পাকিস্তান আন্দোলন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির খেয়াল-খুশির ফলশ্রু তি ছিল না। উপমহাদেশে দীর্ঘদিনের ইংরেজ শাসন ও শোষণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী স্বার্থবাদী সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার স্বীকারে অনীহার প্রেক্ষিতেই এই আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়েছে। উপমাহাদেশের কোটি কোটি অভহেলিত ও শোষিত জনতার আশা-আকাক্সক্ষার রূপায়ণ আর তাদের সাবির্ক অধিকার আদায়ের দাবীই ছিল এই পরিকল্পনা ও সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। এই আন্দোলনের সূচনা হয় পূর্ববাংলার সূর্য সন্তান নওয়াব সলিমুল্লাহ্র উদ্যোগে ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, বিকশিত হয় ডক্টর ইকবাল, চৌধুরী রহমত আলী ও হায়দরাবাদের ডক্টর লতিফের চিন্তায়, আর সুস্পষ্ট লক্ষ্যের সংগ্রামে রূপলাভ করে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের জীবন সাধনায়। বিরাট বিশাল ব্রিটিশ শাসিত ভরতবর্ষ একটি দেশ নয়- একটি উপমহাদেশ। এর আয়তন প্রায় আঠার লক্ষ আট হাজার ছয়শত আশি বর্গমাইল। সোভিয়েত রাশিয়াকে বাদ দিলে সমগ্র ইউরোপের সমান। দু’হাজার মাইল এর দৈর্ঘ্য। ১৯৪১ সালে আদমশুমারী অনুযায়ী লোকসংখ্যা চল্লিশ কোটির মত-তখনকার পৃথিবীর লোকসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ, সমগ্র ইউরোপের লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি।
ভারতবর্ষ অখন্ড দেশ নয়। ধর্মে, ভাষায়, গোত্রে, বর্ণে বহুজাতির আবাসভূমি এই উপমহাদেশে যাদের আচার-ব্যবহার, জীবন-প্রণালী, ধর্মকর্ম, চিন্তাধারা, আঞ্চলিক, চাহিদা, ইতিহাস এবং উন্নয়নেও বৈপরীত্য এত প্রকট যে, এককেন্দ্রীয় শাসন এই বিশাল ভূখন্ডের বহুধাবিভক্ত জনসমষ্টির কল্যাণের সহায়ক নয়। পরাধীন ভারতবাসীকে ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের সুবিধার্থে মানচিত্রে ভারতবর্ষ হিসেবে একটি দেশের পরিচয় দিলেও ব্রিটিশরা আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত সমগ্র অঞ্চলকে একই প্রকার শাসন ব্যবস্থার অধীনে আনতে পারেনি। তাদের ব্যবস্থাধীনে ১১টি গভর্নর শাসিত প্রদেশ, ৫৫৬টি দেশীয় করদমিত্র রাজ্য এবং চীফ কমিশনার শাসিত ব্যাপক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ ভরতবর্ষ। প্রাদেশিক গভর্নররা গর্ভনর জেনারেলের নির্দেশে শাসন করতেন। দেশীয় রাজ্যসমূহের শাসকদের ব্রিটিশ সরকারকে শুধু কর দিতে হতো, সৈন্যবাহিনী রাখা বা পররাষ্ট্র বিষয়ে তাদের কোন প্রকার স্বাধীনতা ছিল না, কিন্তু আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে উক্ত রাজ্যসমূহ দেশীয় শাকদের স্বেচ্ছাধীনে শাসিত হতো। চীফ কমিশনার শাসিত অনুন্নত অঞ্চলসমূহ বা পার্বত্য অঞ্চলসমূহ চীফ কমিশনারের জধমঁষধঃরড়হ দ্বারা বা গভর্নর জেনারেলের অমবহঃ দ্বারা ভিন্ন ব্যবস্থাধীনে ভিন্ন প্রকারে ভিন্ন আইনে শাসিত হতো। কাজের একক কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট এই বিচিত্র উপমহাদেশের উপযোগী নয়- চরম বাস্তবতার এই পরম স্বীকৃতিই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক পটভূমি।
এদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হওয়ার পরও ইংরেজ শাসন ও ইংরেজ ভাষা ভারতীয় মুসলমানরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশত বৎসরের স্বকীয় ঐতিহ্যকে রাজনৈতিক পরিবর্তনৈর জন্য বিসর্জন দেয়া মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভারতের সংখ্যাশুরু হিন্দু সম্প্রদায় গোড়ার দিকেই ইংরেজ শিক্ষাকে গ্রহণ করে। ফলে ইংরেজ শিক্ষার নব্য শিক্ষিত তরুণ হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমের দেয়া উপমহারের প্রায় ষোল আনাই দখল করে ফেলে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। একশত বৎসরব্যাপী এই অনগ্রসরতা মুসলমানদের রূপান্তরিক করে এক সর্বহারা অধিকারবিহীন বঞ্চিত সম্প্রদায়ে।
এদেশে ইংরেজ শাসনের পত্তন হয় ব্রিটিশ বণিক সঙ্ঘ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। কাজেই এই বণিকদের অধিক মুনাফা লাভ ও শোষণই ছিল শাসনের আসল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে তারা এদেশের এদেশে প্রচলিত সামাজিত ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে নতুন শহর ভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলে। এদেশে গ্রামীণ শিল্পকে ধ্বংস করে নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগের পথ সুগম করার জন্য বণিকরা শহরে কারখানা বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এ প্রক্রিয়ার নিছক স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে কোম্পানি আমলে ভারতে অনুগ্রহ ভিখারী এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি করে। এদেশের মাটি থেকে এদেশের সামাজিক ও আর্থিক কল্যান সৃষ্টি থেকে এ শ্রেণীর জন্ম হয়নি। ব্রিটিশরা এ শ্রেণীর বিকাশের সহয়তা করেছিল তাদের তাবেদার অনুকারী হওয়ার বীজমন্ত্র দিয়ে, নতুন ও মহৎ মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে নয়।
ব্রিটিশ শিক্ষানীতির ফলে যে মুষ্টিমের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হলো, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরিতে ও কাউন্সিলে ব্যক্তিগত পদ মর্যাদায় টিকে থাকা, জনশিক্ষার প্রসার বা দেশের মানুষের সার্বিক আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন নয়। কাজেই মুসলমানদের ইংরেজ শিক্ষা বর্জনের ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি চাকুরে, ডাক্তার, উকিল, ইংরেজ বণিকদের এজেন্ট, গোমস্তা, মুৎসদ্দি বা দেওয়ার রূপের যে সৌভাগ্যবান শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তারা হিন্দু ধর্মানুসারী বাবু সম্প্রদায়। পক্ষান্তরে পলাশীর পর অর্ধ শতকের মধ্যে বাংলার তুলা ও রেশন বস্ত্র শিল্প এবং অন্যান্য কুটির শিল্প একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেদের শিক্ষা-বাণিজ্য লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বিদেশীয় মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লো পরনের বস্ত্র ও প্রাত্যহিক আবশ্যকীয় দ্রাব্যাদির জন্য। এদেশের কাঁচামাল তুলা ইত্যাদি বিলেতে বহন করে তা দিয়ে তৈরি পণ্য এদেশে আমদানি করে কোম্পানি দ্বিমুখী মুনাফা লুটে। ইংলন্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে আর এদেশ পুরোপুরি কৃষিজীবি দেশে পরিণত হয়।
অন্যদিকে ইংরেজদের প্রচলিত ভূমি ব্যসস্থার বিবর্তন ও পরিবর্তনের ফলে এদেশের কৃষি অর্থনেতিক কাঠামো ধসে পড়ে। যদৃচ্ছা তালুক বিলি, জমিদার সৃষ্টি, দশশালা-পাঁচশালা-একশালা বন্দোবস্ত, সূযাস্ত আইন এবং পরিবেশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যমেই ইংরেজ তার রাজস্ব আদায়ের পন্থাকে সুনিশ্চিত করেছে সত্য, কিন্তু ভূমির সংগে সম্পর্কহীন একদল লোককে ভূমির মালিক বানিয়ে, বহু মধ্যস্বত্ব ভূম্যাধিকারীর সৃষ্টি করে এক কৃষক এবং কৃষিজীবিকে শোষণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
এখন শিল্পখাতে পথ যখন রুদ্ধ, কৃষিতে জীবন যখন বিপর্যস্ত, একমাত্র ইংরেজ সরকারের অধীন চাকরি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ছাড়া মানুষের আর কোন গত্যন্তর রইল না। কিন্তু ইংরেজ শিক্ষা ছাড়া এ পথ অনুসরণ সম্ভব ছিল না। মুসলমানরা প্রথমদিকে ইংরেজ শিক্ষা বর্জন করলেও এক শতাব্দী পরে স্যার সৈয়দ আহমেদের আলীগড় আন্দোলন এবং নওয়াব আবদুল লতিফের প্রচেষ্টার ইংরেজ শিক্ষার দিকে মনোবিকাশ করে। এবার চাকরির অন্বেষণে বের হয়ে প্রবল বাধর সম্মুখীন হয় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ১৮৬৯ সালের দূরবীন পত্রিকার এক চকরির বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়- নিচে লেখা রয়েছে যে, মুসলমনাদের কোন আবেদনপত্র গ্রহণ করা হবে না।
বাংলাদেশ সরকারের এক সার্কুলারে দেখা যায় : ““When the head
ministerial office in the department is a Hindoo, its is asserted
that he makes every offort to secure that all subordinate
officers in his department are filled by Hidoos (Circular
No. 8 of 27th January, 1986 Para -3)|। তাছাড়া ১৯০২ সালে জনৈক K. P. Ghosh বাংলাদেশ Inspector General Of Registration এর পদে নিযুক্ত হয়ে নির্দেশ দেন, যেন কোন মুসলমানকে Registration বিভাগে চাকরিতে নিযুক্ত করা না হয়। এ ধরনের অসংখ্য নজীর ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের উন্মেষ এ প্রেক্ষাপটেই উপমহাদেশে তীব্র আকার ধারণ করে। এছাড়া গো-হত্যা বন্ধ এবং মসজিদের সম্মুখে বাদ্য বাজানো নিয়েও এই বিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে ওঠে।
এ পরিস্থিতেতে ১৮৮২ সনের ৬ ফেব্রুয়ারি নওয়াব আবদুল লতিফের নেতৃত্বে কলিকাতার Cuntral National Muhammadan Association রিপনের নিকট এক স্মরকলিপি পেশ করে : The menoralists described
at length the causes which led to the gradual imperishment
of the Muslims of India under British rule. English educated
Hindu Youths, trained for the most part in missionary
institutions from which the Mussulmans stood aloof; now
poured into every Govt. office and copmletey shut out the
Mumammadans (Memorial to Maequies Ripon,. para II)
১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর মহামান্য আগা খানের নেতৃত্বে সারা ভারতের ৩৪ জুন মুসলিম নেতা বড়ালাট লর্ড মিন্টোর সংগে সাক্ষাৎ করে মুসলমানদের দৈন্যতার চিত্র তুলে ধরেন এবং স্বতন্ত্র নির্বাচিনের দাবী জানান।
ব্রিটিশ আই.সি.এস স্যার হিউম ১৮৮৫ সালে শাসন ব্যবস্থায় ভরতীয়দরে সংগে যোগসাজস রাখার জন্য নিখিল ভারত কংগ্রেস শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। প্রথমদিকে দাদাভাই নওরোজী ও গোখেলের মত অসাম্প্রদায়িক মনোভাবন্না নেতা থাকলেও পরবর্তীতে বালগংগাধর তিলক, পাঞ্জাবের লাল রাজপত রায় এবং বিপিন পাল প্রমুখ উগ্রপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতাদের আবির্ভাবে কংগ্রেস অচিরেই সংখ্যাশুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাানের পরিণত হয়। এই উগ্রপন্থীদের মতে, হিন্দু সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির মূলভিত্তি, অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনুসরারীর বহিরাগত এবং ভারতীয় সংস্কৃতির খন্ডিত অপভ্রংশ, শিবাজী ভারতীয় জাতীয় চেতনার প্রতীক, গণপতি পূজা ভারতের জাতীয় অনুষ্ঠান এবং “বন্দোমাতরম” ভারতের জাতীয় সংগীত। এই ধারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। কংগ্রেসের ভিতরে অনেক মুসলমান নেতা থাকলেও তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এই অপব্যাখ্যাকারীদের কার্যক্রম রোধ করতে পারেননি। পরিণতিতে ইংরেজ শাসনে পরিপুষ্ট, ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিত অগ্রসর এক শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক অবহেলা ও অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয় বৃহৎ ভারত ভূখন্ডের বিভিন্ন সংখ্যালঘু বহু জনগোষ্ঠী। সারা ভারতে দেখা দেয় ব্যাপক সামাজিক নৈরাজ্য ও রানৈতিক সঙ্কট।
কায়েমী স্বার্থবাদীদের এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে প্রথক প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তৎকালীন জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ, দশকোটি মুসলিম জনতা। ১৯০৬ সালে তাই স্বাধিকার আদায় ও শোষণ মুক্তির জন্য সম্মেলনে নওয়াব ভিকার-উল-মুলক সভাপতির ভাষণে বলেছিলের: ““Time and circumstance have made
it necessary for Mohomedans to
uniite in asociation so far as to make
their voice heard above the din of
other voicferous parties in India and
across the wide seas in England”
(The Pioneer, 2nd January, 1907)..
উক্ত সভায় নওয়াব সলিমুল্লাহ্ বলেছিলেন : “Now plitical movement had been
forced upon them, Had the party
now in power in England been
familiar with the position of Moslems and had Indian public
men represented jusly, Moslem claims of the movement
might perhaps not been heard of, but quite unobtrusive work
was now at a discount and only those who cried loudest had
a chence of being heard. Moslems had therfore been forced
against own wishes to abandon their traditional policy
in order to secue easement of very real disabilities and to
aviod danger that their interests might be neglected, while
other comminties in India were benefited” (The Pioneer, 2nd
January, 1907).
উপরোক্ত বক্তব্যে বুঝা যায় যে, কি পরিস্থিতির দরুন মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য বোধের উদ্রেক হয়। এরপর কংগ্রেসের ভিতর ও বাইরে শুধু সংখ্যালঘু মুসলমানদের ন্যায্য হিস্সা বা দাবী স্বীকারের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে বহু বৈঠক-অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্যাক্ট ও রিপোর্ট প্রণীত হয়্ ১৯১৬ সালের লক্ষেèৗ প্যাক্ট, পরবর্তীতে জিন্নার চৌদ্দ দফা প্রভূতিত। ভারতীয় হিন্দু-মুসলিম নেতারা যখন এ ব্যাপারে ব্যর্থ হলেন, লন্ডন থেকে পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ সম্বলিত ঝুসড়হফ ঈড়সসরংংরড়হ ভারতে আসেন। কিন্তু এই কমিশনের রিপোর্টও গ্রহণীয় হলো না। ১৯২৮ সালে পন্ডিত মাতিলাল নেহেরু মুসলমানদের সব রকম দাবী অস্বীকার করে নেহেরু রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্ট হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক চিরদিনের জন্য কবরস্থ করে।
অপর দিকে ব্রিটিশ-ভারতের ভাবী শাসনতান্ত্রিক সংশোধনীর জন্য ব্রিটিশ রাজ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য আগ্রহী ছিলেন। এটা তাদের সাম্রাজ্য টিকেয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাই হিন্দু-মুসলিম নেতারা যখন ব্যর্থ, ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সরকার তখন ১৯৩০ দশকে পর পর তিন বৎসর হিন্দু-মুসলিম নেতাদের লন্ডনে পর পর তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম নেতারা তিনটি সম্মেলনেই ঐকমত্যে পোঁছতে পারলেন না। গান্ধীর নেতৃত্ব সেদিন মুসলমানদের আনুপাতিক বাঁচার দাবী পর্যন্ত স্বীকার করতে পারেনি। শাসনতান্ত্রিক এই সঙ্কটে ১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী র্যামজে মেক ডোনাল্ড নিজে এওয়ার্ড জারী করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস করেন। এই আইনে ব্রিটিশ-ভারতে ১১টি গভর্নর শাসিত প্রদেশ সৃষ্টি হয়। পৃথক নির্বাচন প্রথা স্বীকৃত হয়। সিন্ধু, সীমান্ত অঞ্চল এবং আসমকে গভর্নরের অধীনে প্রদেশে রূপান্তরিত করা হয়। নতুন প্রদেশগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার ভিত্তিকে দুই পরিষদ বিশিষ্ট আইন সভার সমন্বয়ে স্বায়ত্ব শাসন লাভ করে।
১৯৩৫ সালের আইন বলে ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথায় তাদের অভিব্যক্তি, অভাব-অভিযোগ আইন সভায় প্রকাশের প্রথম সুযোগ লাভ করে। কিন্তু কংগ্রেস সদস্যরা প্রত্যেক প্রদেশেই সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে বঞ্চিত সম্প্রদায়কে তাদের অধিকার আদায়ে বাধা নেয়। তাই দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়- স্বাধীনতার দাবীদার কংগ্রেস মুসলিম জনগণের উপকার হবে ভয়ে বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় সেদিন প্রাথমিক শিক্ষা বিল, মহাজনী আইন বা জমিদারী উচ্ছেদ বিলের সমালোচনায়ও মুখর হয়ে ওঠে। সেকালে মুসলিম-বিদ্বেষ হিন্দুদের মধ্যে কতখানি তীব্র ছিল, তার অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির দরুন ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। নাজিম সরকার জরুরি ভিত্তিতে বিহার এবং উড়িষ্যা থেকে উদ্ধৃত্ত খাদ্যশস্য ক্রয় করার প্রস্তাব করলে ব্যবস্থাপক সভার বাঙালি হিন্দু সদস্যরা হিন্দু সদস্যরা হিন্দু অধ্যুষিত বিহার এবং উড়িষ্যায় খাদ্যভাব দেখা দেবে এই খোঁজ অজুহাত তুলে উক্ত প্রস্তাবে বাধা দেন। নাজিম সরকার জরুরি ভিত্তিকে পাঞ্জাব থেকে গম আনার সিদ্ধান্ত নেন। পাঞ্জাব সরকারও গম পাঠাতে রাজী ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় খাদ্রমন্ত্রী মহসভা পন্থী শিবনাথ শাস্ত্রী মহাযুদ্ধের অজুহাতে খাদ্য চলাচলে কর্ডন প্রথা চালু করায় পাঞ্জাব থেকে সেদিন বাংলায় খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ৫৫ লক্ষ বঙ্গ-সন্তান খাদ্যাভাবে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কংগ্রেস নেতৃত্ব যখন সাম্প্রদায়িক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় অনড়, ন্যায়ভিত্তিক সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার মেনে নিয়ে সহ-অবস্থানে কোন ফরমুলা কোনমতেই কংগ্রেসের নিকট যখন গ্রহণীয় হলো না, তখন অবশেষে ১৯৪০ সালে লাহোর মিন্টো পার্কে ২৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক সংকট সমাধান কল্পে এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব পেশ হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার প্রধান মন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।
প্রস্তাবের প্রথম অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হযয় যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পরিকল্পিত ফেডারেশন দেশের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প‚র্ণ অনুপযুক্ত ও অকার্যকর এবং মুসলমানদের পক্ষে তা একেবারেই গ্রহণযােগ্য নয়।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ঘােষণা করা হয়, যদিও ১৯৩৯ সালের ১৮ অক্টোবর তারিখে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভাইসরয় ঘোষণা করেছেন যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন যে সকল নীতির ভিত্তিতে পরিকল্পিত হয়েছে, সেগুলো আবার ভারতের বিভিন্ন দল, স্বার্থ ও স¤প্রদায়সম‚হের সহিত পরামর্শের পর পুনর্বিবেচনা করা হবে এবং যদিও এই ঘোষণাটি আশাব্যঞ্জক তথাপি মুসলিম-ভারত জানিয়ে দিচ্ছে যে, যদি সমগ্র শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা সম্প‚র্ণ নতুনভাবে পুনর্বিবেচনা না করা হয় এবং যদি তা মুসলমানদের অনুমােদন ও সম্মতি ব্যতীত তৈরি করা হয় তাহলে সেরূপ পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করবে না।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, ভৌগােলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসম‚হ অঞ্চল বা জোন হিসেবে নির্দিষ্ট করতে হবে, প্রয়োজনানুযায়ী সীমানা সুসামঞ্জস্য করে এই সকল অঞ্চল এমনভাবে নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই সকল অঞ্চলসম‚হকে স্বাধীন রাষ্ট্রসম‚হে পরিণত করা যায় এবং এই রাষ্ট্র গঠনকারী অংশসম‚হ স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম হবে। । চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়, এই সকল অঞ্চল ও অংশসমূহের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় তমুদ্দনিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও বাধ্যতাম‚লক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভারতের অন্যান্য অংশে যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ, সেখানে তাদের সংগে পরামর্শ করে, অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত কার্যকর ও বাধ্যতাম‚লক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং এটা সমর্থন করেন ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের মুসিলম নেতৃবৃন্দ।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এই প্রস্তাবে “পাকিস্তান” শব্দের কোন উল্লেখ নেই, এ শব্দটি কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। অথচ পরদিন হিন্দু সংবাদপত্রগুলাে উপহাসস্থলে এ প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু উপহাসস্থলের এই শব্দটি পরবর্তীকালে জনপ্রিয় আন্দোলনের রূপ নেয়। প্রস্তাবে কংগ্রেসের তল্পীবাহকরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ওঠে এবং সোচ্চারে বলে উঠে, “এ অসম্ভব লক্ষ্য, উন্মাদের প্রলাপ।”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন