হেলেনা জাহাঙ্গীর : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের অর্থনীতিও নদীনির্ভর। উপনদী-শাখা নদী-খাল-বিলে ঘেরা এদেশের জমির উর্বরা শক্তির মূলেও রয়েছে নদী। বাংলাদেশে ছোট-বড় যে তিন শতাধিক নদী আছে সেগুলো আজ বিপন্ন এবং এ বিপন্নতার মূলে রয়েছে নদী দখল করে দখলদারদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, উপনগরী গড়ে তোলার ব্যবসা। ভরাটের কারণে পানি প্রবাহ কমে গেছে ও ক্রমেই কমছে। স্রোতস্বিনী নদীগুলোতে জেগে উঠছে ছোট-বড় অনেক চর। নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে নদীখেকোদের কারণে পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এবং ইতিমধ্যে দেশের ছোট-বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৭৫টি নদীই মৃতপ্রায়। তাছাড়া প্রতি বছরই দু-একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে হাওর-বিলেও। এর ফলে বর্ষার সময়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে ভাঙনের মাত্রা বাড়ছে। মানুষ পিতৃ-পুরুষের ভিটেমাটি, জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। কেবল তা নয়, নদী দখলের প্রভাব প্রাণীকুলেও পড়ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ।
নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ নদনদী ও মিঠা পানির প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ১৮ প্রজাতির প্রাণী। আরও আতঙ্কের বিষয় যে সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ ধ্বংসের মুখে এবং অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী, বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। এভাবে নদী দখলদারদের দৌরাত্ম্যে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে ও পড়ছে।
নাব্য সংকটে ভুগছে দেশের বেশিরভাগ নদনদী। শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদীতেই পর্যাপ্ত পানি নেই। নদীতে পানি না থাকায় চাষাবাদে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে এমনটিও আশঙ্কা করা হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে। বিশেষত আসন্ন সেচ মৌসুমে তিস্তা উপত্যকার কৃষকদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে পানি সংকট। শুষ্ক মৌসুমে নদনদীতে পানির প্রবাহ অন্য সময়ের চেয়ে কম থাকে এবং এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের নদনদীতে পানির অভাব দেখা দিচ্ছে নানা কারণে। ভাটির দেশ বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদনদী উজান থেকে আসা অভিন্ন নদনদীর পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। ভারতে বাঁধ নির্মাণ ও জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য বিভিন্ন নদনদীতে পানি প্রবাহের গতি ব্যাহত হচ্ছে। উজানে পানি প্রত্যাহার ভাটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের নদনদীর ধারণক্ষমতা প্রতিনিয়তই কমছে। নদীতে পলি পড়ে পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। পানির অভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতেও চলছে পানি সংকট। উজান থেকে আসা পানির চাপ হ্রাস পাওয়ায় দেশের উপকূল ভাগের নদনদীতে লোনা পানির আগ্রাসন অনুভূত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় চাষাবাদের পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।
সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের নদনদীর পানি সংকটের পেছনে উজানে পানি প্রত্যাহার অনেকাংশে দায়ী। তবে এটিকে সংকটের একমাত্র কারণ বলার অবকাশ নেই। দেশের নদনদীর সুরক্ষায় নিজেদের ব্যর্থতার দায়ও কম নয়। দেশের নদনদীর স্বাভাবিক অবস্থা নিশ্চিত করতে উজানে পানি প্রত্যাহারের প্রবণতা রোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার বাড়াতে হবে। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে দুই দেশের গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা নেয়ার কথা ভাবতে হবে। একই সঙ্গে নদনদীর নাব্যতা রক্ষায় নিতে হবে বহুমুখী উদ্যোগ। নদনদীগুলো দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কৃষিনির্ভর দেশের চাষাবাদের স্বার্থে নদনদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রেও যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের বেশ কিছু নদী অস্বাভাবিক রকম প্রশস্ত। সে তুলনায় নদীর গভীরতা কম। এ কারণে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো বিশাল নদীতেও নাব্য সংকট দেখা দেয়। এসব নদীর কোথাও কোথাও প্রশস্ততা ২০-২২ কিলোমিটার হলেও গভীরতা ৮-৯ ফুট। শুষ্ক মৌসুমে নাব্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম হওয়া সত্ত্বেও নাব্য না থাকায় নৌপরিবহনের আওতা ক্রমান্বয়ে কমছে। এ সমস্যার সমাধানে বড় নদীগুলোর তীর ভরাট করে নগরায়ন ও শিল্পায়নের উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি নদীগুলোর গভীরতা বৃদ্ধির কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। নদীর পাড় টেকসইভাবে বাঁধানো এবং নদীকে দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব হলে এ মহাপরিকল্পনা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীশাসন সম্ভব হলে বন্যা ও নদীভাঙনের হাত থেকে অনেকাংশে যেমন রক্ষা পাওয়া যাবে তেমন নদীর পানি ধারণক্ষমতা পাবে।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন