খুব ভোরেই এলো টেলিফোনটা। তখনো কারো মুখ ধোয়া হয়নি। নাস্তা খাওয়া হয়নি। বড় ভাবী রিসিভারটা হাতে ধরেই চিৎকার করে উঠলেন-
: ওগো শুনছো- এবং এর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ির সবাই জেনে গেল দু:সংবাদটা।
যে যেভাবে ছিল, গাড়ীতে গিয়ে উঠলো।
কিন্তু-
আমি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে পারলাম না। মায়ের একটা বিকট চিৎকার কানে এলো। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। একসময় গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো পুরানা পল্টনের পথে।
আমি তখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজায়।
ওদের সবার সাথে গাড়িতে উঠতে পারলাম না। অনেক অনেক পরে যখন পুরানা পল্টন পৌঁছলাম, তখন খোকনের লাশটা গোসলের পর খাটিয়ায় নতুন কাপড়ে সাজানো হয়েছে।
খোকন বড় আপার ছেলে এবং একমাত্র ছেলে।
পরিবারের মাথার মণি।
সেই খোকন।
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যা শব্দটা আমার পরিচিত। কিন্তু খোকনের নামের পাশে...।
সে শুধু আমার বোন-পো বলে নয়, খোকনের মতো ছেলেকে নিয়ে এটা ভাবা যায় না।
সেই খোকন!
যে নাকি মাত্র বছর কয়েক আগেও শীতের সকালে ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে ভয় পেতো। আমাকে বলতো-
: মিষ্টি খালা-সাহস হচ্ছে নারে, তুই এক ঘটি পানি আমার গায়ে ঢেলে দিয়ে ভয়টা কাটিয়ে দেয়।
বাড়িতে আমার নাম ছিল চিনি। কিন্তু আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট খোকন ডাকতো মিষ্টি।
মিষ্টি খালা।
এ ডাকের অধিকার শুধু খোকনেরই ছিল। আমি ছিলাম ওর ছোটখালা।
কিন্তু-
খোকনের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের।
আমাদের মধ্যে গোপনীয়তা বলে কোনো শব্দ ছিল না। ছেলে বেলা থেকেই আমরা একসাথে মানুষ।
বড় আপা বলতেন-
: চিনি যে তোর মুরুব্বি, সেটা কি তুই ভুলে যাস খোকন? ওকে যে মানতেই চাস না।
: মুরুব্বি!
চোখ বড় বড় করতো খোকন।
তারপর প্রচন্ড হেসে ফেলে বলতো-
: তাইতো, ঠিক আছে- মিষ্টি খালার বিয়েটাতো আগে হোক। তারপর না হয় খুব করে সম্মান-টম্মান করা যাবে।
আমি কপট চোখে বলতাম-
: বাঁদরামো হচ্ছে!
কিন্তু তারপরেই আমরা বড়পা’র চোখের আড়াল হয়ে ছাদে গিয়ে কুলের আচার খেতাম।
মা বলতেন-
: কে বলবে খালা-বোনপো! একটুও জ্ঞানগম্যি নেই। দু’টোই সমান।
খোকন ছিল ভীতু।
রাতে একা ছাদে পর্যন্ত যেতো না।
কোন কারণে আমি ওর সাথে আড়ি দিলে ঘুম আসতো না খোকনের। বড়পা’র পাশে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। টের পেয়ে বড়পা জিজ্ঞেস করতেন-
: কি হয়েছে? পেট ব্যথা করছে?
: না-
: তবে? ঘুমুচ্ছিস না কেন?
বড়পা খোকনকে কাছে টেনে আদর করতেন।
: বল কি হয়েছে?
খোকন ঠোঁট ফুলিয়ে বলতো-
: মিষ্টি খালা শুধু শুধু আমার সাথে আড়ি দিল কেন?
: ও-সে জন্য এতো দু:খ। বেশ তো কাল সকালে কেমন ভাব করিয়ে দিই দেখিস। এখন ঘুমো।
পরদিন সকালে বড়পা আমায় সব বললে-জেদ বেড়ে যেতো আমার। বলতাম-
: আহা, বাঁদরটার সাথে কথা বলতে বয়েই গেছে আমার। কথা শেষ হবার আগেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো খোকন। চুল টেনে-খামচে রাখতো না।
আমিও শেষে চড় লাগাতাম। আমার সাথে কোনোদিনই পেরে উঠতো না।
চড় খেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো খোকন।
সবার চোখের আড়ালে বাবলা তলায় গিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাতো খোকন। বড়পা, মা কেউ ওকে ডেকে খাওয়াতে পারতেন না।
ওদিকে বকুনি খেতে খেতে আমার অবস্থা কাহিল হতো।
বেলা গড়িয়ে যেতো।
কেউ খোকনকে ঘরে আনতে পারতো না।
আমারও কান্না পেতো।
শেষ পর্যন্ত আমাকেই যেতে হতো।
আমার আত্মসম্মান জ্ঞান চিল টনটনে। ওর কাছে গিয়ে বলতাম
: কেন তুই অমন করছিস? চুলে বুঝি লাগে না আমার!
কিন্তু খোকন চুপ।
হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জিতে ধুলোমাটি। চোখে মুখে ময়লা।
বললাম-
: চল-মা তোর জন্য ক্ষীরের পায়েশ করেছেন। নীরু-বিরু টের পেলে সব শেষ করে দেবে। তবু উঠতো না খোকন।
এবার আমি ওর হাত ধরলাম।
এবং সেই মুহূর্তে অশ্রু ভেজা চোখ দু’টো ওর হেসে ফেলতো।
হাসতাম আমিও।
এমনি করে কেটেছে আমাদের শৈশব আর কৈশোর।
এসেছে বসন্ত। টের পাইনি।
এরই মধ্যে বড়পাও পুরানা পল্টনে নতুন বাড়ি করেছে।
চলে গেছে খোকন।
কিন্তু তবুও ওদের বাড়িতে আমার সময় কেটেছে অজস্র।
প্রায় দিনই কলেজ শেষে চলে গেছি বড়পা’র বাড়ি।
খেয়ে দেয়ে বিকেলের দিকে খোকনের সাথে ঘুরে ফিরেছি।
কলেজ জীবনেই কুমারিত্ব ঘুচেছিল আমার।
খোকন আমার বধূবেশ দেখে ঠাট্টা করেছিল, বলেছিল-
: তোকে এই বেশে কিন্তু মোটেও মানাচ্ছে না- মিষ্টি খালা।
বলেছিলাম-
: কোমল কষে তোর বাঁদরামোর সঙ্গী হলে বুঝি মানতো?
: ঠিক তাই।
কিন্তু কপাল পুড়েছিল আমার। বছর না ঘুরতেই বিধবা হয়ে আবার ফিরে এলাম বাপের বাড়িতে। দু:খ পেয়েছিল খোকন।
আমাকে কখনো একটা চুপ করে থাকতে দেখলেই বলতো-
: খালুকে তুই খুব বেশি ভালোবাসতিস না?
আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে চোখ তুলে চাইতাম শুধু।
খোকন গভীর কণ্ঠে বলতো-
শুধু শুধু একটি মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়ে কি লাভ? উদাস কণ্ঠে বলতাম-
: সেই তুই বুঝবি নে।
খোকন বলতো-
: কাজ নেই আমার বুঝি। তোদের সবাইকে নিয়ে খুব ভালো আছি রে! মনের দিক থেকে খোকন ছিল একেবারে ছেলে মানুষ।
সেই খোকন-
হঠাৎ আমাকে চমকে দিলো।
শুধু তাই নয়।
ভয়ে, শঙ্কায় আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। দু:শ্চিন্তায় ঘুম আমার হারাম হয়ে গেলো।
আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে খোকনের গর্বিত তারুণ্যের ঐজ্জ্বল্য আর চাঞ্চল্য অন্যকে নি:সন্দেহে আকর্ষণ করার মতো।
কিন্তু ও যে এখনো শিশুর মতো সহজ-সরল।
রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হতে সে এখনো জানে না। আর সেই জন্যই ওর জীবনের এই গতি পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়ে তুললো। শেষ পর্যন্ত একদিন ওর যন্ত্রণার সহযোগী হয়ে বললাম-
: তোকে নিয়ে সবার অনেক আশা।
খোকন আমার চোখে চোখ রাখলো।
বলল-
: জানি।
: তোকে ফার্স্ট ক্লাস পেতে হবে।
: জানি।
পরীক্ষার মাত্র এক মাস বাকি।
: আমার মনে আছে।
: তাহলে...?
: তাহলে কি?
হঠাৎ অস্থির কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো খোকন।
আমি চমকে উঠলাম।
ভীষণভাবে চমকে উঠলাম।
একি চেহারা খোকনের...।
একি কণ্ঠ!
ওর যন্ত্রণাময় মুখের ছবি আমি সহ্য করতে পারলাম না।
বেরিয়ে বারান্দার এককোণে এসে দাঁড়ালাম।
বুক ফেটে কাঁন্না এলো আমার।
সামনের জানালাটায় ঘন অন্ধকার। সেই দিকে চেয়ে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম।
কিছুক্ষণ পর পাশে খোকনের উপস্থিতি বুঝতে পেরেও নি:শব্দে দাঁড়িয়ে রইলুম।
এক সময় খোকনের কম্পিত কণ্ঠ আমার হৃদয় স্পর্শ করলো।
: এর নাম ভালোবাসা।
আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। আমার বিস্মিত চোখ দেখলো- খোকনের মুখে সেই যন্ত্রণার ছবি- কেমন ম্লান হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম খোকন বহুদূর এগিয়ে গেছে এবং এত বুঝতে পারলাম ওর এই এগিয়ে যাওয়ার পথটা আমার জানা দরকার। শেষ পর্যন্ত খোকনের কাছেই সব জানতে পারলাম। টিএসসিতে দেখলামও নীপাকে এবং দেখেই বুঝলাম খোকনকে রাহুর মতো গ্রাস করে নিয়েছে নীপা নামের সাংঘাতিক মেয়েটি। খোকনের সম্ভাবনাময় পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়েছে সে।
বোবা করে দিয়েছে।
খোকন যেন মন্ত্রমুগ্ধ।
নীপার অক্টোপাস-বন্ধীনীর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করার পথ জানা নেই খোকনের। নীপাই ওর পৃথিবী।
খোকন জানে না ওর অবচেতন মন ওকে কোন অন্ধকার গহবরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
নীপা সে অন্ধকার রাজ্যের রাণী।
খোকন তার আজ্ঞাবহ দাস মাত্র।
আমি ওকে কি করে বোঝাব, এর নাম ভালোবাসা নয়। খোকন জানে না। এর নাম মোহ। এর নাম ডাইনীর ছলনা।
কিন্তু অবুঝ খোকন বলে এর নাম ভালোবাসা।
পরীক্ষার মাত্র কদিন আগে ঘটলো সেই অবাঞ্ছিত ঘটনা।
ছাত্রী হলের ন্যাক্করজনক ঘটনার অন্যতম নায়িকা নীপা ধরা পড়লো হাতেনাতে এবং বেপরোয়াভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেললো সহজ সরল খোকনকেও। খোকন পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলেছিল-
: সব চক্রান্ত। সব মিথ্যে। নীপা নিষ্পাপ। নীপা শুধু আমার।
কিন্তু নীপা কঠিন কণ্ঠে বলেছিল- শুধু আমাকে কেন ধরা পড়তে হবে? আমার মতো আরো অনেকেই এই হলে আছে, যারা এই করে নিজের স্টাটাস ঠিক রেখেছে। ভার্সিটির খাতায় নাম লিখিয়েছে।
: দোষ শুধু আমার? যারা আমার কাছে আসে তাদের নয়? এই খোকনকেই জিজ্ঞেস করা হোক।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল খোকন।
ওর বন্ধুরা বলেছিল কদিন বাড়িতে থাকতে।
বুকে খুব লেগেছিল ওর।
আমি সব জানতাম। জানতো না বড়পা। ইচ্ছে করে কদিন ওদের বাড়িতে যাইনি আমি। টেলিফোনও করিনি।
আমি তো ভেবেই ছিলাম এখন না হোক, অশোভন একটা কিছু ঘটবেই।
খবর পেয়েছিলাম, কদিন ধরে নিজের ঘরে ধুম হয়ে বসে থাকে খোকন। কারো সাথে কথা বলে না। কি যেন ভাবে।
বড়পা ফোন করে বলেছিলেন-
: তুই একবার আয় চিনি। খোকনকে নিয়ে বড় ভাবনায় পড়েছি।
বড়পা ভাবনায় পড়েছেন খোকনের এই বদলে যাবার ইতিহাস না জেনেই। আর আমি?
আমি ভাবনায় পড়েছি সব জেনে, খোকনের ক্ষয়ে যাওয়া তরুণ্যের মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াব তাই ভেবে।
আমি বুঝতে পারছিলাম নীপা নামের সেই ডাইনী খোকনের সম্ভাবনাময় তারুণ্যের উজ্জ্বল্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে।
দেহ-মন দুদিক দিয়েই খোকন রিক্ত-নি:স্ব।
বড়পাকে উত্তরে আসব বলে ছাদের চিলে কোঠায় এসে ভীষণ কাঁদলাম।
অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে একা একা ঘুরে বেড়ালাম।
বারবার চোখ দু’টো ভিজে আসছিল। মনে মনে কঠিন হতে চেষ্টা করছিলাম।
ঠিক করলাম-
কাল খুব ভোরেই যেতে হবে খোকনের কাছে।
ওকে নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখাতে হবে।
বলতে হবে-
জীবনকে গড়ার জন্য সংঘাতময় ঘটনার প্রয়োজন আছে বৈকি!
জীবন মানেই উত্থান-পতন। জীবন মানেই সংগ্রাম। জীবন মানেই...।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল মাথাটা।
ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। খোকনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
কাঁচা সোনার রঙের সেই মুখ, মাথা ভর্তি একরাশ এলোমেলো চুল। ঘনকালো দু’টো আয়ত চোখ-ঈষৎ মøান।
গলায় দুলছে মায়ের দেয়া সেই সোনার চেনটা। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
জেগে উঠলাম খুব ভোরে তখনো দরজা খোলা হয়নি। বাসি মুখ ধোয়া হয়নি!
এমনি সময় এলো দু:সংবাদটা। আমি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলুম।
খোকনকে আমার আর কিছু বলা হলো না।
পরাজয়
লম্বা করিডোর পেরিয়ে পাঁচ নম্বর স্টুডিওতে ঢুকলো রুমানা। সাথে এলেন অনুষ্ঠান প্রযোজক হায়দার।
মেজো মামার বন্ধু।
না : একটুও বুক কাঁপছে না ওর। আর বুক কাঁপবেই বা কেন?
প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম পুরস্কার পাওয়া মেয়ের ভয় পাওয়াটাই অস্বাভাবিক।
আর এটাতো বেতার ভবনের এক নিভৃত হিম হিম কক্ষে বসে আধখানা গান গাওয়া। ‘অডিশন’ এর নামে একটা অফিসিয়াল কর্তব্য সারা।
নইলে এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। অন্তত আশার মতো সঙ্গীত শিল্পীর জন্য তো নয়ই। মেজো মামার বন্ধু হায়দার বলে, অডিশন ছাড়াও শ্রোতারা তোমাকে লুফে নেবে।
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও অফিসিয়াল নিয়ম একটা আমাদের মেনে চলতে হয়।
আপত্তি করার অথবা ভাবনার কোনো অবকাশ নেই এতে। সবাই জানে রুমানাকে। জানে ওর বিশ্বাস আর ক্ষমতাকে।
রুমানার মধুক্ষরা কণ্ঠ নি:সৃত ঝংকৃত সুরসুধায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সঙ্গীত সম্মেলনের যে হাজার হাজার সুর-পিয়াসী, তারা তো এদেশেরই মানুষ। এদেশের অগণিত জনসাধারণের প্রতিভূ হয়ে এসেছিল তারা। আর সেই সব মানুষের মধ্যেই তো সমগ্র দেশবাসীর অভিনন্দন পেয়েছে রুমানা।
পেয়েছে আশীর্বাদ। আর-না থাক। আর কোনো ভাবনার প্রয়োজন নেই তার। মেজো মামা ডিউটি রুমে রইলেন।
হায়দারের সাথে স্টুডিওর মোটা কার্পেটে এসে বসলো রুমানা। চারদিকে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র। সামনে মাইক। তারপুরাটায় হাত রেখে হায়দারের মুখের দিকে তাকালো রুমানা। হায়দার বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি কন্ট্রোলরুমে আছি।
মৃদু হেসে চোখ নামালো রুমানা।
হায়দার মামাটা যেন কি? ভয় পাবার মেয়ে নাকি সে।
সামনের এক টুকরো কাঁচের দেয়ালের ওপাশেই কন্ট্রোল রুম। বেশ কয়েকজন সঙ্গীত পরিচালক রয়েছেন ওখানে। হায়দার মামাও দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে।
‘অন এয়ার’ এর বাতিটা জ্বলতেই সুর ধরলো। একটা মসৃণ ঝংকারের সাথে একাকার হয়ে গেল আশার সুরেলা কণ্ঠস্বর। প্রথম সুর ধরার আমেজটা কাটতেই স্বাভাবিকভাবে চোখ খুলে সামনের দিকে তাকালো রুমানা।
কিন্তু- হঠাৎ দৃষ্টিটা থমকে গেল সামনের এক টুকরো কাঁচের দেয়ালের ওপর। আর সেই মুহূর্তে রুমানার পৃথিবীতে যেন একটা প্রলয় ঘটে গেলো।
কেঁপে গেলো কণ্ঠের সুর। ওর ছন্দায়িত কণ্ঠের নিভৃতে যেন হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলো আকস্মিকভাবে।
স্তব্ধ হয়ে হাত থামিয়ে দিলেন তবলচী।
নির্বাক বিস্ময়ে কিছু একটা বুঝতে চাইলেন পরীক্ষকবৃন্দ। অস্থির হয়ে পড়লেন হায়দার মামা। মাথানত করে থেমে গেল রুমানা। একটু বিরতি। তারপরে জনৈক পরীক্ষকের কণ্ঠ শোনা গেলো ধন্যবাদ।
আশ্চর্য! আর চোখ তুলতে সাহস হলো রুমানার।
রঙ্গিন কার্পেটের খসখসে রুমে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। পৃথিবীটা তখনো দুলছে। কোনো রকমে দরজাটা খুলে করিডোরে এসে দাঁড়ালো রুমানা। এয়ারকন্ডিশন ছাদের নিচে দাঁড়িয়েও দেয়ালে পিঠ দিয়ে ঘামাতে লাগলো অস্বাভাবিকভাবে।
কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে এলো হায়দার। রুমার রক্তশূন্য মুখের দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন কি হয়েছে মা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
: না। মাথা নাড়লো রুমা।
তারপরই ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ওখান থেকে। এসে সোজা ঢুকলো ওয়েটিংরুমে এবং তারপরেই একটা সোফায় চুপ করে বসে পড়ে বুকের স্পন্দন শুনতে চাইলো।
বেতার ভবনের লেডিস ওয়েটিংরুমে বসে রুমা যখন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ- এ খাবি খাচ্ছিল, সেই সময় স্টুডিওর কন্ট্রোলরুমে বসে বিস্মিত বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আরেকটি মানুষ। তার নাম ওস্তাদ সাইফ খান।
তকালো পাথরের খোদাই করা এক নিষ্ঠুর মূর্তি যেন। সঙ্গীত পরীক্ষকদের অন্যতম ব্যক্তি তিনি। বিস্মিত হয়েছিল আরো অনেকেই। সঙ্গীত সম্মেলনের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর একি ভীরুতা? আশ্চর্য! একের পর এক ‘অডিশন’ দিতে লাগলো সবাই। কিন্তু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সাইফ খান। তার কালো পাথুরে দেহের তন্ত্রীতে জাগলো বিভ্রান্ত ঝড়। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটি হার মেনে বেরিয়ে গেল স্টুডিওর দরজা খুলে, তার তো এমনটি হবার কথা নয়!
সাইফ খান তার সাধনালব্ধ ঐশ্বর্যের সবটুকুই তো উজাড় করে দান করেছিলেন রুমানা নামের মেয়েটিকে। চট্টগ্রামের বানিয়া টিলার একটি সাধারণ ঘরে বসে তিনি রয়েছেন মায়াবী সুরের ইন্দ্রজাল।
আর সেই সুরের হলাহল আকষ্ঠ পান করে নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল এক কুমারী হৃদয়। কতোদি কতো অসতর্ক মুহূর্তে তরঙ্গায়িত সুরের সাথে সাথে উত্তাল ঢেউ জেগেছে সাইফ খানের সমাহিত বুকে। চোখে জ্বলেছে দীপকের আগুন। আবার সে আগুন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে গিয়েছে মালহারের আলাপে। বাহারের রাগে কতো বা হৃদয়ের অব্যক্ত ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছেন তিনি। অক্লান্ত কেঁদেছেন বেহাগের সুরে।
কিন্তু সেই কান্নায়, অশ্রু, সেই অনুভূতি দহনের জ্বালা, কোনোদিনও বুঝতে পারেনি রুমা। বিভোর নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলো রাগ জগতের নিলাভ মায়ায়।
ওর জানার কথা নয়, বুঝার কথা নয়। অথচ, তবুও জানলো।
পৌঢ় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ সাইফ খানের পাথুরের চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকাবার অবকাশ কোনোদিনই পায়নি রুমা।
কিন্তু সেদিন কি যেন হলো। নতুন রাগের আলাপে সাইফ খানের কণ্ঠের সাথে একাকার হয়ে গেলো রুমার কণ্ঠ। আর সেই দ্বৈত কণ্ঠের সুরেলা সুরভিতে নেশায় মাতাল হয়ে উঠেছিল চারদিক। রুম-গাইছিল: মধু রজনী পোহায়ে যায় সজনী বিনে...।
এমনি করে কতোক্ষণ কেটেছে রুমা জানে না। গান শেষ করে যখন চোখ খুলল তখনো লোবান পোড়ানো চাই থেকে মৃদু সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। আর সেই মৃদু। সুরভিটাই যেন হঠাৎ করে আটকে গেলো রুমানার বুকের কাছটিতে। সামনে এক জোড়া অদ্ভূত চোখ যেন নি:শেষ করে দেবে রুমা নামের মেয়েটিকে।
আশ্চর্য! কেন? কেন এমন বিভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন ওস্তাদজী? কেন এখনো ওই চোখ জোড়ায় সামনে থেকে ছুটে পালাতে পারছে না রুমা?
কি অর্থ হয় এর? কেন এই অহেতুক প্রলয় তার সুরে বাঁধা এতো দিনকার জীবনে?
রুমার মনে হলো।
না, মনে হলো নয়; স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে এ দৃষ্টি বড় সর্বনাশ দৃষ্টি। একটা অনাঘ্রাতা কুমারী হৃদয়কে বিভ্রান্ত করে দেবার জন্য ওই চোখ। আর তার আগুন অনস্বীকার্য।
কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত ওই জ্বালাময় আগুনের সামনে থেকে ছুটে পালাতে পারলো না রুমা। ভস্মস্তূপের মতো স্থবির হয়ে বসে রইলো শুধু।
অন্ধকার নেমে এলো চারদিকে। জানালার পাশে কুঞ্জ থেকে হাসনা হেনার মধুক্ষরা সুভাস ভেসে এলো। তবুও যেন সম্বিৎ ফিরে পেল না রুমা।
সাইফ খানের জ্বালাময় বিভ্রান্ত হৃদয়টা যেন সংযত করতে চাইলো নিজেকে। তিনি উঠে সোজা বেরিয়ে এলেন। একবার তার ইচ্ছে হলো রুমাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন এর কারণ। কেন রুমা ভয় পেল? কেন সে ভয় পেয়ে এমন ভস্মস্তূপের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো?
পঁয়তাল্লিশের সাইফ খানের ওই চোখ আর তার তৃষ্ণা কি এতোই অবাঞ্ছিত। তার শিল্পী জীবনের সমস্ত সম্পদ সঙ্গীত হৃদয়ের যতো অলঙ্কার, যতো ঐশ্বর্য সবই তো অকাতরে উজাড় করে দিয়েছেন রুমাকে পরিপূর্ণ করে তুলবার জন্য! সেই সঙ্গে তার স্নেহ- প্রেমবঞ্চিত হৃদয়টাকেও যদি অগোচরে দিয়ে থাকেন তা কি এতোই অপরাধের?
কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারেনি সাইফ খান। রুমার ভয় পাওয়া মূর্তিটি যেন তাকে লজ্জা পাইয়ে দিল।
এরপর রুমার যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন অনেকখানি সময় কেটে গেছে। রুমা ভাবলো, ও কি তবে এতোক্ষণ দু:স্বপ্ন দেখছিল? নাকি এক বিভর্ৎস দুর্ঘটনা ঘটে গেলো ওর এতো দিনকার রুটিন বাঁধা নিয়মে?
ওস্তাদজী! হ্যাঁ, ওস্তাদজী কি তবে ওকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন! নাকি বলেছিলেন! কে জানে! ঠিক মনে করতে পারে না রুমা।
হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে এক সু² অনুভূতির ঝড় যেন অস্থির করে তুললো রুমাকে।
একি হয়ে গেল! কেন হঠাৎ ওস্তাদজী এরকম একটা কান্ড করে বসলেন। কি দরকার ছিল এর!
রুমার মনে হলো ওর সঙ্গীত সাধনা, ওর গুরু ভক্তি মিথ্যে। বৃথাই ওর এতো দিনকার দীক্ষা-শিক্ষা। নইলে ওস্তাদের একটা মাত্র আকাক্সক্ষার দাবিকে খুশি হয়ে স্বীকার করতে পারলো না কেন সে?
কি এমন ক্ষতি হতো, যদি ওই আগুনে পোড়ানো দুটি জ্বালাময় চোখকে জানিয়ে দিতে পারতো তার আকাক্সক্ষার উত্তর? যদি বলতে পারতো- হে আমার শিক্ষাগুরু, তোমার শিক্ষার ঐশ্বর্যকে ‘ঘরানাকে’ আমি যেমন ভালোবেসে গ্রহণ করেছি, নিজেকে ধন্য করেছি তেমনি তোমার হৃদয়টাকেও আমি...।
না না, আর কিছুতেই ভাবতে পারে না রুমা। স্বার্থপর। ভয়ানক স্বার্থপর সে। শুধু একটা কথা, চোখের একটু ভাষা দিতে পারলো না সে।
দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজের কাছ থেকে যেন পালিয়ে বাঁচতে চাইলো রুমা, ভুলে থাকতে চাইলো।
এর সপ্তাহখানেক পরে আবার যখন সাইফ খান এসে ওপরের ঘরে খবর পাঠালেন রুমাকে, তখন ভয়ানক রকমের ভয় পেল রুমা। না না না কিছুতেই সে দেখা করতে পারবে না, ওস্তাদজীর সাথে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়; যেতে সে কিছুতেই পারবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। ওস্তাদজী বললেন- আগামী মাসে প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তোমাকে গাইতে হবে।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো রুমা। আর যেন সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে প্রচন্ড মাথা ঝাঁকিয়ে কেঁদে ফেললো।
: না না না- আমি পারব না। পারব না, কিছুতেই পারব না।
: তোমাকে পারতেই হবে।
কোথায় যেন বজ্রপাত হলো।
কান্না ভেজা বিস্মিত চোখ তুলে তাকালো রুমা।
: ওস্তাদজী।
কিন্তু সাইফ খান তখন ঘরের দরজা পেরিয়ে গেছেন। তার চরম আদেশটা যেন আশার জীবনে একটা মৃত্যুদন্ডের আদেশ। কিন্তু এ কেমন বিচার বিধাতার। কেন-কেন এমন অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছেন তিনি রুমাকে।
আবার যথারীতি আসতে লাগলেন সাইফ খান। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা- সব সময় চলতে লাগলো সুর-সাগরের জোয়ার ভাটা।
আসন্ন সঙ্গীত সম্মেলনে রুমার নামটা যেন চোখ জলসে দেবে সবার। আশাও যেন নেশায় পাগল হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত দরজায় এসে দাঁড়ালো সেই দিন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের হল ভর্তি দর্শকদের আকাক্সক্ষাকে ভরিয়ে তুলার জন্য পর্দা উঠলো ধীরে ধীরে।
আশ্চর্য! সাইফ খানের হাত ধরে মঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ালো আশা- যেন একটা পরম নির্ভরতার হাত। একটা দৃঢ় চেতনার হাত।
কয়েকজনের পরেই রুমার পালা। সাইফ খান বললেন-
: আমি তো রয়েছি। খোদা ভরসা।
খোদা ভরসা করেই বসলো রুমা। তানপুরায় রইলেন সাইফ খান। তার দিকে একবার চেয়ে সুর মন্ডলে আঙ্গুল ছোঁয়ালো রুমা। তারপর শুরু হলো সুরের মায়াজাল বোনা।
এভাবে কতোক্ষণ কেটেছে রুমা জানে না। নেশাগ্রস্ত উন্মাদের মতো সুরের অলিগলিতে ছুটে বেড়াতে লাগলো শুধু। যখন ওর ধ্যান ভাঙ্গলো তখন প্রচন্ড করতালিতে মুখর হয়ে গেছে চারদিক। পরদিন কাগজে ছবি বেরুলো। জীবনী ছাপা হলো। প্রাদেশিক সঙ্গীত সম্মেলনে প্রথম পুরস্কার লাভ করছে রুমা।
আরো একটা নাম। হ্যাঁ, রুমার পাশেই যোগ হয়েছে ওস্তাদ সাইফ খানের নাম। রুমার শিক্ষাগুরুর নাম।
ওস্তাদ সাইফ খানের সেই অমোঘ বাণী- ‘তোমাকে পারতেই হবে’ মর্যাদা রক্ষা করেছেন তিনি। তার সবটুকুন ঐশ্বর্যের হৃদয় নিংড়ানো মাধুর্য রুমার কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে ভুল করেননি তিনি। সম্মান রেখেছে রুমা। সাইফ খানের স্বপ্নকে সফল করেছে আশার প্রতিভা এবং আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছে রুমা। সাফল্যের এই আনন্দ ভুলিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগের সেই ঘটনাকে। সাইফ খানের সেই জ্বালাময় চোখের ভাষাকে।
রুমার বাবা সান্ধ্য হেসে হেসে কথা বলছেন ওস্তাদজীও। সবাই বললেন- দেখতে হবে তো কোন ওস্তাদের ছাত্রী।
সাইফ খান হেসে বলেছেন- সবই অধ্যবসায়-
হেসে হেসে কথা বলছে রুমাও। সবার পরিচয়ও করিয়ে দিচ্ছে ওস্তাদজীর সাথে। কিন্তু তখনো রুমা বুঝতে পারেনি যেন- ওর এই হাসিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হবার নয়।
উৎসব রজনীর সর্বশেষ অতিথিটিও যখন বিদায় নিল সাইফ খান তখনো বাবার সাথে কথা বলছেন।
রুমা এক সময় এসে বলল- ওস্তাদজী আপনার গাড়ি এসে গেছে।
এরপর লনের কাছে এসেই হোঁচট খেলো রুমা। সাইফ খান একটু দম নিলেন।
তারপর হঠাৎ বললেন- কাল থেকে আমি আর আসছি না রুমা।
: কেন? বিস্মিত চোখ তুলতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলো রুমা।
ওস্তাদজীর দু’চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝলকে উঠবে। যেন ক্ষতবিক্ষত আর ক্লান্ত এক ছবি। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হতে চাইলো রুমা। বলল- আমি বুঝতে পারছি না ওস্তাদজী।
রুমাকে বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থা তখন সাইফ খানের ছিল না। শুধু মুখ ঘুরিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললেন- আমার এ দানকে কোনদিনও অবহেলা করো না রুমা। তাহলে আমি বড় কষ্ট পাব।
দেয়ালে ভর দিয়ে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো রুমা। একটা প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় যেন ফেলে দিতে চাইছে ওকে এবং শেষ পর্যন্ত ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো রুমা।
সাইফ খানের গাড়ি চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে এবং সেটাই ছিল তার শেষ যাওয়া। ওস্তাদ সাইফ খানের সেই জ্বালাময় তৃষ্ণার্ত চোখ! সঙ্গীত সম্মেলন! আর চলে যাওয়ার সেইদিন। সব ছবিগুলো যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার আগুন রুমার হৃদয়টাকে যেন পুড়ে ছারখার করে দিলো।
সাইফ খান তার সেই আকাক্সক্ষার চোখ এবং দাবি নিয়ে আর কোনো দিনও এসে দাঁড়ায়নি রুমার সামনে। তার স্বপ্নকে তিনি সফল করেছেন রুমার কণ্ঠের মাধ্যমে এবং তারপরেই নিজেকে তিনি আড়াল করে ফেলেছেন।
দু:খ পেয়েছেন।
লজ্জা পেয়েছেন।
তাঁর পঁয়তাল্লিশের প্রৌঢ়ত্ব, রুমার মতো একটা কাব্যিক- সুলো মেয়ের চোখে চোখ রাখার স্পর্ধাকেই ধিক্কার দিয়েছেন সাইফ খান।
অথচ তার সেই রক্তাক্ত হৃদয়ের শুভাশীষ অবিরত ঝরে পড়েছে রুমার জীবনে। অভিশাপ। না না, এমন কথা ভাবতেও বড় ভয় হয় সাইফ খানের।
কষ্ট তিনি পেয়েছেন এবং এই যন্ত্রণার জ্বালা হয়ত তার বাকী জীবনটাকেও ধিকি ধিকি করে পুড়িয়ে মারবে।
কিন্তু তাই বলে রুমার অমঙ্গল এটা তিনি কখনো কামনা করেন না।
রুমা!
রুমা যে তারই সৃষ্টি। ওর কণ্ঠের ঝংকৃত সুর, গমক-তাল-লয়, আলাপের ওই বিহ্বল ভঙ্গি সব তো সাইফ খানের হাতের গড়া সম্পদ।
সঙ্গীত সম্মেলনের রুমার সাফল্যের জন্য রাত জেগে অক্লান্ত ফরিয়াদ করেছেন তিনি বিধাতার কাছে আর রুমাকে জানিয়ে দিয়েছেন-
: তোমাকে পারতেই হবে।
কিন্তু আজ!
কেন এরকম একটা অসম্ভব কান্ড করতে গেলো রুমার মতো মেয়ে।
দু’ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা নয়- মাত্র তিন মিনিটের একটা অডিশন যা রুমার কাছে ছেলে খেলা- তাতেই...?
ছি: ছি: ছি: তবে কি সাইফ খানের সেই অভিশপ্ত চোখের দিকে তাকিয়েই এ বিভ্রান্তি ঘটেছে রুমার?
সাইফ খানের ইচ্ছে হলো- এই মুহূর্তে সবাইকে আবার বলেন দোহাই আপনাদের, আপনারা আবার রুমার অডিশন নিন। ও ফেল করার মেয়ে নয়। সঙ্গীত সম্মেলনের সেই বিজয়ীনী এই মেয়ে-ই।
কিন্তু পারলেন না।
অসহ্য। তাঁর সৃষ্টি- সাধারণ একটা নিয়মের কাছে হার মেনে যাবে...এ যে ওস্তাদ সাইফ খানের কতো বড় লজ্জা, কতো যন্ত্রণার উৎস তার আর কেউ না বুঝুক, রুমা অন্তত বুঝবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে এলেন সাইফ খান। ইচ্ছে হলো- এক্ষুণি গিয়ে রুমাকে তিনি বলবেন- “তোমাকে পারতেই হবে।”
তিনি না হয় বেতার কেন্দ্রে একটা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও আড়াল হয়ে যাবেন। কিন্তু তবুও যেন কোনে বিভ্রান্তি না আসে রুমার সঙ্গীত সাধনে।
পৃথিবীর মানুষ নাই বা জানলো ওস্তাদ সাইফ খানের পদত্যাগের ইতিহাস। রক্তক্ষরণের বেদনাক্ত কাহিনী। আর শিল্পী সৃষ্টির জবানবন্দী। তবুও যেন রুমার সুরেলা কণ্ঠের রেশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীকে ভরিয়ে দেয় ।
লেডিস ওয়েটিং রুমের সামনে এসে চারদিকে তাকালেন সাইফ খান। বুঝলেন রুমা চলে গেছে। চলে গেছে তার এতোদিনকার স্বপ্নকে, সাধনাকে চরম অপমানের মুখে ঠেলে দিয়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন