ঈদ মুমিন বান্দাদের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জিয়াফতের উপহার স্বরুপ। মাহে রমজানের কৃচ্ছ¡সাধনার পুরষ্কার এটা। আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদের অভুক্ত থাকার কষ্টবৎ সিয়াম সাধনার শেষে মেহমানদারী ও জিয়াফত হিসেবে এ উদযাপনের ব্যবস্থা দিয়েছেন। মুমিন বান্দাদের খুশি উদযাপন ইবাদতের মধ্যেই শামিল। তাই মুমিন বান্দাগণ আনন্দ খুশির আতিশর্যেও কোনো অনাচার ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারেন না। তাদের আনন্দ উদযাপন হতে হবে মহান প্রভুর রাজী খুশির মধ্য দিয়ে এবং ইবাদতের পরিধারায়। ঈদের আনন্দ ও উচ্ছ¡াসের দিনগুলোতে রয়েছে বিশেষ কিছু ইবাদত, কিছু শিষ্টাচার কিছু প্রথাগত অভ্যাস।
১.গোসল করা: ইবাদতের মধ্যে সবপ্রথম রয়েছে ঈদের দিন সকালে গোসল করে পাক-সাফ হওয়া। ‘এক ব্যক্তি আলী (রা.)-কে গোসল করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন, তুমি চাইলে তো প্রতিদিন গোসল করতে পার। সে বলল, না। যে গোসল আসলেই গোসল (অর্থাৎ যে গোসলের ফজিলত আছে)। তিনি বললেন, জুমাবারের গোসল, আরাফার দিনের গোসল, কোরবানীর ঈদের দিনের গোসল এবং ঈদুল ফিতরের দিনের গোসল।’ (মুসনাদে শাফেয়ী)
২.নতুন পোশাকাদি পরিধান করা: ঈদের দিন সাধ্যমত নতুন পোশাক পরিধান করা উচিত। নতুন না পারলে ব্যবহৃত পোশাকই ধুয়ে পরিষ্কার করে তা পরিধান করা। ‘হজরত জাবির রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সা:-এর একটি জুব্বা ছিল, যা পরিধান করে দুই ঈদ ও জুমআর দিনে সালাত আদায় করতেন।’ (মুসনাদে বায়হাকী) অন্য বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় যে, হজরত নাফে হতে বর্নিত। তিনি বলেন, দুই ঈদের সময় হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সর্বোত্তম পোশাক পরতেন। (বায়হাকী) আরও জেনে রাখা উচিত যে, ঈদের সাজসজ্জার গ্রণের ক্ষেত্রে ঈদের নামাজে গমনকারী ব্যক্তি ও ঘরে অবস্থানকারী ব্যক্তি; এমনকি নারী ও শিশু সকলের বিধান সমান। (ফাতহুল বারী)
৩. উত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করা: ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার করে (পুরুষের জন্য) ঈদের আনন্দ উপভোগ করা মুস্তাহাব। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, মুসলিম পণ্ডিতগণ প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও মিসওয়াক করাকে মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। (আল মুগনী) অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, ‘ঈদুল ফিতরের দিন তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।’ (আহকামুল ঈদাইন) অবশ্য সাজসজ্জা ও সুগন্ধির ব্যবহার নারীরা নিজেদের বাড়িতে স্বামীদের সামনে, মহিলাদের সামনে কিংবা মাহরাম পুরুষদের সামনে করতে পারবেন।
৪. তাকবীর দেওয়া: ঈদুল ফিতরের সময় চাঁদ দেখার পর থেকে ঈদগাহে যাওয়া আসা পর্যন্ত নিম্নস্বরে তাকবীর বলা সুন্নাত। হজরত ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাকবীর বলতেন। (মুজামে তাবরানী) তাকবীর বলা সম্পর্কে মহান আল্লাহর আল্লাহর বাণী
ও রয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি চান তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি যে, তোমাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন সে জন্য ‘তাকবীর’ উচ্চারণ কর (আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা কর)।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫) সংখ্যা পূর্ণ করা অর্থ হচ্ছে, রোজার সংখ্যা পূর্ণ করার মাধ্যমে।
৫. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া ও আসা: পায়ে হেঁটে ঈদগাহের একদিক দিয়ে প্রবেশ করা এবং অপরদিক দিকে বের হওয়া সুন্নাত। ‘হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন নবি করীম (সা.) এক পথে যেতেন ও অপর পথে ফিরতেন।’ (সহিহ বোখারি) কোনো কোনো আলেমের মতে, ঈদের নামাজে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা মুস্তাহাব।
৬. ঈদের সালাত আদায় করা: ঈদগাহে গিয়ে ঈদের সালাত আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। কেননা, মহান আল্লাহর ভাষায়, ‘নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করেছে, যে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করেছে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করেছে। অতপর সালাত আদায় করেছে।’ (সূরা আলা : ১৪-১৫) উক্ত আয়াতের তাফসীরে সালাত বলতে ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। (আহকামুল কোরআন) ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কোনো নফল সালাত আদায় করা ঠিক নয়। কেননা রাসুলে আকরাম (সা.) কখনো ঈদের সালাতের পূর্বে অন্য (নফল) সালাত আদায় করেননি। ‘ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন বের হয়ে শুধুমাত্র ঈদের দু’রাকাত সালাতই আদায় করতেন, অন্য কোন নফল সালাত আদায় করেননি।’ (সহহি বোখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
৭. শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা: ঈদের দিন একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাত হলে শুভেচ্ছা বিনিময় করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুভেচ্ছা জ্ঞাপন সেটি যে কোনো বৈধ ভাষায় হতে পারে। তবে সর্বোত্তম ভাষা হচ্ছে, ‘তাকাব্বালাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ্ আমাদের ও আপনাদের নেক আমলগুলো কবুল করে নিন)। কেননা এটি সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত আছে। ‘হজরত জুবাইর বিন নুফাইর (রা.) বলেন, ঈদের দিন নবী (সা.)-এর সাহাবীবর্গ যখন একজন অপরজনের সাথে সাক্ষাত করতেন তখন বলতেন, ‘তাকাব্বালাহু মিন্না ও মিন্কুম’। (ফাতহুল বারী)
৮. খেলা-ধুলা করা: পরিবারকে নিয়ে কোন স্থল ভ্রমণ বা নৌ-ভ্রমণে যাওয়া, সুন্দর সুন্দর স্থানগুলো পরিদর্শন করা বা এমন কোন স্থানে যাওয়া যেখানে বৈধ খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। হাদিসে এসেছে, ‘এক ঈদের দিন হাবশিরা বর্শা ও ঢাল দিয়ে খেলছিল। তখন আমি নিজে রাসূল (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম কিংবা তিনি নিজে থেকে বলেছিলেন, তুমি কি তাদের খেলা দেখতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ। তারপর তিনি (সা.) আমাকে তাঁর পিছনে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন যে, আমার গাল ছিল তার গালের সাথে লাগান। তিনি তাদের বললেন, হে বনী আরফিদা! তোমরা যা করতে ছিলে তা করতে থাক। শেষে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, তখন তিনি আমাকে বললেন, তোমার কি দেখা শেষ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে চলে যাও।’ (সহিহ বোখারি)
মিউজিকমুক্ত নাশিদ গাওয়া যেতে পারে। ‘রুবাই বিনতে মুআওয়েজ ইবনে আফরা (রা.) বলেন, আমার বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর নবি করিম (সা.) আমাদের ঘরে আসেন এবং আমার বিছানার উপর বসেন, যেমন তুমি আমার কাছে বসেছ। অতঃপর তাঁর আগমনে আমাদের কচি কচি মেয়েরা ছোট ঢাক/দফ বাজাতে লাগলো এবং বদর যুদ্ধে শাহাদাত প্রাপ্ত আমার বাপ চাচার শোকগাঁথা গাইতে লাগলো। তাদের মধ্যে একজন বলল! আমাদের মাঝে এমন একজন নবি আছেন যিনি আগামীকাল কী হবে তা জানেন। এতদশ্রবণে নবি করিম (সা.) বললেন, একথা ছেড়ে দাও এবং পূর্বে যা বলছিলে তা বলো।’ (সহিহ বোখারি)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন