মুরশাদ সুবহানী : ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের হাতে আছে পানি অস্ত্র। ভারত খুব সহসা এই অস্ত্র হাতছাড়া করবে- এটা বলা যায় না। বন্ধু মাঝে মধ্যে কথা না শুনলে এই অস্ত্র কাজে লাগছে এবং লাগবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ভারত শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। খাবার দিয়েছে। স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে। পাকিস্তান-ভারতের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি সহযোগিতা করেছে। এসবই ইতিহাসে নিরেট সত্যি। দেশের মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর, আনসার এবং দেশের সাধারণ মানুষের সাথে ভারতীয় বাহিনীও প্রাণ দিয়েছে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে। এসব কিছুই আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণে রেখেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারও ভারত সফরে গিয়ে সে কথা উল্লেখ করেছেন। তার আশা ছিল তিস্তার পানি চুক্তি হবে। কিন্তু হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এলে তাকে কি কি উপহার দেয়া হয়েছিল, সেটি বলেছেন। তবে রাজনীতির কৌশলে বলেছেন, বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাক সেটা তিনিও চান। তবে তিস্তা বেসিনে পানি নেই। তিনি ভার্চুয়াল নদী তোর্সা, ধরলা থেকে পানি নেয়ার কথা বলেছেন। আসলে পানি চুক্তির ব্যাপারে ‘দিল্লী অনেক দুরাস্ত’ পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।
ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পানি নিয়ে বক্তব্যের ক্ষেত্রে সেই দেশের পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে ‘তিস্তায় মমতার নয়া মোচড় ভারত-বাংলা সম্পর্ককে ঘোলা পানিতে ফেলে দিয়েছে। নিরাপত্তার মতো বিভিন্ন খাতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাথে যে সম্পর্ক উন্নত হচ্ছিল, তিস্তা সই না করার কারণে তার গতি ধরে রাখা শেখ হাসিনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আনন্দবাজার বলেছে, তিস্তা ভরবে না তোর্সার জলে, আশাহত ঢাকা।’
তোর্সা ও ধরলা নদী দেখিয়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসলেই তিস্তা চুক্তিকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে বলা হয়েছে, তোর্সা ও ধরলা নদী থেকে পানি নেয়া গেলেও তা হবে কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ ড. কল্যাণ রুদ্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা নদীর জলের ক্ষেত্রে বিকল্প প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেছেন, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে তোর্সা বা ধরলার মতো নদীগুলো থেকে খাল কেটে বাড়তি পানি তিস্তার দিকে নিতে হবে। এটা মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে ততটাই কঠিন। তার মতে, ডুয়ার্সের গহিন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এ খাল কাটতে হবে। এতে পরিবেশ ও ইকোলজির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাছাড়া বর্ষায় এ নদীগুলো সব ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তাই সে সময় এ পশ্চিমমুখী খাল চালু রাখতে গেলে ভায়াডাক্ট বা অ্যাকোয়াডাক্ট তৈরী করতে হবে। প্রযুক্তির দিক থেকে এ ধরনের খাল কাটা সম্ভব কিন্তু কাজটা খুব কঠিন।
ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই নদীর কথা বলে আসলেই তিস্তার পানি চুক্তিকে কৃষ্ণ গহŸরে ফেলে দিয়েছেন। তিনি তার রাজ্যের স্বার্থ দেখছেন। সেটাই স্বাভাবিক। আর পানি অস্ত্র এত তাড়াতাড়ি হাতছাড়া করা হবে কিনা সেটা নিয়েও রাজনৈতিক চিন্তা তাদের আছে। দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী মিট দ্য প্রেসে খোলামেলাভাবেই কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন, দিদিমণি এখনই তিস্তা চুক্তি করতে চাননি। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে আশ্বাস দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত সফর নিয়ে হতাশ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। তিনি বিএনপি নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, শেখ হাসিনা দেশ বেচে না, দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে জানে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে জানে। উন্নয়ন করতে জানে। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে- এ কথা কখনও ভুলবেন না। আমার হাতে দেশ বিক্রি হবে না। যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে, তারাই নিজেদের স্বার্থের জন্যে দেশ বিক্রি করে। তিনি আরো অনেক কথা বলেছেন, তার মধ্যে প্রণিধানযোগ্য কথা হলো- পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না। আমরা ভাটিতে আছি। আমাদের কাছে পানি আসবেই। তিনি নদী ড্রেজিং করে নদীর গভীরত্ব বাড়ানোর কথা বলেছেন। অত্যন্ত কাজের কথা এটি। নদীর গভীরত্ব থাকলে বর্ষাকালে ভারতকে গঙ্গার পানি আর তিস্তা বেসিনসহ অন্যান্য নদীর পানি ছাড়তেই হবে। সেই পানি আমাদের দেশের নদী ধারণ করতে পারলে শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত থাকবে।
আইয়ূব শাহীর পতন হয়েছে। তিনি রিজাভেশন ট্যাংক করার পরিকল্পনা নিয়ে ছিলেন।
মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খাল খনন কর্মসূচি হাতে নেন। তিনি গঙ্গার অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারে ভারতের একমুখীনীতি নিয়ে জাতিসংঘে কথা তোলেন। পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও এসব নিয়ে বাস্তবে কেউ মাথা ঘামায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে গঙ্গার পানি বণ্টনে ৩০ সালা মেয়াদি চুক্তি করতে সমর্থ হন। এটি তাঁর সফলতা। তবে ভারত পানি চুক্তি করার পরও চুক্তি মাফিক পানি এ পর্যন্ত দেয়নি। এই পানি অস্ত্র বারবার কাজে লাগানোর চেষ্টাই বরং করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা। জেনেটিক থিওরি বলে, পিতার অনেক গুণ বড় সন্তানের দেহে প্রবাহিত হয়।
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বড় নৌকা মঞ্চ নির্মিত হয়। এই মঞ্চে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে আসেন ভারতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বলেন, এ দেশ থেকে মিত্র বাহিনী (ভারতীয় সেনাবাহিনী) কবে যাবে। এরপর পরই মিত্র বাহিনীকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া হয়। ভারত সরকার এই কথাটি খুব ভালো করেই জানতেন, বঙ্গবন্ধু সেই নেতা যাঁর আহŸানে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি নিজেদের জীবন তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মিত্রবাহিনী ফিরে যেতে বিলম্ব করলে, এই নেতা ডাক দিলে বাংলাদেশের বাঙালিরা মিত্র বাহিনীকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।
তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বলেছেন, আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আশ্বস্ত করেছেন, তিস্তার পানি চুক্তি হবে। আমরা বিশ্বাস করি, খুব তাড়াতাড়ি এই চুক্তির বাস্তবায়ন হবে।
ষ লেখক : দৈনিক ইনকিলাবের পাবনা জেলা সংবাদদাতা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন