মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সপ্তদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত রাজা সীতারাম রায়ের স্মৃতিবিজড়িত রাজপ্রাসাদগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অযত্ম-অবহেলার কারণে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। অথচ রাজার আমলের সব পুরনো কীর্তি সংস্কার করলে এটি আধুনিক একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। আর এর ফলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে পারে বেশ কিছু বেকার মানুষের এবং বছরে সরকারের আয় হতে পারে কয়েক কোটি টাকা। সেই সঙ্গে বেদখলমুক্ত হতে পারে রাজার আমলের সুবিশাল ইমারত-এলাকা।
মাগুরা জেলা সদর থেকে সড়কপথে ২৫ কিলোমিটার দূরে মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত আজকের মহম্মদপুর উপজেলা সদরই ছিল ইতিহাসখ্যাত বীর, স্বাধীন প্রজাবৎসল রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী। ঢাকার নবাব ইব্রাহিম খাঁর রাজত্বকালে যশোরের এক কায়স্থ ঘরের সন্তান ভূষণায় এক স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনিই রাজা সীতারাম রায়। রাজা সীতারামকে নিয়ে অনেক অনেক কল্পকাহিনী ছড়িয়ে আছে ভূষণা অঞ্চলে। তাকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন ইতিহাস গবেষকদের বিভিন্ন মতামত। তবে যতদূর জানা যায়, রাজা সীতারাম রায়ের বাবা উদয় নারায়ণ রায় ছিলেন তৎকালীন রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তার মায়ের নাম ছিল দয়াময়ী। পিতা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই রাজা সীতারাম রায়ের যাওয়া-আসা ছিল রাজদরবারে। সীতারামের মা তেজস্বিনী ও বিদুষী মহিলা ছিলেন। তার মা দয়াময়ীর নামানুসারে মহম্মদপুরে ‘দয়াময়ীতলা’ নামে এখনো একটি এলাকার নাম রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই রাজা সীতারাম মেধাবলে রাজকার্য, যুদ্ধবিদ্যা, অশ্বচালনা ভালোভাবেই রপ্ত করে রেখেছিলেন। তিনি বাবা উদয় নারায়ণ পরে মহম্মদপুরের শ্যামনগরের জোত বন্দোবস্ত নিয়ে মধুমতি পাড়ের হরিহর নগরে বসতি স্থাপন করেন।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে সীতারাম রায় সাতৈর পরগনার বিদ্রোহী পাঠান করিম খাঁকে শায়েস্তা করার জন্য পুরস্কারস্বরূপ দিল্লির বাদশাহর কাছ থেকে ভূষণা রাজ্যের নলদী পরগনার জায়গীরদার নিযুক্ত হন। এর আগে রাজ্যে জলদস্যুদের অত্যাচার ও অরাজকতা বিরাজ করছিল। বাংলার নবাব তার কার্যদক্ষতা দেখে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এ সময়ের একপর্যায়ে ভৌমিক রাজারা রাজস্ব পরিশোধে টালবাহানা শুরু করলে দিল্লিশ্বরের নির্দেশে তিনি মহম্মদপুর আসেন এবং অল্প সময়ে নিজ শক্তি ও শক্তির বলে সমগ্র ভূষণা নিজ করায়ত্ত করেন। তার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ও মগজলদস্যুদের অবশিষ্ট সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি বিশাল সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তখন থেকে রাজা সীতারাম স্বাধীন রাজাদের মতো রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করলেন। রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিভিন্ন স্থানে সুরক্ষিত দুর্গ গড়ে তোলেন এবং রাজ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন। ভূষণার রাজকার্য পরিচলনায় নবাব বাহিনী পরাজিত ও সেনাপতি তোরাব নিহত হন।
এদিকে আবু তোরাবের মৃত্যুর খবরে ক্ষিপ্ত নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সেনাপতি দয়ারাম ও বক্স আলী খাঁর নেতৃত্বে বিশাল সৈন্যদল পাঠান সীতারাম রায়ের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। বিশাল মোগল বাহিনীর বিপক্ষে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র সৈন্যদল নিয়ে অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে সেনাপতি মেনাহাতি বন্দি হন। প্রচলিত আছে, বিশাল দেহের অধিকারী মেনাহাতি রক্ষাকবচের অধিকারী হওয়ায় কোন অস্ত্র দিয়েই তাকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। মেনাহাতির আসল নাম ছিল মৃন্ময় ঘোষ। বিশাল দেহের কারণে তিনি মেনাহাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। জানা যায়, রাজ্য সীতারামের জনৈক উচ্চাভিলাসী বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীর কারণে মেনাহাতি বন্দি হন। বন্দি শিবিরে নির্যাতনের মুখে তিনি রক্ষাকবচ পরিত্যাগ করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয় সেনাপতির মৃত্যুর সংবাদে সৈন্যদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়। রাজা সীতারামও প্রবলভাবে ভেঙে পড়েন। এ সময় মোগল বাহিনী রাজধানী আক্রমণ করলে রাজা নিজেই যুদ্ধ পরিচালনা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। রাজ্য রক্ষায় আর কোন আশা না থাকায় তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে এক বজরায় চেপে তার বড় সাধের রামসাগর দীঘির মাঝখানে গিয়ে বজরার তলদেশে কুঠার মেরে সপরিবারে সলিল সমাধি করেন। মতান্তরে মোগল সৈন্যদের হাতে বন্দী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
অন্য আর একটি ইতিহাসে জানা যায়, সেনাপতি মেনাহাতির মৃত্যুর পর সীতারাম প্রাণপণ যুদ্ধের পরও শক্তিশালী নবাব বাহিনীর হাতে পরাজিত ও বন্দী হন। পরে দয়ারাম তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে দীঘাপতিয়ায় যাওয়ার সময় দয়ারাম তাকে নাটোর রাজবাড়ি কারাগারে বন্দী করে রাখেন। সীতারাম যে কক্ষে ছিলেন অদ্যাবধি সে কক্ষটি আছে। কয়েক মাস বন্দি থাকার পর নবাব তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। দয়ারাম স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সীতারামের সুন্দর বিগ্রহ দীঘাপতিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তার পাদদেশে ক্ষুদিত আছে দয়ারাম বাহাদুর। দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িতে এই স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত ছিল। এখানে সীতারামের প্রতিষ্ঠিত হরেকৃষ্ণ বিগ্রহের একটি পঞ্চরত্ম মন্দির আছে। মন্দিরটি খুব সুন্দর ও কারুকার্যক্ষচিত। এটি হচ্ছে সীতারামের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও সুউচ্চ মন্দির।
সীতারামের অধীনে একটি সৈন্যদল ছিল বেলদার নামে। সংখ্যায় ছিল দুই হাজার দুই শ’ জন। এরা যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় জলাশয় খনন করত। তার সৈন্য বাহিনীতে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই ছিল, প্রচলিত আছে রাজা সীতারাম মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর সন্তুষ্টির জন্য রাজধানীর নাম রাখেন ‘মহম্মদপুর’। অনেকেই বলেন, এখানে হজরত সুফি মাহমুদ শাহের অনেক স্মৃতি ছিল। এ মহান সুফির প্রতি সীতারামের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। সীতারাম এ মহান সাধকের নামানুসারে নিজের রাজধানীর নামকরণ করেন ‘মাহমুদপুর’ বা ‘মহম্মদপুর’। তবে এর পূর্ব নাম ছিল ‘বাগজান’। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
সীতারামের মহম্মদপুর দুর্গ বর্গাকারে নির্মিত। এই দুর্গের প্রত্যেক বাহু এক মাইলের চেয়েও বেশি দীর্ঘ। চার দিকে মাটির তৈরি উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের বাইরে প্রশস্ত ও গভীর পরিখা। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দুর্গের প্রধান প্রবেশপথ। পূর্ব ও দক্ষিণ কোণে পরিখা মজে গেলেও দক্ষিণ দিকের পরিখা আজো তার অতীত গৌরবের চিহ্ন বহন করছে। এটি খুবই প্রশস্ত ও এক মাইলের চেয়েও বেশি দীর্ঘ। এ পরিখা দেখতে প্রায় নদীর মতো। পশ্চিম দিকের পরিখাটিই বেশ বড়। সেটির চিহ্ন এখনো ঠিক আছে। রাজা সীতারাম কর্তৃক নির্মিত দোলমঞ্চটি এখনো স্মৃতি বহন করছে। বর্গাকারে নির্মিত নিচে প্রকান্ড বেদির ওপর ছিল দোলমঞ্চের অপেক্ষাকৃত ছোট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেদি। তৃতীয় বেদির ওপর ছিল দোলমঞ্চের চূড়া। মোগল ও হিন্দু স্থাপত্যের সমন্বয়ে স্থাপিত মঞ্চের চূড়াটি গম্বুজ আকারের হলেও চতুষ্কোণ ও দীর্ঘাকৃতির ছিল। এখানে হলি উৎসবের সময় রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করা হতো। গত কয়েক বছর হলো দোলমঞ্চটি সংস্কার করেছে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর। সংস্কারের মাধ্যমে এর আদিরূপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও এর গায়ে যেসব পোড়ামাটির ফলক ছিল সেগুলো এখন আর নেই।
‘বার ভুঁইয়া’র অন্যতম রাজা সীতারাম আজ নেই। নেই মন্ত্রী সেনাপতি, রক্ষি, সেপাই, লোক-লস্কর, পাইক- পেয়াদা; কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে ভগ্নাবশেষ অবস্থায় এক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রাজপ্রাসাদ, বিলাসগৃহ, কোষাগার, মালখানা তোষাখানা, নহবতখানা, গোলাঘর, কারাগার, দশভূজার মন্দির, ল²ী নারায়ণ মন্দির, জোড়া বাংলো কৃষ্ণ মন্দির, শিবমন্দির, সেনাপতি সমাধি, সিংহদ্বার, পঞ্চবটিতলা, কাচারিবাড়ি, দোলমঞ্চ, রামসাগর, সুখসাগর, পদ্মপুকুর, ধানপুকুর, ল²ী নারায়ণ পুকুর প্রভৃতি।
রাজার এসব পুরাকীর্তি প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ একটু সুদৃষ্টি দিয়ে সংস্কার করলে এ স্থানটি হতে পারে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র। রক্ষা পেতে পারে রাজা সীতারাম রায়ের স্থাপত্যকীর্তিসমূহ। জানা যাবে রাজার ছোটবেলা থেকে পরিণতি, সফলতা, পাওয়া না পাওয়া, অর্জন-হরণ এসব কালের সাক্ষী সম্পর্কে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
জি. কে. আইডিয়াল ডিগ্রি কলেজ, মাগুরা
(পিইচডি গবেষক, ঢাবি)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন