লিয়ন ও লীনার কামহীন প্রেম যুগে যুগে সেই প্রাচীন ঘাটে আছড়ে পড়ে। আর্তনাদ করে ওঠে; তীরের পত্র-পল্লব- উড়ন্ত পাখিকুল। একজন আর একজনকে সাপের মতো মরণ কাপড় দিয়ে আছে- কেউ কাকে ছাড়বে না কোনো দিন। কিন্তু ওরা চিরতরে শূন্যের পবিত্রতায় মিলিয়ে গেছে। তাই এই ঘাটকে কেউ কেউ
বলে আজ ‘লাভ ঘাট’ বা ‘বিরহ পুকুর’!
একদিন শেষ রাতে লিয়নের ঘুম থাক্কা খায়। কারণটা সমুদ্রের মতো গভীর রহস্যময়। ঘুমঘরে দেখে দীঘির মধ্যখান থেকে, বিশালাকৃতির এক গাড়ি জলভেঙে, তেড়ে ফুঁসে আসছে লিয়নকে চাঁদমাড়ি করে। শেষে, লিয়নের ডান পাশ দিয়ে, বাঁক নিয়ে বাম পাশে গাড়িটি খাদ্য উদর থেকে খাদ্য ঢালতে শুরু করে। লিয়নকে কোনো স্পর্শ করেনি। বাকি রাত কাটে সেদিন অর্থবহ স্বপ্নের বিশ্লেষণে পরিভ্রমণ করে। ঘটনার পশ্চাতেও ঘটনা জীবন্ত। কিছুদিন আগে, এখানে এমন একটি সম্বর্ধনায় কয়েকটি ফুলের তোড়াসহ বিবিধ দ্রব্য উপহার দেয়া হয় লিয়নকে। বাকিগুলো অন্যদের দিয়ে দিলেও একটি তোড়া সে রেখে দেয় পরম যতেœ। ভাবে, লীনার স্মৃতিকে চিরঞ্জীব রাখার জন্য দীঘির পূর্বঘাটে নেমে, জলে ভাসিয়ে দেবে। কি কারণে লীনার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তা আর দেয়নি। লাগেজে ভরে তা ঢাকায় নিয়ে আসে। এই স্বপ্ন ওকে স্মরণ করিয়ে দেয়, জলের সম্রাট খোয়াজ-খিজির। অর্ঘ্য না দিয়ে তাকে অসম্মান করা হয়েছে। লিয়ন ভয় পেয়ে শামুকের মতো গুঁটিয়ে যায়। এতদিন পর এ স্বপ্ন কেন? নাকি সামনে তার বড় কোনো অন্ধকার ধেঁয়ে আসছে? দেশ-বিদেশী স্বপ্ন বিশারদ পন্ডিতরা ওকে স্বপ্নের বিশ্লেষণ করে বলে, যতো শিঘ্রই ভোগ সম্পন্ন ফরজ। এর দেড় মাস পরেই এখানে একটি অনুষ্ঠানের চিপগেস্ট হয়ে আবার পাখা মেলে লিয়ন।
রাত সেদিন ভালোভাবে কালো বর্ণের পিচে যেন ঢাকা ছিল। ছিল না কোথাও কোন জ্যোৎস্না, ছিল দীঘির চার পাশে গভীরতম নীরবতা, শব্দহীন; মাটির পাতিলে অর্ঘ্য সাজিয়ে পূর্বঘাটের জলে ভাসিয়ে দেয়। ঘাট এমনি ভগ্নজীর্ণ ছিল- উঠতে এবং নামতে মনে হয়েছিল জম যেন ধরে ধরে অবস্থা! অথচ সেই তেঁতাল্লিশ বছর আগে, ঘাটে বসার জন্য সুন্দর পাকা বেঞ্চ সিস্টেম ছিল। লীনা এই ঘাটের বেঞ্চি থেকে যখন লিয়নকে বহুযুগ আগে শেষ বিদায় দেয়, তখন ঘাটের বেঞ্চ ছিল মৃসণ ও দাগ শূন্য কিন্তু আজ চৈত্র পোড়া মংগা অঞ্চলের বিক্ষত মাঠ। এ ঘটনার এক গীবত কাল পরই দীঘি কাটার রহস্য বের হয়ে আসে- এটি তিনশো’ পঞ্চাশ বছরের সুপ্রাচীন। জমিদার জীবন খা কর্তৃক জনগণের জলকষ্ট নিবারনের জন্য খনিত। তিনি জীবনের শেষ সিঁড়িতে এসে পাক্কা দরবেশ হয়ে যান। অর্ঘ্য দেওয়ার পরই লিয়নের লেখায় এই প্রথমবারের মতো সাড়ে তিন শত বছরের প্রাচীন জীবন খাঁর হারিয়ে যাওয়া সামগ্রীক ইতিহাস আচমকা বের হয়ে আসে। মজার বিষয় হলো এতো দিন জীবন খাঁ ছিল সম্পূর্ণ মানুষের চিন্তার বাইরে। এটাই স্বপ্ন দেখার যথার্থ ব্যাখ্যা ভাবতে থাকে লিয়ন।
গ
লীনা দীঘির পূর্বঘাট থেকে, পশ্চিমে মুখ করে, লিয়নকে একদিন যে দোয়া দিয়েছিল, তা এখন বিপুল ফুলতোড়া হয়ে যেন সারা দেশে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। ঘন ঘন সম্বর্ধনা চলছে। ঘরের চাপে সামান্য একটা অভিনন্দনও লিয়নকে দিতে পারছে না। এমনকি ঘরের প্রেষণে লিয়নের পাঠানো কয়েকটি পেইন্টিংও ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে। পেই্িন্ট ফেরত দেয়নি, মনে হয় ওর দেহের হাঁড়গুলো খুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফেরত দিয়েছে। এক একটি দিন আসে লীনার কাছে, উড়াল সেতুর মোটা ভারি পিলার হয়ে। সে থেঁতলে যায়, ভেঙ্গে যায় কিন্তু নিজের মনকে শক্ত রাখে। রাতের ভাঁজে ভাঁজে লীনার কান্নার জল গড়িয়ে যায়। লিয়নের টেনশনে এখন এর তীব্র মাথা ব্যথা। বিদেশ থেকে ট্রিটমেন্টও করে এসেছে। পরম ঘনিষ্ঠজনদের কাছে আক্ষেপ করে বলে,- ‘ও আমাকে ফেলে গেছে, ছেড়ে গেছে- আমি ওকে ছাড়িনি।’ এদিকে লিয়নের ঘরের খুঁটিও আলগা হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বহু দূরে, ঘর সংসারের বিষাক্ত লতায় পতায় জড়িয়ে, জীবন চিত্র অন্ধকার। কিন্তু মন পরে থাকে বহু দূরে, ঘাটের স্যাঁওলায় বুঁদ হয়ে। মাঝে মধ্যে ভাবে, সেই ঘাট কি এখনো আছে? সেখানে কি এখনো বিকেলে বসন্ত পবন খেলা করে?’ লিয়নকে এক পলক দেখার ছলে লীনা কাপড় কাচতে সে দীঘিতে যেত। ওর বুকের হাড়ে মাঝে মধ্যে করুণভাবে বেজে উঠে :
যে মাধবী তলে দাঁড়িয়ে প্রথম
বলে ছিলে ভালোবাসি
আজও সে লতায় ফুল ফোটে হায়
তেমনি বাজে গো তেমনি বাঁশি
অথবা
যতো লিখে যাই ততো না ফুরাই
চিঠি তো হয় না শেষ
স্মৃতির মিনায় আজও বাজে হায়
প্রথমও দিনের রেশ।১
হ্যাঁ, সে বাঁশির করুণ সুর, ছড়িয়ে যায় পাশের সমুদ্রের ঢেউয়ের বারিতে দূরে থেকে দূরান্তর। কিন্তু মনের শাশ্বত লালন করা মানুষটি থাকে যেন আকাশের ওপারে, স্পর্শের অতীত; একমাত্র বন্ধু হলো তার দীর্ঘশ্বাস আর বুক চাপড়ানো। জমিদারের নাচগৃহে প্রথম দিনের চিঠির রেশ, আজও তাকে চেতন থেকে অচেতনে ঢেলে দেয়। সারাক্ষণ মূক হয়ে থাকে।
ঘ
লিয়ন ওখানে কোথায় থাকবে, এ চিন্তায় মগজ ঘূর্ণায়মান ফ্যান। সারাদেশে ওর গুপ্ত ঘাতকের অভাব নেই। শেষে, চিন্তাকে একটি খাতে প্রভাবিত করে দেয়। সেই খাতটির নাম লীনা। তার নির্দেশ ছাড়া কখনও লিয়ন কোনো কাজে হাত দেয়নি। বিশ্বাসটা এমনি সিমেন্ট ও সুঁকড়ির মতো সুদৃঢ়। শেষ পর্যন্ত লীনার সাথে যোগাযোগ হলে ও পরিষ্কার জানিয়ে দেয়- ‘আমার খালাম্মার বাসা কোনোভাবেই ওর জন্য নিরাপদ নয়, ভাইরা ক্ষতি করতে পারে। লিয়ন আমার বাসায় থাকবে। কামশূন্য ভালোবাসার শক্তি এতটাই প্রবল, শত ঝড়-ঝঞ্ঝা টপকে প্রেয়সী যেন প্রিয়কে কবুতরের বাচ্চার মতো আগলে রাখে।’ পৃথিবীর সব মহান প্রেমগুলো একরমই। এ সিদ্ধান্তকে সোনার কয়েন ভেবে, লিয়ন ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়ে দেয়- ‘বিশেষ কোনো স্থানে নয়, আমি ওর খালাম্মার বাসায়ই থাকবো। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। কারণ, রুপোর পাহাড় দখল করতে চেয়েছিল তারা। লিয়ন সেখানে ছিল এক মহা তারকাঁটার বেস্টনিস্বরূপ। শেষে ওর খালাম্মারা লিয়নের সততা ও দেশপ্রেমকে মেনে নেয়। লিয়ন বাসায় গিয়ে পোঁছলো। আদরের কোনো কমতি নেই। যা আছে শূন্যতার সীমাহীন দীর্ঘ মাইল। কারণ, লীনা অনুপস্থিত। নির্দিষ্ট সময় পরের দিন লিয়নকে বহন করা প্রাইভেট ছুটে চললো অনুষ্ঠানস্থলে। চারদিকে নিরাপত্তার শালে আবৃত্ত। কোনো উটকো লোকের প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। লিয়ন একবার মঞ্চের চারদিকে তাকিয়ে দেখে, তার ঘনিষ্ঠনেরা কেউ নেই। নিজেকে শূন মাঠে একটি তালের গাছের মতো একা, অসহায় ভাবতে লাগলো। একজন বক্তাতো বলেই ফেলে- ‘যার জন্য এত কিছু শাড়ির ভাঁজ ভেঙ্গে তবু সে এলো না...।’ লিয়ন নড়েচড়ে উঠে বললো- ‘কি বলছেন এ সব?’ আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ বক্তা বলে ফেলেন, হাসতে হাসতে- ‘আরে, একটু বলতে দেন না।’ লিয়ন কোনো রকম অনুষ্ঠান শেষ করেই তার নির্দিষ্ট থাকার স্থানে মাথা গুঁজে। অসীম এক শূন্যতায় নিজেকে ভেঙ্গে চুড়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এক একটি রাত তার কাছে মনে হতে থাকে আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত, হিরোশিমার নগরীর মতো নিঃসঙ্গ; বিদীর্ণ।
গভীর রাতে, খুব চুপি চুপি রুম খুলে, লিয়ন একটি বড় ফুল গাছের আঙ্গিনায় গিয়ে বসতো। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খুঁজতো লীনার প্রতিবিম্ব। এ গাছটি ওই নাকি লাগিয়ে গেছে বহু বছর আগে। তাই লিয়ন কিছুটা পরিতৃপ্তি খুঁজে পায় ফুলগাছ তলায়। ওর খালাম্মার বাড়িতে, এখানেই ওরা দুইবোন দীর্ঘদিন দেহ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, পাহাড়ের পাদদেশে।
ঙ
একদিন স্বপ্ন দেখে লীনা, দু’হাত বাড়িয়ে লিয়নের দিকে চিৎকার করে বলছে- ‘আমাকে বাঁচাও’ ঘুম ভেঙ্গে খাটে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে লীনাকে লিয়ন। কোথায় সে? পরের দিন খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, লীনা গভীর সঙ্কটে পড়েছে। দায়ী ওর ঘর। কেন রূপোর পাহাড় দখলে লড়াইয়ে সে লিয়নের পক্ষ নিয়েছে। হ্যাঁ, একটা রূপোর পাহাড় দখল নিয়ে লিয়নের সাথে লড়াই চলছিল দেশদ্রোহী কালো এক শক্তির সঙ্গে। ওর ভাইয়েরা সেই শক্তির পক্ষে ছিল। লীনার খালাম্মাদের বাড়ির কাছেই ছিল সেই পাহাড়। লীনা ভাবে, পাহাড় সে লিয়নকে দখল করতে দেবে না। লিয়ন যত শাস্ত্রী নিয়োগ করে পাহাড় রক্ষায়, লীনা তা কৌশলে নামিয়ে দেয়। আর মিটি মিটি হাসে। লিয়ন বিষয়টি ধরে ফেলে; সেও হাসতে থাকে। শেষে লীনা যখন বুঝতে পারে, লিয়ন এতে কষ্ট পাবে- পাহাড়ও সে ধরে রাখতে পারবে না। এটার মালিক হলো স্বয়ং রাজা। রাজার সাথে পেরে ওঠা চারটি খানি বিষয় নয়। লীনার ওপর বর্বর নির্যাতন নিয়ে লিয়ন ঘোষণা দিয়ে বসে- ‘আমি এখনও বেঁচে আছি। ‘ওর চুল কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।’
জীবন ধারা একটি দুঃখের কাজ
তুমি যদি তা না বুঝো
তুমি কখনওই সুখী হবে না।২
রাজার দখলে চলে যায় রুপোর পাহাড়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে লিয়নের সাহসের ফিরিস্তি আর অসাধারণ মেধার বয়ান।
চ
লীনার শরীর থেকে নদীর ধারার মতো এখন গান ঝরে। গর্বে বুকটা ভরে যায়। পাহাড় দখলে যেমনি লিয়নের সাফল্য, তেমনি ছবি অঙ্কনেও খ্যাতি দেশ থেকে দেশান্তর। কয়েকযুগ ধরে মানুষটির সঙ্গে দেখা নেই। বান্ধবীরা ফেসবুক থেকে, লিয়ন বিষয়ে নানা সংবাদ ওকে দেয়। লীনা ভাবে, সেই নাচঘর থেকেই তো লিয়ন ভাবুক, শিল্পী। আঁকার সব কিছুই লীনা ওকে এগিয়ে দিত। বিস্ময় নিয়ে দেখতো লিয়নের সৃজনকর্ম। এ ভাবেই মনের অন্তমূলে চিরদিনের মতো লিয়নকে জড়িয়ে ফেলে।
ছ
লিয়ন ও লীনার কামহীন প্রেম যুগে যুগে সেই প্রাচীন ঘাটে আঁছড়ে পড়ে। আর্তনাদ করে ওঠে; তীরের পত্র-পল্লব- উড়ন্ত পাখিকুল। একজন আর একজনকে সাপের মতো মরণ কাপড় দিয়ে আছে- কেউ কাকে ছাড়বে না কোনো দিন। কিন্তু ওরা চিরতরে শূন্যের পবিত্রতায় মিলিয়ে গেছে। তাই এই ঘাটকে কেউ কেউ বলে আজ ‘লাভ ঘাট’ বা ‘বিরহ পুকুর’। তারপরও ঘাটে নাকি কখনও কখনও ওদের দেখা যায় অলৌকিকভাবে। কিন্তু শনাক্ত করা দুরূহ। অদৃশ্যভাবে কোথায় থেকে যেন দীঘির ঘাটে ভেসে আসে :
যে অংগে কুম কুম দিয়াছো যতনে,
সে অংগে মাখিবো ছাই তোমারি কারণে৩
১. গীতিকার প্রবণ রায়, শিল্পী জগ্মময় মিত্র।
২. ক্রিস্টিনা লাঙুন - সুইডেনের কবিতা
৩. কবি আনন্দময়ী : মধ্যযুগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন