বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস)’র সবর্শেষ জরিপ অনুসারে গত ৬ বছরে দেশে ছোট ও অতি ক্ষুদ্র শিল্প কারখানার সংখ্যা বাড়লেও বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিশেষত মাঝারি শিল্পকারখানার সংখ্যা ২০১২ সালে ৬,১০৩টি থেকে ২০১৯ সালে তা প্রায় অর্ধেক কমে ৩,০১৪টিতে নেমে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পখাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সন্তোষজনক ও স্থিতিশীল পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও এ খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বাস্তবতায় তা অনেকটা অস্বচ্ছ ও অবাস্তব বলে মনে হতে পারে। মূলত বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস ও নীটওয়্যার খাতের রফতানী প্রবৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থে দেশের উন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়লেও শিল্পখাতে আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা দেশের সামগ্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি অশনি সংকেত। আমাদের মত জনবহুল রাষ্ট্রে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে রফতানিমুখী ও উৎপাদনশীল শিল্পখাতে বিনিয়োগ ও রূপান্তরের মূল লক্ষ্যই প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া লাখ লাখ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। আলোচ্য বিবিএস জরিপে দেখা যাচ্ছে, গত ৬ বছরে শিল্পকারখানায় নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা ৫ লাখের কম যা বছরে গড়ে ৮০ হাজারের বেশি নয়। অথচ প্রতি বছর আমাদের শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২৫ লাখ জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে। এই বিশাল সংখ্যক জনশক্তির অনুপাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের হার খুবই অপ্রতুল।
পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশে হাজার হাজার নতুন কলকারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লাখ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। আমাদের লাখ লাখ তরুণ মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার শিল্পায়ণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। মূলত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গিয়ে কর্মরত এই বিশাল শ্রমশক্তি শত শত কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণে অসাধারণ ভ‚মিকা রাখছে। সউদি আরব, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতের মত ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার, মজুরি ও মর্যাদা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হলেও সে সব উদ্যোগের কোনো বাস্তব সুফল দেখা যাচ্ছে না। মূলত ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো এখন নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের উপর জোর দেয়ার কারণে বাংলাদেশ সহ বৈদেশিক কর্মসংস্থান নির্ভর দেশগুলোর সুযোগ সুবিধা ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এহেন বাস্তবতায় আমাদের সম্ভাবনাময় শিল্পখাতের বিকাশ ও আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে অধিক মনোযোগি হতে হবে।
কমপক্ষে আড়াইশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানাগুলোকেই বড় শিল্পকারখানা বলে গণ্য করা হয়। আর একশ থেকে আড়াইশ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিয়ে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো মাঝারি শিল্প হিসেবে গণ্য। গত ৬ বছরে বড় শিল্পকারখানার সংখ্যা ৬ শতাধিক এবং মাঝারি কারখানা তিন হাজারের বেশী কমে যাওয়া আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার জন্য দু:সংবাদই শুধু নয়, তা অশনি সংকেত। একদিকে বড় ও মাঝারি শিল্প কমে যাওয়া, অন্যদিকে শিল্পখাতে ডাবল ডিজিটের প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। এ প্রসঙ্গে একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মূখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শিল্প কারখানার হিসাবটি অসঙ্গতিপূর্ণ। তার মতে হয় শিল্পখাতের হিসাবটি ভুল, না হয় বিবিএস’র জরিপটি সঠিক নয়। বড় ও মাঝারি হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও শ্রেফ ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার উপর ভর করে শিল্প উৎপাদন ও রফতানী খাতের প্রবৃদ্ধির হিসাব বিষ্ময়কর। বিদ্যমান কারখানাগুলোর পরিসর বৃদ্ধিসহ অটোমেশনের কারণে উৎপাদন ও রফতানী বৃদ্ধি পাওয়ার তেমন কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে অ্যাকর্ড এলায়েন্সের কমপ্লায়েন্সের শর্ত পুরণ করতে না পারা, ব্যাংক ঋণ বা চুক্তি অনুসারে পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থতার কারণে লোকসান দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার মত পরিস্থিতিতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান বাড়ানো রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যে সব প্রতিক‚ল পরিস্থিতির কারণে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তা নিরূপণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধিই সরকারের অর্থনৈতিক খাতের মূল লক্ষ্য নয়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব নীতিমালা ও পদক্ষেপ বাস্তবায়নের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা ব্যাহত করার মত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি দূর করতে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন