুলোর পানি প্রবাহ ও নাব্য বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ড্রেজিং ও সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি প্রবাহবৃদ্ধি এবং দূষণের উৎসগুলোতে আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে পানিদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা অসম্ভব নয়। বৃটেনের টেম্সনদীসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি নদী এক সময় ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছিল। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কলকারখানায় বাধ্যতামূলক পরিশোধন ব্যবস্থা এবং নাগরিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে দূষণরোধ করে তারা পানির মান ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। একইভাবে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ বিপণন ও অপব্যবহার রোধেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নদনদী, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবেলায় ব্যর্থতা জিইয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন কেবল নয়, কোনো উন্নয়নই অর্থবহ করা সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন