চিন্তায় পড়ে গেলাম, শ্রদ্ধেয় গফুর ভাইয়ের আদেশ পেয়ে। তিনি বলেছেন, দৈনিক ইনকিলাব বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ভ্রমণের উপর একটা লেখা দিতে হবে। একাকী জীবন আমার, অফুরন্ত সময় ও সুযোগ থাকলেও শারীরিক অক্ষমতার কারণে ইদানিং লেখালেখির কোনো কাজে উৎসাহ বোধ করি না। প্রথমত- ভ্রমণ বিষয়ক লেখালেখিতে একসময় আমি আনন্দ পেতাম। আমার ভ্রমণ বিষয়ক লেখা পড়ে অনেকে প্রশংসাও করতেন।
দ্বিতীয় কথা, বহুদিন আমি ভ্রমণে বের হইনি। ভ্রমণ সম্বন্ধে লিখতে হলে পুরনো ভ্রমণে স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আজীবন ভ্রমণ বিলাসি মন আমার ঠিকই। প্রথম জীবনে নৌকা বা ট্রেনে নানার বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। যে কদিন মামার বাড়িতে থাকতাম জান্নাতের সুখ উপভোগ করতাম। নানা-নানী, মামা-মামী, খালা, প্রতিবেশি ও আপনজনদের মায়াময় স্নেহ আবেষ্টনীতে কি যে পুলক জাগা অনুভূতি নিয়ে দিন কাটাতাম। আদেশ নিষেধের বাধাহীন স্বাধীনতায় স্বপ্নের মায়া ভূবনে থাকতো আমাদের আনন্দ বিচরণ ভূমি।
এখন সেই সব কথা ভাবলে মনের ভিতরে শূন্যতার হাহাকার উঠে। যাক সে সব হারিয়ে যাওয়া কথা। তারপর কলকাতায় গেছি সেটা ঠিক ভ্রমণ নয়। সেটা ছিলো আবাস ভূমি।
যখন জীবন গড়িয়ে গেছে অনেক দূর। মাঝ জীবনের বাঁকে এসে জীবন কড়িডোরে পা রেখে চারিদিক ভালো করে দেখার সময়, বোঝার সময় হঠাৎ অভাবিতভাবে সুযোগ এলো আমার জীবনে বিদেশ ভ্রমণের। একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়া চার মহাদেশে বেশ কয়েকটি দেশ দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি নরওয়ে। এ দেশটিকে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিলো। মনের আঙিনায় ঐ দেশের স্মৃতির পাতাগুলো বারবার নাড়া দিয়ে যায়। তাই শুরু করলাম, বহুদিন আগে দেখে আসা নরওয়েকে নিয়ে একটি মধুর ভ্রমণ কথা।
১৯৮৭ তে গেয়েছিলাম সুইডেনে আমার বড় মেয়ের সদ্য প্রসূত সন্তানকে দেখতে। এতো নিরিবিলি, এতো নির্জন দেশটি দেখে কয়েকদিনে আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। থরেথরে সাজানো প্রকৃতির অপূর্ব সম্ভার থাকলেও মনে আমার বিষন্নতার আলোর ছোপ দাগ ফেলে। মেয়ে আমাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। এই বিষন্নতার হাত থেকে বাঁচাতে তার বিদেশিণী বন্ধু পিয়ার মায়ের সঙ্গে ঠিক করলো প্রতিবেশি রাষ্ট্র নরওয়ে বেড়াতে পাঠানোর জন্য। কারণ পিয়ার মায়ের বাড়ি নরওয়ে। তিনিও উৎফুল্ল হলেন নিজের দেশটি দেখাতে পারবেন বলে।
ভিনদেশি অত্যাধুনিক দুই সুইডিশ মহিলার সঙ্গে আমি বেড়াতে যাচ্ছি। তাও আবার যেখানে-সেখানে নয়, বাংলাদেশের মানুষের কল্পনার দেশ, স্বপ্নের দেশ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের শেষ প্রান্তের চির তুষারের দেশ নরওয়েতে। কিছুটা ভয়ও হচ্ছে; ভয় হবারই কথা, কী জানি কোথায় যাচ্ছি। এমনিতেই অজানা জিনিষের শঙ্কায় আমি নার্ভাস হয়ে পড়ি। এবার নার্ভাসের মাত্রাটা একটু বেশি এই যা।
পিয়াকে আমার মেয়ে বারবার সাবধান করে দিয়ে বলে- মা বাংলাদেশের মেয়ে। এই ধরনের বেড়ানোতে অভ্যস্ত নয়। তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রেখ। পথে ঘাটে সবচেয়ে বড় সমস্যা টয়লেট সমস্যা। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে টয়লেট সমস্যার সমাধান করে দিও।
পিয়া হাসি মুখে সব দায়িত্ব বুঝে নেয়। রুবা দু’দিনের আন্দাজে খাবার-দাবার ছোট একটা থার্মো ফ্লাক্স বাক্সে ভরে দেয়। অল্প-স্বল্প কাপড়-চোপড় ছোট একটা ব্যাগে করে দিয়ে দেয় ওখানে ব্যবহারের জন্য। মা যেমন ছেলে-মেয়েকে পরম যতনে প্রবাসে পাঠান, তেমনি আমার মেয়ে আজ আমাকে নরওয়েতে বেড়াতে পাঠাচ্ছে।
২২/৭/৮৭ তারিখ, সকাল দশটা। চারিদিকে রোদ হাসছে। আমরা রওনা হলাম সুইডেনের একটা অঞ্চল সটিনাস থেকে নরওয়ের পথে। পিয়া গাড়ি চালাচ্ছে। পিয়ার মা পাশে বসে আছে। আমি পেছনের সিটে। সটিনাস থেকে পাঁচ মাইল দূরে প্রাসটন নামে ছোট একটা শহরে এসে একটা পেট্রোল পাম্পের কাছে গাড়ি থামালো, গাড়ি থেকে নামলো পেট্রোল নেয়ার জন্য। পেট্্েরাল পাম্পে কোনো কর্মচারী চোখে পরলো না। প্রয়োজনীয় তেল কেনার জন্য পয়সা ফেলার ব্যবস্থা আছে। পয়সা অনুযায়ী তেল ভরে নিতে হয়। কেউ চুরি করে তেল বেশি নেয় না। পয়সা ফাঁকি দেয়ার এ সব বদ মতলব এদের জানা নেই।
সটিনাস থেকে নরওয়ের দূরত্ব প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটার। ট্রেনে এই দূরত্ব পার হতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। আর গাড়িতে লাগে ৮ ঘণ্টা, গাড়িতে পেট্রোল গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল হাতে নিলো পিয়ার মা। গাড়ি চলছে অপার্থিব এক জগতের দিকে। রাস্তার দু’ধারে গহীন ঘন ওক, পাইন, বীচ গাছের দিগন্ত জোড়া বর্ণ আমাকে বারবার বিমুগ্ধ করছে। পিয়ার মা মাঝে মাঝে সুইডেনের ম্যাপ দেখে নিচ্ছে। আমাকেও বুঝাতে চেষ্টা করছে কোন দিক দিয়ে নরওয়ে যাচ্ছি। আমি যে খুব বুঝতে পারছি তা নয়, তবুও কিছুটা আন্দাজ করতে হচ্ছে।
মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি মুসলমান ঘরের মেয়ে আমি। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন। সুইডেন, নরওয়ে এ সব দেশে আমার আসার বিষয়টি স্বপ্নে ছিলো এই সেদিনও। আল্লাহর অপার মহিমায় আমি এই দেশে এসেছি, আবার নরওয়েতেও যাচ্ছি। এটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে নিজের কাছেই। কিন্তু স্বপ্ন এখন বাস্তব হয়ে জীবনে ধরা দিয়েছে। এই সত্যকে অস্বীকার করি কেমন করে? পরম করুণাময়ের কাছে লাখ শোকরিয়া।
ঘণ্টা দুয়েক বিরতিহীন গাড়ি চালিয়ে পিয়ার মা ঝড়ঃধপধহধষ নামে একটি জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়ে বললেন- এখানে একটু নামেন। সুইডেনের খুব সুন্দর জায়গা এটা। টুরিস্টরা সব সময় এখানে ভিড় করে থাকে। পিয়ার মার কথায় আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এতক্ষণ আমি আরেক জগতে বিচরণ করছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে এসে আমরা একটা পুলের উপর দাঁড়ালাম। এই পুলের একটু নিচ দিয়ে দেখলাম ট্রেন লাইন চলে গেছে। আরও নিচ দিয়ে খাল প্রবাহিত হচ্ছে। খালের মূল মুখে পানির স্বাভাবিক স্রোতের গতি রুদ্ধ করে অন্যদিক দিয়ে প্রবাহিত করানো হয়েছে। যেদিকে খালের পানি যাবার কথা, সেখানে সৃষ্টি করা হয়েছে মনোহর জনপদ। মানুষের চিন্তা, কর্ম, সততা ও পরিশ্রমের সঠিক প্রয়োগে দেশকে যে কি অসামান্য উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে পারে- এ সব দেশে না আসলে তা বোঝানো সম্ভব নয়। পিয়া নেমেই আমার জন্য বাথরুমের খোঁজ করতে গেছে- তা ছাড়া কিছু খাওয়ার জন্য একটা জায়গাও দরকার। পিয়ার মা আমার সঙ্গে খালের কাছাকাছি নেমে একটা ছবি তুললো। পরে আমরা হালকা কিছু খাবার খেয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
গাড়ি চলছে নরওয়ে সীমানা লক্ষ্য করে। রাস্তার দু’ধারে কখনো বা চোখে পড়ছে শিলাময় নাতি উচ্চ পাহাড় শ্রেণী, কখনো বা নীল পানির লেক, মাঝে মাঝে ছবির মতো সাজানো জনপদ। সর্বোপরি বড় বড় গাছের সুবিশাল অরণ্য। সব দেখতে দেখতে এক সময় নরওয়ে সীমানায় এসে পৌঁছলাম। এবার পিয়ার মা গাড়ির হুইল ধরে বসলেন। চালকের সিট থেকে পিয়া সরে বসলো। চেকপোষ্ট বরাবর এসে পিয়ার মা গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিল। কিন্তু না কেউ গাড়ি থামাবার নির্দেশ দিলো না। যদিও দু’জন পুলিশ নির্বিকারভাবে চেকপোষ্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গাড়ি এখন নরওয়ে সীমানায় ঢুকে পড়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এখনো নরওয়েকে আমি সুইডেন থেকে আলাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ আমি যাচ্ছি সুইডেনের এক গ্রামীণ এলাকা থেকে। শহর থেকে দূরে এসব গ্রাম ও এলাকার প্রকৃতি সর্বত্র আমার কাছে একরকম মনে হয়। গাড়ি নরওয়ের দিকে একটু এগিয়ে যেতে ভূগোলে পড়া তুন্দ্রা অঞ্চলের দেখা মিললো। নরওয়েকে সুইডেন থেকে আলাদা করার সুযোগ পেলাম। এখন আমার চোখ দূরে ছোট ছোট গাছের দিকে। রাস্তার দু’ধারে দেখা যাচ্ছে একই রকমের দৃশ্য। স্কুলে ভূগোলে ম্যাপ আঁকতে গিয়ে আমরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের শেষ মাথায় তুন্দ্রা অঞ্চলকে সবুজ রঙে ছোট ছোট গাছ এঁকে দেখাতাম, দেখাতাম পানির নিশানা। এই সেই তুন্দ্রা অঞ্চল, যাকে আল্লাহ আমাকে চোখে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার দু’চোখ পানিতে ভরে আসে।
আমরা রওনা দিয়েছিলাম সেই সকাল দশটায়। এখন বেলা তিনটা। প্রায় এসে পড়েছি নরওয়ের রাজধানী অসলোর কাছাকাছি। অসলোতে ঢুকতে ঢুকতে চারটা বেজে গেল। অসলোর সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের সামনে গাড়ি থামালেন। এখানে টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার রয়েছে। হোটেল, রেল, বাস এবং সকল দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে আমাদের একটি মাঝারি রেটের হোটেল প্রয়োজন, পরে অন্য কিছুর ব্যবস্থা। স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলে সিট পাওয়া গেল। কিন্তু গাড়ি পার্কিং এর জায়গা পাওয়া গেলো না। ঠিক হলো স্টেশনের গাড়ি পার্কিং-এ গাড়ি রেখে আমরা হেঁটে হোটেলে আসা যাওয়া করবো। মুশকিল হলো হোটেলে ঢুকে। আমরা সিট পেয়েছি আট তলায়। অথচ উঠার এলিভেটর অচল। সঙ্গিণী পিয়ার মা কিছুতেই এই হোটেলে থাকতে রাজি হলো না। প্রায় ঘণ্টা খানেক চেষ্টা তদ্বির করে আর একটা হোটেল পাওয়া গেলো। শহর থেকে বেশ দূরে। তবে দামে একটু সস্তা। হোটেলের নাম- হলতি শিলেন সামার হোটেল [ঐড়ষঃবশরষবহ ংঁসসবৎ যড়ঃবষ] এই হোটেলটির একটি বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে সতের বছরের ঊর্ধ্ব বয়সি ছেলেদের বিভিন্ন বিষয়ে ৩৩ সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু আছে। এই কোর্স প্রায় সারাবছর চালু থাকে। কেবল ১ জুন থেকে ২০ শে আগস্ট পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য হোটেল করে দেয়া হয়। নরওয়েতে এ ধরনের আশিটি হোটেল আছে। সব কটি ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হয়।
আমরা দো’তলায় ৩০৫ নং কক্ষে জায়গা পেলাম। তিন বেডের একটি রুম। আমাদের দেশের হোস্টেলের ঢঙ্গে করা। দু’দিকে অনেকগুলো রুম মাঝখানে টানা বারান্দা। বারান্দার শেষ মাথায় দু’দিকে বাথরুম ও টয়লেটের ব্যবস্থা। নিচে ড্রয়িং ও ক্যাফেটেরিয়ারের ব্যবস্থা।
হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেল। আমরা তিনজনই শ্রান্ত-ক্লান্ত। পৃথিবীর আরেক প্রান্তের দুই বিদেশিনীর সঙ্গে আমি একা এক বাংলাদেশি প্রৌঢ়া মহিলা। কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করছি। ওরা কিন্তু খুব সহজভাবে আমার সাথে আলাপ-সালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। রুমে ঢুকেই পিয়ার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো- কোন সিট আপনার পছন্দ। আমি জানালার পাশের সিট দেখিয়ে দিলাম। ভদ্র মহিলা সঙ্গে সঙ্গে - অষষ ৎরমযঃ বলে আমার মাল-সামানগুলো আমার বেডের সঙ্গে লাগোয়া কাবাডে ঢুকিয়ে রাখলেন। পিয়া মাঝখানের বেডে জুতাসহ ধুম করে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর উঠে ঝট্পট্ মা ও মেয়ে সব কাপড় খুলে ফেলল। শুধু পড়নে রইল প্যাণ্ট্রি। এত খারাপ লাগছে আমার। আমি নিচের দিকে মুখ করে- এদের উলঙ্গপনা না দেখার ভান করছি। মা-মেয়ে এভাবে বের হয়ে গেলো বাথরুমের দিকে।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে কতক্ষণ বসে রইলাম আমার বিছানার উপর। ভিনদেশি এক মহিলার সামনে এমন বেহায়াপনা ওরা কি করে করতে পারলো, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর তারা রুমে ফিরলো উদম গতরে শুধু একটা তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে। আমি লজ্জা সংকোচে ওদের দিকে তাকাতে পারছি না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রহস্যময়ী অসলো নগরীর রাত্রির রূপ দেখছি। গোটা নগরীটাকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের উপর। পাহাড়গুলো সব বড় বড় পাথুরের চাঁই-এ ঠাসা। রহস্যময়ী অসলো নগরির রাত্রির রূপ যেন যৌবনবতী নারী, আমাকে যেন চোখের ইশারায় টানছে।
এরই মধ্যে মা-মেয়ে কাপড়-চোপড় পরে প্রসাধন সেরে চমৎকার ভঙ্গিতে আমার কাছে এসে জানতে চাইল- আমি শাওয়ার অর্থাৎ গোসল করব কি না। আমি রাত্রি বেলায় গোসল করলাম না, তবে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পালটে নিলাম। কাপড় পালটাতে বাথরুমে যাচ্ছি দেখে ওরা তো অবাক। কাপড় পালটে এসে তিনজনে সঙ্গে আনা খাবার খেলাম। পিয়ার মাও অনেক খাবার সঙ্গে এনেছে। আমার বিছানার পাশে টেবিলে টিফিন কেরিয়ার থেকে তিনি নামালেন- স্ট্রে বেরী, আপেল, কেক, কোল্ড ড্রিংস এর বোতল। সবাই খেয়ে শুয়ে পড়লাম যে যার বিছানায়। পরের দিন সকালে রুবার দেয়া নাস্তা করলাম রুমে বসে। পিয়া ও তার মা চলে গেলেন ক্যাফটেরিয়াতে নাস্তা করতে। ওরা ফিরে এলে আমরা বেরিয়ে পরলাম অসলো নগরী দেখার জন্য। অস্লো নগরী আগাগোড়া পাহাড়ে ঠাসা। মাঝে মাঝে পাহাড় কেটে রাস্তা চলে গেছে এদিকে ওদিকে। সুন্দর ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কোনটার কমতি নেই। রাস্তাঘাটে মেরামতের কাজ চলছে। মানুষজনের চলাচল খুব কম। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের মতো পর্বতশ্রেণী। পিয়ার মা প্রথমে নিয়ে গেল অসলোর গেট হারবারে। অসংখ্য বোট গেট হারবারে পড়ে রয়েছে। তার পরে নিয়ে গেল, ১৩০০ শতাব্দিতে তৈরি একটি দুর্গ দেখাতে। এই দুর্গ সতের’শ শতাব্দিতে পুনঃনির্মাণ করা হয়। ইদানিং এই দুর্গ সরকারি প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওখান থেকে আমরা অসলো টাউন হলে গেলাম। বিখ্যাত এই টাউন হলের সামনে রয়েছে অসলো হ্রদ। একদিকে হারবার অন্যদিকে ব্যস্ত নগরী। লাল ইটের দু’টি স্তম্ভ নগরীর শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।
অসলো টাউন হলের স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ কারুকার্য মেয়র হিরোনিমাস হায়ার ডেল [ঐরবৎড় হরসড়ঁং ঐবুবৎ ফধযষ]-এর অবিনশ্বর কীর্তি। ১৯১৭ সালে নগরের সিটি ফাদার টাউন হলের জন্য একটা নকশা অনুমোদন করেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১৯২০ সালে শিল্পী আর্নস্টেইন [অৎহংঃবরহ অৎহবনবৎম] আর্নবার্গ ও মেঘার্স পোল্সসন [গধমযঁং চড়ঁষংংড়হ] টাউন হলের ভেতরের নকশা আঁকার অনুমতি লাভ করেন। নানা কারণে টাউন হলের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ বাধা প্রাপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত অসলোর প্রতিভাধর শিল্পীদের রাত দিন পরিশ্রমের ফলশ্রæতি স্বরূপ সম্পূর্ণ নরওয়েজিয়ান শৈল্পিক কারুকর্মের মাধ্যমে টাউন হলের দেয়ালের গায়ে নকশা আকার কাজ ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ সম্পূর্ণ হয়। এখন এই টাউন হল সমস্ত নরওয়েবাসিদের জন্য এটা গর্বের এবং নরওয়েজিয়ান সংস্কৃতিকে দেখার একটা সুযোগও বটে। এই হলে একটা মিউজিয়াম রয়েছে। বিদেশি রাজ অতিথিদের দেয়া সামগ্রী এখানে থরে থরে সাজানো। বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সব দেশেরই কিছু না কিছু দেশীয় উপহার সামগ্রী এখানে দেখতে পেলাম। শ্বেত পাথরের একটা ছোট তাজ মহলও দেখলাম।
টাউন হল দেখে গেলাম নরওয়েজিয়ানদের তৈরি আদিমতম নৌকা দেখতে। এই নৌকা প্যাপিরাস পাতার তৈরি। এই নৌকাটি পাঁচ হাজার মাইল সাগর পাড়ি দিয়েছিলো বলে গাইড বুকে লেখা রয়েছে। অসলো নদীর বাঁকে একটি মিউজিয়াম বানিয়ে এই নৌকাটিকে জন সাধারণকে দেখানোর জন্য রাখা হয়েছে। প্রতিদিন চার- পাঁচশত দর্শক স্পিড বোটে চেপে এই ঐতিহাসিক নৌকাখানা দেখতে যান। এই মিউজিয়ামের নাম- ঞযব কড়হ-ঞরশর গঁংবঁস. দ্বীপের মধ্যে এই মিউজিয়ামের অবস্থান। এখানে আসলে বেড়ানো ও ঐতিহাসিক জিনিষ দেখা দু’টোরই স্বাদ পাওয়া যায়।
এই মিউজিয়াম দেখতে দেখতে প্রায় তিনটা। পিয়ার মা বলল- মিসেস চেমন আরা, চলেন এবার ফেরা যাক। সন্ধ্যার পর আবার বেরুনো যাবে। আমি সম্মতি জানালাম। সন্ধ্যার কিছু সময় আগে আমরা বের হলাম গাসটভ ভিজি ল্যান্ড- এর তৈরি ভাস্কর্যে সজ্জিত ভিজি ল্যান্ড কালচার পার্ক দেখার জন্য। আশি একর জমির উপর ভাস্কর্য শিল্পের চরম নিদর্শন নিয়ে এই পার্কটি অবস্থিত। এই ভাস্কর্য গুলোর মধ্য দিয়ে ভিজিল্যান্ড স্তরে স্তরে মানব জীবনের ক্রম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরেছে। নর-নারীর সম্পর্ক, পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক, বড়দের সাথে ছোটদের সম্পর্ক এবং বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে হৃদয়ের সংঘাত এসবও তার ভাস্কর্যের মাঝে স্থান পেয়েছে। পাথরে খোদিত নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি মানব জীবনের প্রবাহমান গতিধারাকে মমতাসিক্ত হৃদয় দিয়ে তুলে ধরেছেন।
এই পার্কে পৌঁছে এই সব অবিশ্বাস্য পাথর- শিল্পের নৈপুণ্য দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধা হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হলেও রোদ এখনো চারিদিক ঝলমল করছে। পিয়ার মা বললেন- আর একটা জায়গা আপনাকে দেখানো যায়। আমি বললাম- চলেন। শুধু শুধু হোটেলে গিয়ে বসে থেকে তো লাভ নেই। এবার আমাকে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর বিখ্যাত স্কী প্রতিযোগিতার জায়গায়। এই জায়গার নাম- হলমেন কোলেন [ঐড়ষষ-সবহ কড়ষবহ] এখানে একটা মিউজিয়ামও রয়েছে। আড়াই হাজার বছরের পুরানো এই মিউজিয়ামে স্কী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য ক্রীড়ামোদীরা শীতকালে আসতো। এখানকার গৌরবোজ্জল কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সঙ্গিনী পিয়ার মা আনন্দে গৌরবে উল্লসিত হয়ে উঠেন। গাড়ী থেকে নেমে এই জায়গার বর্ণনা শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের উপর যেখান থেকে স্কী প্রতিযোগিতা শুরু। এই পাহাড়টি আবার এখান থেকে আরও ১৬৫ ফিট উপরে। মূল জায়গায় ওঠার জন্য কিছু সিঁড়ির ব্যবস্থা রয়েছে। পিয়ার মা বললেন- উপরে উঠলে সমগ্র অসলো শহরের দৃশ্য দেখা যায়। আপনি কি উঠতে পারবেন? পিয়ার মার কথার মধ্যে আমার শক্তিমত্তার উপর কেমন একটা সংশয় লক্ষ্য করলাম। ফলে আমার জেদ চেপে গেলো। বললাম- অবশ্যই পারব। পিয়া গিয়ে উপরে উঠার টিকিট কিনে নিয়ে এলো। আমরা লিফ্টের ঘরে গিয়ে লাইন করে দাঁড়ালাম। সত্তর বছরের বুড়োরাও দেখলাম উপরে যাওয়ার জন্য লাইন ধরেছেন। সাহসে বুক বেঁধে আল্লাহর নাম নিয়ে সত্যি সত্যি আমি লিফ্ট পাড়ি দিয়ে আরো আড়াইশ’ সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে গেলাম স্কী প্রতিযোগিতার মূল যায়গায়। এখান থেকে প্রতিযোগীরা খেলা শুরু করে। নেমে যায় প্রায় আড়াইশ’ মিটার নিচে গভীর খাদে। নিচের দিকে তাকাতেই আমাদের মত মানুষ ভয় পায়। ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারিদিকে অসলো নগরীর শোভা দেখলাম। বিজ্ঞান প্রযুক্তি, বুদ্ধি, আধুনিকতার ও প্রকৃতি হাত ধরাধরি করে এখানে অবস্থান করছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্কী প্রতিযোগিতার স্থান দেখে সে দিনের মতো ফিরে এলাম হোটেলে একরাশ আনন্দ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে। পরের দিন সুইডেনে ফিরে আসার পালা। উত্তর গোলার্ধের শেষ দেশ নরওয়ে। আর নরওয়ের রাজধানী হচ্ছে অসলো। দ্বীপ, নদী, পাহাড়, সবুজ, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি মিলে সুন্দর মনোহর অসলো নগরী। শহরের কোন কোন স্থান থেকে অসলো নগরীকে মনে হয় অনেক নিচে, কোন সময় মনে হয় যেন অনেক উপরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে- ভূগোলে পড়া তুন্দ্রা অঞ্চলের ম্যাপ। সেই ম্যাপ আমার সামনে মেলে ধরেছে অসংখ্য রূপরেখা। মেহেরবান আল্লাহকে হাজার শোকরিয়া।
২৪ জুলাই সকাল দশটার দিকে আমি রওনা দিলাম সটিনাসের পথে, রুবার বাড়ির দিকে। পথে নরওয়ে ছাড়ার আগে পিয়ার মা আমাকে নিয়ে গেলো ভাইকিং জাহাজ দেখাতে। হাজার বছর আগে নিমজ্জিত তিনটি কাঠের জাহাজকে ধরে রাখা হয়েছে ঠিক তার নিজস্ব অবয়বে।
এই তিন জাহাজকে রাখা হয়েছে ভাইকিং শিপ মিউজিয়ামে দর্শকদের দেখার জন্য। ভেতরে তাদের ব্যবহারের দ্রব্য সামগ্রীও দেখলাম। ওদের খাবার জিনিসের মধ্যে একটা মিষ্টি কুমড়া দেখলাম। এবার অসলো থেকে আমাদের বিদায়ের পালা। অসলো শহরের মধ্যে যতক্ষণ গাড়ি ছিল ততক্ষণ ড্রাইভ করলো পিয়ার মা। শহর ছাড়লে পিয়ার মা হুইল ছেড়ে দিলেন। পিয়া গিয়ে বসলো মার জায়গায়।
দু’ধারে সীমাহীন দিগন্তজুড়ে তুন্দ্রা অঞ্চল। সামনে বিসর্পিল- সুন্দর রাস্তা, আমরা তার অভিযাত্রী। পাহাড়, হ্রদ, নদী, অরণ্য রাস্তার দু’ধারে ফেলে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সামনে আরও সামনে। মনে হচ্ছে- অনন্তের পথে বুঝি আমাদের অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রার শেষ নেই, বিরাম নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন