বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

অণুগল্প

আশরাফ পিন্টু | প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০১৯, ১২:১০ এএম

তরুণী ও বটবৃক্ষ


বটবৃক্ষটি স্থবির ছিল।
একদা চলার পথে বিশ্রাম নিতে ওর ছায়ায় এক তরুণী বসলো। তরুণী ক্লান্ত-প্রাণ। সে বটবৃক্ষের ছায়ায় বসার পর তার দেহ-মন শীতল হয়ে উঠল।
বটবৃক্ষটি বয়েসী হলেও পাতায় ধরেছে তার বসন্তের নবরঙ। তরুণীর স্পর্শে তার চিত্ত চঞ্চল হলো। নববসন্তের ঝিলিমিলি পাতা যেন গান গেয়ে উঠলো।
বটবৃক্ষ বলল, মেয়ে তুমি গান জানো?
তরুণী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। এরপর গান ধরল। সে গান শুনে বটবৃক্ষের হৃদয় রোমঞ্চিত হলো।
এরপর তরুণী বলল, বৃক্ষ তুমি কবিতা জানো?
বৃক্ষও ঝিলিমিলি পাতায় হাওয়ার দোলা দিয়ে হৃদয়ের গহীন থেকে তরুণীকে কবিতা শোনালো।
তরুণীও শিহরিত হলো কবিতা শুনে। ক্লান্ত-প্রাণ তরুণীর হৃদয়ের পঞ্জিভূত বেদনা ধীরে ধীরে বায়বীয় রূপ নিলো। গান আর কবিতার আদান-প্রদানে দুজনের হৃদয়ই বিগলিত। এভাবে বেশ কেটে যাচ্ছিল তাদের দিন। কলেজে যাবার পথে যখনই একটু সময় পায় তখনই তরুণী বটবৃক্ষের ছায়ায় প্রাণ শীতল করে। কত কথা হয় দুজনের!
একদিন বটবৃক্ষ কথায় কথায় বলে ফেলল, মেয়ে, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
তরুণী শুনে মুগ্ধ হলো কিন্তু কোনো জবাব দিতে পারল না।
আরেক দিন ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করল বৃক্ষ।
তরুণী এবার বলল, তোমার শিকড় তো অনেক গভীরে প্রোথিত; হাঁটা-চলা করতে পারো না। কীভাবে গ্রহণ করবে আমাকে? আর তুমি তো বৃক্ষ, আমি মানবী। এমন অসম প্রেম...
বটবৃক্ষ হৃদয়ের গভীর থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ^াস ছাড়ল। বলল, মেয়ে, তুমি না-মানবী, আমি না-বৃক্ষ। আমরা দুজনই চলমান জীবন। দুজনের মধ্যেই আছে পর্যাপ্ত প্রাণরস। জীবনের প্রয়োজনে তোমার আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর ...
Ñআর? তরুণী মুগ্ধ হয়ে শুনছিল বৃক্ষের কথা। বৃক্ষ একটু থামতেই সে কৌতুহলী হলো।
Ñআর, আমিও কিন্তু তোমার মাঝে বৃক্ষের গন্ধ খুঁজে পাই।
বটবৃক্ষের কথায় তরুণী কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
এরপর অনেক দিন চলে গেছে কিন্তু তরুণীর দেখা নেই। বটবৃক্ষ তবু আশায় বুক বাঁধে, দিন গোণেÑ আবার যদি তরুণী এসে বসে তার ছায়ায়Ñ হৃদয় শীতল করে!

২.
অনেক দিন পর।
এক বসন্তে একটি কালো পাখি উড়ে এসে বটবৃক্ষের ডালে বসে। পাখিটি ডালে বসেই গান গেয়ে ওঠে। গানের করুণ সুর বৃক্ষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। সুরটা কেমন যেন পরিচিত মনে হয়। মনে পড়ে যায় তার অতীতস্মৃতি।
বৃক্ষ বলে, পাখি তুমি এ গান কোথায় পেলে?
পাখি জবাব দেয়, বৃক্ষ তুমি চেনো নি আমায়? আমি সেই তরুণী! তোমার ভালোবাসা।
বৃক্ষ অবাক হয়। বলে, এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? আর রূপ-ই বা বদল হলো কেমনে?
Ñসে অনেক কথা! হঠাৎ করেই এক মানবের সাথে বিয়ে হয়ে যায় আমার। কিন্তু না, ওর সাথে আমার ঘর করা হলো না।
Ñকেন?
Ñওর শুধু দেহ ছিল, মন নয়। মন ছাড়া দেহ সে তো পাহাড়ের চেয়েও ভারী। আমি সইতে পারি নি। তাই...
Ñকিন্তু...
Ñতাই ওর সাথে আর ঘর করা হলো না।
Ñকিন্তু তোমার মানবী রূপ?
Ñআমি তো রূপান্তরিত হয়েছি। ওর হাত থেকে বাঁচতে পুনর্জীবন লাভ করেছি। পাখিতে পরিণত হয়েছি।
বৃক্ষ বুঝতে পারে না কি বলবে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলে, পাখি তুমি ফিরে যাও।
Ñকিন্তু আমি তো আর ফিরতে পারব না। বললাম তো আমি পুনর্জন্ম লাভ করেছি।
বটবৃক্ষ কল্পনায়ও এমন দৃশ্যের প্রত্যাশা করে নি কখনো। সে তো তরুণীকে চেয়েছিল, পাখিকে নয়। এ পাখি তো বসন্তের কোকিল। একে দিয়ে বিশ^াস কি? বসন্ত শেষ হলে সেও একদিন ফুড়–ৎ করে উড়ে যাবে ডানা মেলে।
বৃক্ষ আবার বলে, পাখি তুমি ফিরে যাও।
কিন্তু পাখি ওর কথার ভ্রæক্ষেপ করে না। সে আবার গান ধরে। সে গানে বৃক্ষের দেহ আবার রোমাঞ্চিত হয়। হৃদয় বিগলিত হতে শুরু করে। ওকে আর তাড়িয়ে দিতে মন চায় না।

চিহ্ন

প্রকাশ্যে দিবালোকে একজন নিরীহ মানুষের সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে খুন করে পালিয়ে গেল একজন ছিনতাইকারী খুনি। খুনি-ছিনতাইকারীকে ধরার জন্য অনেকেই তার পিছু ছুটল কিন্তু সে মানুষের ভিড়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেল । সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করল কয়েকজন কিন্তু পুলিশ এলো অনেক পড়ে । উপস্থিত সবাই খুনির বর্ণনা দিলো--গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, চুলগুলো কোঁকড়ানো, চোখে সানগ্লাস, লম্বা দোহারা গড়নের অর্থাৎ দেখতে সুদর্শনই বটে!
বর্ণনা মতে, পুলিশ বেরিয়ে পড়ল খুনির সন্ধানে । পুলিশ কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে চিরুনি অভিযান চালাল। যে করেই হোক চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেফতার করতে হবে । যিনি খুন হয়েছেন তিনি আইন সচিবের আত্মীয়।
পরদিন পুলিশ যুবক বয়সী গোটা দশেক ছেলেকে ধরে নিয়ে এলো থানায়। খুনিকে সনাক্ত করতে উপস্থিত কয়েকজন সাক্ষীকেও নিয়ে আসা হলো । সাক্ষীরা দশজনের মধ্যে থেকে একজনকে চিহ্নিত করল। বলল, হ্যাঁ, এই, এই ছেলেটিই কালকে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিল।
সাক্ষীদের কথামত বাকী নয়জনকে ছেড়ে দেওয়া হলো।
সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু গোল বাঁধল তখন, যখন দেখা গেল খুনির মতোই একই চেহারার আরেকজন যুবককে এস আই জুবায়ের থানায় এনে হাজির করল। ওসিকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, এই-ই খুনি। উপস্থিত অনেকেই ওকে পালিয়ে যেতে দেখেছে।
ওসি অবাক নয়নে দুজনের দিকে তাকালেন--হুবহু একই চেহারার, একই ধরনের কোঁকড়ানো মাথার চুল, পোশাকও একই মতো, যমজ ভাই নয় তো?
কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কেউ কাউকে চেনে না এমনই ভাব দেখাল।
যমজ হোক আর না হোক --সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো এদের মধ্যে একজন অবশ্যই খুনি, কিন্তু কে সে? কীভাবে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব? ওসি চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিরুপায় হয়ে এসপি সাহেবকে ফোন করলেন। এসপি সাহেব সব শুনে ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চের মেধাবী অফিসার স্বনন মাহমুদকে পাঠালেন।
স্বনন মাহমুদও দুজনের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল । একই ধরণের চেহারা, একই বেশভূষা, কথাবার্তার ধরণও একই রকম, এর মধ্যে তাহলে খুনি কে?
সাক্ষীদের জিজ্ঞেস করা হলো --ঘটনার সময় একই চেহারার দুজন ব্যক্তি ছিল কি না? সাক্ষীরা জবাব দিলো, না, তারা এই চেহারার একজনকেই খুন করে পালিয়ে যেতে দেখেছে ।
স্বনন মাহমুদ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আসামী দুজনকে নিয়ে গেল একটা অজানা রুমে । সেখানে দুজনকে একটি অত্যাধুনিক ইসিজি মেশিনের সামনে শুইয়ে দেওয়া হলো। পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ ভাবে দুজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো ।
পরীক্ষা শেষে দেখা গেল --প্রকৃত খুনির হৃদপিণ্ডে খুনের চিহ্ন রয়েছে --যা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে ইসিজি রিপোর্টে ।

খুনি
লোকটি খুন করেই যেন হাওয়া হয়ে যায়, কেউ তাকে ধরতে পারে না । কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না । পুলিশরা তার সন্ধানে গলদঘর্ম। কিন্ত খুনি লাপাত্তা, কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই।
এদিকে একের পর এক শহরে খুন হচ্ছে । একই কায়দায়, একই স্টাইলে খুন। খুনের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে খুনি একজনই। কিন্ত খুনি পালাবে কোথায়? যত বড় জঙ্গি-সন্ত্রাসী হোক না কেন, ও তো বিদেশে চলে যায়নি, দেশেই আছে। ধরা ওকে পড়তেই হবে । খুনিকে ধরার জন্য শেষমেষ সিআইডি পিছু নেয় ।
অনেক কৌশল আর কাঠখড পুড়িয়েয় সিআইডি খুনির অবস্থান নিশ্চিত করে। খুনি একটি গোরস্থানে আত্মগোপন করে আছে। একদিন রাত্রিতে সিআইডি খুনিকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। দেখে খুনি একটি নতুন কবর খুঁড়ছে। সিআইডি অবাক হয়ে বলে, তুমি এখানে কি করছ?
সে বলল , মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ চাই
কবরে লুকিয়ে থেকে বেঁচে থাকব-
এজন্যই কবর বানাই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন