সাধারণ ছুটির মধ্যে শিল্পকারখানা, মার্কেটসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুত ব্যবহার কমে গেছে। বলা যায়, ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে গেছে। যা ব্যবহৃত হয়, তা কেবল বাসা-বাড়ি আর সড়কে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদার ওপরও কোনো চাপ নেই। এর মধ্যেই বিদ্যুতের বাড়তি বিল নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে চলেছে। বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল নিয়ে চলছে গ্রাহকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ। মাস শেষে তারা দেখছে, বিদ্যুৎ বিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকার বিল ২৫-৩০ হাজার টাকাও হয়েছে। ৩০০ টাকার বিল ১০০০ টাকা হয়েছে। এমন অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক বিল নিয়ে অনেক গ্রাহকের আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যুতের এই অতিরিক্ত বিল আসার ব্যাপারে মিটার রিডারদের কারসাজি আছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রাহকদের বলা হচ্ছে, উপরির বিনিময়ে বিল কাটছাঁট করে দেয়া হবে। তবে কেন ও কি কারণে এমন অস্বাভাবিক বাড়তি বিল আসছে, তার যথাযথ জবাবও গ্রাহকরা পাচ্ছে না। এ বিল নিয়ে তাদের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। তারা আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিদ্যুতের এই অস্বাভাবিক বিল আসা নিয়ে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, গ্রাহকদের অতিরিক্ত বিল দিতে হবে না। এ ধরনের বিল আসার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গ্রাহক ও বিদ্যুৎকর্মীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিটার দেখতে না গিয়ে আগের মাসের বা পূর্ববর্তী বছরের এ সময়ের বিদ্যুৎ বিলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিল করা হয়েছে। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের এ যুক্তি ধোপে টিকছে না। কারণ যদি তাই করা হয়, তবে বিলের এ ব্যবধান আকাশ-পাতাল বা তিন-চারগুণ হতো না। হয় একই থাকত, না হয় সামান্য কম-বেশি হতো। কর্তৃপক্ষেরও বাড়তি বিল পরিশোধ করতে হবে না বলে ঘোষণা দিতে হতো না। এখানে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারির ফায়দা লুটার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
বলা অনাবশ্যক, করোনার সময় বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে এবং বিক্রিও কমেছে। এতে বিদ্যুৎ বিভাগ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে এ ক্ষতির মুখোমুখি শুধু বিদ্যুৎ বিভাগই হয়নি। অন্যান্য বিভাগও হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এর বাইরে নয়। তার মানে এটা হতে পারে না, আর্থিক ক্ষতি পোষাতে গ্রাহকদের বিল তিন-চারগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। এটা পুরোপুরি অন্যায় ও অনাচার এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ঘরবন্দী হয়ে থাকার কারণে গ্রাহকরাও চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে যারা ভাড়াটিয়া, তাদের দুর্দশার শেষ নেই। অনেকে বাসা ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারছে না। অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে। এ অবস্থায় বাড়তি বিদ্যুতের বিল তাদের কাছে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আমরা মনে করতে চাই না, বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জেনেবুঝে বাড়তি এ বিলের কারসাজি করেছে। এটা কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা ও লাইনম্যানের যোগসাজস ছাড়া কিছুই নয়। করোনার এই দুর্যোগকালে তারা সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে টু পাইস কামিয়ে নেয়ার ফিকিরবাজি করেছে। বলা বাহুল্য, শুধু করোনাকালেই নয়, অতিরিক্ত বিল করে কোনো কোনো গ্রাহকের সাথে যোগসাজসে বিল কম নেয়া, চোরাই লাইন দিয়ে বিল আদায় করার বিষয়টি স্বাভাবিক সময়ে নিত্যকার বিষয়। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হলেও কোনো কাজ হয়নি। বোধকরি, করোনাকালে অসাধু চক্রটির অবৈধ আয়ে টান ধরায় তারা গ্রাহকদের বাড়তি বিল ধরিয়ে উপরির বিনিময়ে বিল কমিয়ে দেয়ার বাণিজ্য শুরু করেছে। করোনার শুরুতে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছিল, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের বিদ্যুত বিল জুনে বিনা বিলম্ব ফিতে জুনে একবারে দেয়া যাবে। দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তার এ কথা রাখেনি। এটা কথা দিয়ে কথা না রাখা বা গ্রাহকদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। এমনিতেই করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার শেষ নেই। একদিকে তারা আক্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না। তাদের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মধ্যে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরণ তাদের দুর্বল মানসিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বিদ্যুতের বিল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডের অবসান এবং মানুষ কবে সঠিক বিল পাবে, তার গ্যারান্টি আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি। বরং বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুৎ বিল বেড়েই চলেছে। রেকর্ড উৎপাদনের কথা বলা হলেও, লোডশেডিং কমেনি। অথচ বিদুৎ খাতটির ত্রুটি-বিচ্যুতি, সরবরাহ লাইনের আধুনিকায়ন, অবৈধ সংযোগ ও চুরি ঠেকাতে পারলে গ্রাহকদের সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যেত এবং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ রপ্তানিরও সুযোগ সৃষ্টি হতো। এসব দিকে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া প্রয়োজন। তা না করে, গ্রাহকদের ওপর অতিরিক্ত দাম চাপিয়ে দিয়ে বিল আদায় করা এক ধরনের জুলুম। তবে এক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুৎ সংস্থা তার কাজটি আন্তরিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আম্পানের মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়লেও তা দ্রুততার সাথে সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আমরা পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে যে অসন্তোষ ও ক্ষুদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দ্রুত নিরসন করে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে এবং পুনরায় যাতে এ ধরনের অপকর্মের অবতারণা না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন