আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মাঠ সাংবাদিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু মাঠ সাংবাদিকতায় নয়, সকলক্ষেত্রেই জীবনযাত্রার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। বলা চলে বিপ্লব। সেই বুকপোস্ট লেখা ডাকযোগে ও টরে-টক্কার টেলিগ্রামে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা হারিয়ে গেছে। ইয়থ আর উইনসন পেনের কালি দিয়ে সাদা কাগজে খবর লিখে ফ্যাক্স পাঠানোর দিনও শেষ। ডেক্সটপ কম্পিউটার থেকে ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন প্রায় সব সাংবাদিক। হাতে লেখা একেবারেই বন্ধ। হাতে লেখা চিঠিপত্র আদান-প্রদানও হয় না বললেই চলে। ডাকযোগে এবং টরে-টক্কার টেলিগ্রামে রিপোর্ট পাঠানোসহ পুরানো সব পদ্ধতির মাঠ সাংবাদিকতার কথা বললে নতুন প্রজন্ম খিলখিল করে হাসে। এখন ফেসবুক ও ইন্টারনেটের যুগ। এরপর কি হবে কে জানে। মফস্বলে কখন জাতীয় পত্রিকা আসবে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করার দিন নেই, অনলাইনে মুহূর্তে ক্লিক করলেই দেশ-বিদেশের খবর পাওয়া যায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিপ্লবে দেখা যায় সচিত্র প্রতিবেদন। একসময় গ্রামীণ সাংবাদিকতা ছিল কঠিন। এখন খুব সহজ হয়েছে। হাতের মুঠোয় চলে এসেছে সবকিছু। সেজন্যই মুরব্বিরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, মাঠ সাংবাদিকদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ঠিকই কিন্তু মূল জায়গা থেকে কোনোভাবেই যেন না সরে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে দেয়। দেখি শুনি বুঝি লিখি এর বদলে এখন অনেকটা কাস্টপেস্ট ও সিসি সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
এই যে বিরাট পরিবর্তনে সাংবাদিকতার পরিবর্তন কতটা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকদের গতি বেড়েছে না কমেছে, আমরা এগুচ্ছি না পিছাচ্ছি- সেই প্রশ্নের জবাব বিদগ্ধ পাঠকরা দিতে পারবেন। তবে একথা ঠিক এতটা আরাম-আয়েশে সাংবাদিকতা নিকট অতীতেও ছিল না। লক্ষণীয় আগে মেধার প্রতিযোগিতা চলতো মাঠ সাংবাদিকতায়, এখন সেটি অনেকটাই কমে গেছে। বিভিন্ন জেলায় কাস্টপেস্ট এবং সিসি সাংবাদিকতা জোরেশোরে চলছে প্রযুক্তির বদৌলতে। মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, দক্ষতার সাথে নিজের মুন্সীয়ানায় একটা রিপোর্ট লেখা হবে যা দ্বিতীয় কোন অনলাইনে কিংবা জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হবে না। এরকম সাংবাদিকের সংখ্যা নেই যে তা নয়। তবে কাস্টপেস্ট ও সিসির মাত্রা বেড়েই চলেছে। কোন মাঠ সাংবাদিকের আহত করার জন্য নয়, আমিও একজন মাঠ সাংবাদিক হিসেবে যেটি লক্ষ্য করছি সেটিই তুলে ধরলাম।
আধুনিক হওয়া ভালো কিন্তু অত্যাধুনিকতা ভালো নয়- তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহার হবে ঠিকই কিন্তু আমরা কেন যেন মাঠের বদলে ঘরমুখো হয়ে পড়ছি। সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের কোথায় কি অনিয়ম, অব্যবস্থা, সরকারি ও সেরকারি দপ্তরের দুর্নীতি ও উন্নয়নের খবরাদি সরেজমিনে খোঁজখবর নেওয়ার ঘটনা দৃশ্যত কমই চোখে পড়ছে। পেশাটিতে ভেজাল ঢুকে পড়ার কারণে পেশাটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদার লড়াই করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। ৮০-এর দশকে অবিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নের একজন নগণ্য সদস্য হিসেবে দেখেছি পত্রিকায় পেশাদার সাংবাদিককে সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ ও পেশাদার সাংবাদিকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং রুজি-রুটির আন্দোলন করতে। আজ চিত্র অনেক বদল হয়েছে। কোয়ালিটি বাড়ছে না বাড়ছে কোয়ানটিটির সংখ্যা। মাঠে নজর দিলে দেখা যাবে অনেক মাঠ সাংবাদিকের বেহাল দশা। মর্যাদার স্তর দ্রুত নামছে। এটি হয়েছে সাংবাদিকদের বিভাজনের রেখা মোটা হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে। মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখেন না অনেক সাংবাদিককে। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মাঠ সাংবাদিকতায় জীবন্ত জগতের দেখা মেলে। মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত বদলে যাচ্ছে দ্রুত। বিস্ময়কর নৈপুণ্যের সঙ্গে মফস্বলের অনেক সাংবাদিক অসাধ্য সাধন করেছেন। মেধাগত উৎকর্ষ ও তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতায় মাঠ সাংবাদিকদের একটা সুনাম আছে। লেখার স্টাইলের ভিন্নতা ও বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকেই পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। আগের মতো মফস্বলের সাংবাদিক বলে নাক সিটকানো ভাবটা নেই। দিনে দিনে মাঠ সাংবাদিকতার গুরুত্ব¡ বাড়ছেই। মাঠ সাংবাদিকতায় জনগণকে দৃষ্টির আড়ালে থাকা ছবি দেখানো যায়। অকৃপণ প্রকৃতির দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ আছে। মাঠের ওপর নির্ভরশীল দেশের প্রতিটি মানুষ। সেজন্য মাঠের দিকে সবার দৃষ্টি।
মাঠ সাংবাদিকতায় বিরাট পরিবর্তনের বিষয় প্রায়ই উঠে আসে প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের আলোচনায় কিংবা সাংবাদিকদের আড্ডায়। গণমানুষের মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাবের ৩৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যায় অতিক্ষুদ্র লেখক হিসেবে লেখার আহ্বান পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। ভাবলাম মাঠের একজন সাংবাদিক হিসেবে পরিবর্তনের বিষয়টি লিখি। তাই কলম চালানো। ইনকিলাব একে একে ৩৩টি বছর পার করলো। ইনকিলাবের পথচলা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেকটাই কংকটাকীর্ণ। অনেক বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উৎরাই পার করে এগুতে হচ্ছে। আমার সাংবাদিকতার বয়স ৪০ বছর। দু’টি স্থানীয় দৈনিকে স্টাফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক এবং দৈনিক আজাদের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে যুক্ত হই। সাংবাদিকতার সিংহভাগ সময় দৈনিক ইনকিলাবে কাটলো। মাঠে কাজ করতে গিয়ে ‘মাঠ সাংবাদিকতা’ ও ‘ক্ষত-বিক্ষত বিবেক’ দুটি বই প্রকাশের সুযোগ পেয়েছি। এটি সম্ভব হয়েছে ইনকিলাবের পেশাদার, লেখার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, দক্ষ, বিচক্ষণ সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের কারণে। তার অনুপ্ররেণা সহযোগিতা সহমর্মিতা আমার চলার পথের পাথেয়। বলতে দ্বিধা নেই যে, ইনকিলাব আমার অস্তিত্বের সারথী।
মাঠে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমার দেখা ৪০ বছরে পরিবর্তন হতে হতে এখন আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। অনেকটা নেশার বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত হওয়া। মাঠে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমাজের সব অত্যাচার, নির্যাতন, অনাচার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্দশা, সমস্যা, অসঙ্গতি, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, সুলভ উপায়ে স্বার্থসিদ্ধির নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছি। মাঠের পেশাদার সাংবাদিকদের জীবনে যেমন রঙিন স্বপ্ন ভরপুর, তেমনি অনেক দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। অনেক সময় নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছে শিউরে ওঠার মতো দুঃস্বপ্ন দেখতে হয় সাংবাদিকদের। ছোট বড় ভূমিকম্পও নেমে আসে মাঝেমধ্যে। আবার সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত সুন্দরবনের গাছপালার মতো জেগে উঠতে হয়।
সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা। এই বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে সাংবাদিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতা ও যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তিনি কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। ধরা যাক, একজন সাংবাদিক সমাজের নিকট তথা পাঠকের নিকট ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের সামাজিক বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। সে ক্ষেত্রে একজন সজ্জন সাংবাদিকের সত্য সংবাদও মানুষ বিশ্বাস করে না। বিপরীতে, ব্যক্তি সাংবাদিকের বিশ্বাস যোগ্যতা কম, কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠানের সামাজিক বিশ্বাযোগ্যতা বেশি হলে কম বিশ্বাসী সাংবাদিকের অর্ধসত্য রিপোর্টও বিশ্বাস্য বলে গণ্য হতে পারে শুধু প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার উপর নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে পাঠক বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হন।
মাঠের সাংবাদিকরা জীবন জানালায় শুধুই যে নিকষ কালো অন্ধকার দেখেছেন। তা নয়। আলোর সন্ধানও পেয়েছেন। প্রযুক্তির বদৌলতে এখন আর সংবাদপত্রের ডেস্কের আর মাঠের সাংবাদিকতার মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। তবে সত্যিকার মাঠ সাংবাদিকতা এখনো কঠিন। বহু প্রতিকুলতার মধ্যে জীবন নামের বিশাল স্রোতসিনী নদী পাড়ি দিতে হয়। কাটাতে হয় জোয়ার ভাটার মধ্যে। প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। সমাজের অনাচার, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ ও চোরাচালানসহ নানাবিধ লোমহর্ষক অপরাধের খবরাখবর প্রকাশ করতে হয় বুকে সাহস বেঁধে। এতো গেল ঘটনা প্রবাহ। খবরের পেছনের খবর প্রকাশ করতে গেলেই তো হয় যত বিপত্তি। কারো না কারো বিরাগভাজন হতেই হয়। তখনই দেখা যায় আঘাতের পর আঘাত আসে। তারপরেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিধিরাম সর্দারের মতো কলম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে মাঠ সাংবাদিকদের। সাংবাদিকের কলম শাণিত তরবারীর মতোই ভূমিকা পালন করে। যুগে যুগে মাঠ সাংবাদিকতায় অনেকেরই উজ্জ্বলতার ইতিহাস আছে।
দেশের প্রায় সবখানেই কমবেশি পেশাদার সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময় হামলা, মামলা, জেল, জুলুম, হুলিয়ার শিকার হয়েছেন। সত্য লিখলেই ক্ষুব্ধ গোষ্ঠী তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে স্বার্থান্বেষী মহল। ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেয় সাংবাদিকদের পেছনে। মামলাবাজ লোক যোগাড় করে কোনরকমে একটা মামলা ঠুকে দিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে জেলের ভাত খাওয়ানো হয়। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনাও কম নয়। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকরা কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। মাঠ সাংবাদিকতায় আজ এখানে কাল সেখানে ছুটে বেড়াতে হয়। আজ সীমান্তের নিত্য ঝুঁকির মেঠো পথে। কাল শহরের অলিতে-গলিতে কিংবা কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের দোরগোড়ায়। এর ব্যতয় ঘটলে তখন আর ‘ফিল্ড জার্নালিজম’ থাকে না, হয়ে যায় ‘হোম জার্নালিজম’। একথা ঠিক যে, কাটপেস্টে ‘টেবিল মেক’ রিপোর্টের মাত্রা বাড়ছে। তাই কিছু পরিবর্তন এগিয়ে নেয়ার চেয়ে পিছিয়ে দেয়। মাঠ সাংবাদিকদের বিনীতভাবে এই কিষয়টির দিকে খেয়াল রাখার অনুরোধ থাকবে।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বলা যায়, যেমন অজপাড়া গা’য়ে যারা সবসময় লুঙ্গি পরতেন এখন পরেন প্যান্ট। কাদামাটির ঘর কয়েক গ্রামে ঘুরেও কালেভদ্রে চোখে পড়বে। মোবাইল ছেলে বুড়ো সবার হাতে। ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে সমানতালে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনে সবাই এগিয়ে একথা সত্য। এটাও তো ঠিক যে, শহর গ্রামে সমানতালে ফেসবুক ঘাটাঘাটি চলে মোড়ে মোড়ে। আগের মতো নির্মল আড্ডা হয় না বললেই চলে। এই পরিবর্তনের হাওয়ায় মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে কম।
হ লেখক : দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন