লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান কিশোরগঞ্জ জেলা। লোকসাহিত্যের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো ঋড়ষশষড়ৎব বা ফোকলোর। ফোকলোর (ঋড়ষশষড়ৎব) শব্দটির উদ্ভাবক উইলিয়াম থম্পস (ডরষষরধস ঞযড়সং, ১৮০৩-১৮৮৫)। ফোকলোর একটি যৌগিক শব্দ। ‘ফোক’ এবং ‘লোর’ এর সমন্বয়ে শব্দটি গঠিত। ফোকলোর এর আভিধানিক অর্থ কে লোক বিদ্যা বা লোক জ্ঞান হিসেবে অভিহিত করা যায়। নেপালের রাজ দরবার থেকে মহা মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কারের পর পর আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্যের যে সমৃদ্ধ দ্বার উন্মোচিত হয় তারই ধারাবাহিকতায় ‘ ময়মনসিংহ গীতিকা’। তবে ‘চর্যাপদের’ সাথে ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ মৌলিক পার্থক্য হলো ‘চর্যাপদের’ কবিরা সবাই বিদ্ব্যত সমাজের লোক আর ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ পালাকার বা কবিরা সবাই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত গ্রাম্য অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ। ‘চর্যাপদের’ অন্যতম কবি কাহ্নপা (আনুমানিক দশম শতক) -র বাড়ি ও বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলায়। সু প্রাচীন কাল থেকেই ময়মনসিংহ শিল্প সাহিত্য, শিক্ষা, স্বাধীনচেতা মনভাবোর জন্য আলাদা গুনেগুনান্বিত। পাল, সেন, শাসকরা সমগ্র বাংলাদেশ জয় করতে পারলেও হাওড়, নদী পরিবেষ্টিত পূর্ব ময়মনসিংহ তথা বর্তমান কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার বৃহদঅংশ জয় করতে পারেনি। এখানে দীর্ঘদিন থেকে ছোট ছোট স্বাধীন গোত্র, কোচ, হাজং, রাজবংশীরা বসবাস করে আসছে। ১৪৯১ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা ফিরোজ শাহের অধীন হলেও কিশোরগঞ্জ ক্ষুদ্র স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে থেকে যায়। মোগল সম্রাট আকবরের সময় জঙ্গল বাড়ি ও এগারসিন্দুর কোচ ও অহম শাসকদের অধীনে রয়ে যায়। ১৫৩৮ সালে এগারসিন্দুরের অহম রাজা মুঘলদের কাছে পরাজিত হয় ও ১৫৮০ সালে জঙ্গলবাড়ির কোচ শাসক ঈশা খাঁর কাছে পরাজিত হয়। ১৫৮০ সালে মানসিংহ কে পরাজিত করে ঈশা খাঁ এগারসিন্দুর জয় করেন। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খাঁ ১৫৯৯ সালে মুঘলদের কাছে পরাজিত হয়। এই প্রথম কিশোরগঞ্জ কেন্দ্রীয় মোঘল শক্তির অধীনে আসে। দীর্ঘকালীন স্বাধীন থাকার পর পরাধীনতার বিস্বাদ কিশোরগঞ্জের লোকসাহিত্যে পরিস্ফুটিত হয়। লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ জনপদ কিশোরগঞ্জ। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন এর সম্পদনায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ বেশিরভাগ গীতিকার বা পালা বর্তমান কিশোরগঞ্জ অঞ্চল হতে সংগ্রহ করা। গীতিকা গুলোর নায়ক, নায়িকারা ও এই অঞ্চলের মানুষের পরিচিত। তেমনি একটি নাম কবি চন্দ্রাবতী। বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি তিনি। ষোড়শ শতকের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি চন্দ্রাবতী। তার পিতা মনসা ভাসানের বিখ্যাত কবি দ্বীজ বংশীদাস। তার নিজ কথায়-
“ধারা স্রোতে ফুলেশ্বরী-নদী বহি যায়।
বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়
ভট্রাচার্য্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরনী।
বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনি
-------------------------------
দ্বীজ বংশী বড় হৈল মনসার বরে।
ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে
---------------------------------
বাড়াতে দারিদ্র জ্বালা কষ্টের কাহিনী।
তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী
চন্দ্রাবতী ১৫৭৫ খ্রিঃ পিতা দ্বীজ বংশী দাসের সাথে মিলে রচনা করেন মনসাদেবীর ভাসান। পিতার আদেশে তিনি রামায়ণ ও রচনা করেন। যা বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম রামায়ণ। চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ আজও কিশোরগঞ্জের লোক মুখে মুখে গীত হয়ে আসছে। চন্দ্রাবতীর অন্যান্য রচিত কাব্যগুলো হল : ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘রামায়ণ’। কবি চন্দ্রাবতীর রচিত রামায়ণ ছিল উচ্চ কাব্যিকগুনে সমৃদ্ধ। কীর্তিবাসের রচিত রামায়ণ অপেক্ষা চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ অনেক মধুর রসে ভরপুর। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদ বধ কাব্যের সীতা সরমার কথোপকথনের অংশটি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। কবি চন্দ্রাবতীর জীবনে ও ছিল তার রচিত রামায়ণের সীতার ট্রাজেডি। প্রেমের আগুনে বিশুদ্ধ হওয়া এক অতি মানবীয় রমনীর দেখা পাই আমরা চন্দ্রাবতীর জীবন পাঠ কালে। শিশু কালে চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিল জয়চন্দ্র নামে এক অনাথ বালক। ফুলেশ্বরীর নদীর তীরঘেষা পাতুয়ারী গ্রামে ছিল চন্দ্রাবতীর বাড়ি আর জয় চন্দ্রের নিবাস ছিল অন্য পাড়ের সুন্ধা গ্রামে। জয়চন্দ্র তার মামার বাড়িতে বসবাস করত। ফুলবনে শিবপুজার জন্য ফুলতোলার সময় চন্দ্রাবতীর সাথে জয়চন্দ্রের পরিচয় ও সখ্যতা ঘটে। দুজনে মিলে ফুলতোলে।
ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ান্দ সাথী।
তুলিল মালতি ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী
এভাবে খেলার ছলে জয়চন্দ্র কখন যে চন্দ্রাবতীকে ভালেবেসে ফেলেন বুঝতেই পারেনি। জয়চন্দ্র তার প্রেমের কথা চন্দ্রাবতী কে পত্র লেখে জানানোর মনস্থির করে অতঃপর লেখে-
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমার যদি পাই
জয়চন্দ্রের পত্র পেয়ে চন্দ্রাবতী ও পুলকিত হয়। সে ও যে মনের অজান্তে জয়চন্দ্রকে ভালোবেসে হৃদয় মন্দিরে ঠাঁয় দিয়ে রেখেছে।
চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্রকে পত্র লেখে তার সম্মতির কথা জানাই।
কিমতে লিখিবপত্র বাপ আছে ঘরে।
ফুল তুলে জয়ানন্দ ভালোবাসি তারে
এদিকে জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বীজ বংশীদাসের কাছে ঘটক পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দ্বীজ বংশীদাস ও মেয়ের পছন্দের কথা জানতে পেরে বিয়েতে সম্মতি দেন। বিবাহের আয়োজন হতে লাগল। চন্দ্রাবতী ও দিবস যামিনী জয়চন্দ্রকে পাবার বাসনায় উদগ্রীব। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় অন্যকিছু। জয়চন্দ্র মুসলমান কাজীর মেয়ে আসমানীর প্রেমে পড়ে যান। আসমানির রুপের মোহে চন্দ্রাবতীকে ভুলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। আসমানী, চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্রের বিবাহ, প্রেমের কথা জেনেও তার প্রস্তাবে রাজি হন। জয়চন্দ্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কাজীর মেয়েকে বিয়ে করেন। আর বিবাহের ঘটনাটি ঘটে সেদিনই, যে দিন চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্রের বিবাহের দিন ধার্য ছিল। চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে বর জয়চন্দ্রের প্রতীক্ষায় থাকা অবস্থায় তার কাছে জয়চন্দ্রের অন্যত্র বিবাহের দুঃ সংবাদ আসে। ঘটনার আকষ্মিকথায় পাথর হয়ে যায় চন্দ্রাবতী।
না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষানী
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জল্যা মরে মনে
এভাবে দিন, মাস বছর যায়। নাওয়া খাওয়া ভুলে চন্দ্রাবতী পাথরের মত নিশ্চুপ। কারও সাথে কথা নেই, বান্ধবীদের ডাকে সাড়া নেই। তারপর সে শোকে বিহ্বল হয়ে আজীবন বিবাহ না করার সিন্ধান্ত নেন। যে জয়চন্দ্র কে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেস ও পেল না, এই জীবনে আর কোন পুরুষ কে বিশ্বাস করে সে ঠকতে চায় না পূন:র্বার।
চন্দ্রাবতী বলে “পিতা মম বাক্য ধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর
শিবপুজা করি আমি শিবপদে মতি।
দঃুখীনির কথা রাখ কর অনুমতি
তার শোক বিহবলতা কাটাতে দ্বীজ বংশীদাস চন্দ্রাবতীর জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন। পিতা তাকে মন দিয়ে শিবপুজা ও রামায়ণ রচনা করতে বলেন। শাস্ত্রজ্ঞানী চন্দ্রাবতী ও শিবের পূজা এবং সাহিত্যে চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ইতোমধ্যে জয়চন্দ্র তার ভুল বুঝতে পারেন। আসমানী প্রতি তার টান ছিল সাময়িক মোহে। মোহ কেটে গেলেই চন্দ্রাবতী কে সে মনের ভিতর অনুভব করতে থাকেন। মন যে চন্দ্রাবতীকেই ভালোবাসে। অনুতপ্ত জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীকে পত্র লেখেন।
“শুনরে প্রানের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল হলা হল
পত্র পাঠে চন্দ্রাবতীর ও জয়চন্দ্রের সাথে মিলিত হবার বাসনা জাগে। অশ্রু শিক্ত নয়নে পিতার অনুমতি চাইলেন চন্দ্রাবতী। কন্যার প্রার্থনা শুনে দ্বীজবংশী বলেন-
“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেব বিশ্বেশ্বর
চন্দ্রাবতী তার ভুল বুঝতে পেরে জয়চন্দ্রকে পত্র দ্বারা নিষেধ করে। শিবের ধ্যানে পুরোদমে দেহমন নিমগ্ন করেন তিনি। পাগল প্রায় জয়চন্দ্র পাতুয়ারী গ্রামে চন্দ্রাবতীর সাক্ষাৎ পেথে ছুটে যান। কিন্তু চন্দ্রাবতী দ্বার রুদ্ধ করে শিবপুজায় নিমগ্ন থাকায়
জয়চন্দ্রের ডাক শুনতে পায়নি। ব্যার্থ জয়চন্দ্র মন্দিরের দ্বারে লেখেন-
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই
দ্বার খোলে চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন মন্দির অপবিত্র হয়েছে। তাই দ্বারা পরিষ্কারের জন্য কলসি কাঁখে ফুলেশ্বরী নদীতে জল আনতে যান। গিয়ে দেখেন জয়চন্দ্র ফুলেশ্বরী নদীর জলে ভাসছে। চন্দ্রাবতীর হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাসে কেঁদে উটে ফুলেশ্বরী নদীর ঢেউ। আজও নরসুন্দা, ফুলেশ্বরীর নদীর তীরের মানুষের চোখ ভিজে উঠে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কাহিনী মনে করে। মৃত ফুলেশ্বরী নদীর পাড়ে চন্দ্রাবতীর প্রেমের স্মৃতি বিজরিত শিব মন্দির আজও শাশ্বত প্রেমের বাণী শুনিয়ে যায় আমাদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন