দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নদ-নদীতে জাটকা আহরনে আট মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে রবিবার মধ্য রাতে। গত ১ নভেম্বর থেকে ৩০জুন পর্যন্ত সময়কালে দেশের অভ্যন্তরীন ও উপকূলীয় জলাশয়ে ইলিশপোনা-জাটকা আহরন নিষদ্ধকালীন সময়ে জেলা প্রশাসন সহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জাটকা আহরন বন্ধে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়। ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর। এছাড়া গত আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পড়ের ২২ দিন উপক’লের সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার ইলিশ প্রজনন এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরন নিষিদ্ধ সহ সারা দেশে ইলিশ আহরন, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ ছিল। এর পরেই গত ১নভেম্বর থেকে ৩০জুন পর্যন্ত জাটকা আহরন,পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ ছিল।
জাটকা আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে দক্ষিণ উপকূলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় প্রায় ৫ হাজার অভিযান ছাড়াও দেড় সহশ্রাধীক মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে প্রায় ৭৫ টন জাটকা এবং ২০ টন অন্যান্য মাছ আটক করা হয়েছে। এসময়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা মূল্যের ১ কোটি ৭০ লাখ মিটার কারেন্ট জাল ছাড়াও আরো প্রায় ৩ হাজারটি অন্যান্য জাল আটক করা হয়। আইনÑশৃংখলা বাহিনীর সহায়তার গত আট মাসে মৎস্য অধিদপ্তর জাটকা আহরনের অভিযোগে সারা দেশে প্রায় ৯শ মামলা দায়ের করে। এসময় ভ্রাম্যমান আদালত ২৫ লক্ষাধীক টাকা জরিমানা আদায় সহ প্রায় সাড়ে ৮শ জেলেকে জরিমানা ও ৭শ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে। এছাড়াও প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা মূল্যের বিভিন্ন মৎস্য আহরন উপকরন আটক করে নিলামে বিক্রী করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। সারা বিশ্বের ৭৫% ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি বিগত দিনে আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও মায়ানমার সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে ইলিশ উৎপাদন হৃাস পেলেও বাংলাদেশে তা প্রতিবছর ৪Ñ৬% পর্যন্ত বাড়ছে। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যা এর আগের বছর ৪.৯৬ লাখ টন ছিল বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী। মন্ত্রীর মতে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পড়ের ২২দিন ইলিশ আহরন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীন ও উপক’লীয় জলাশয়ে ৪৭.৭৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ লাভ করায় তা উৎপাদন বৃদ্ধিতে আশাব্যাঞ্জক সহায়ক হয়েছে। মন্ত্রীর মতে চলমান ইলিশ ব্যাবস্থাপনা পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন সাড়ে ৫ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য সম্পদে এ মাছের অবদান প্রায় ১২-১৩%। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, গত দেড় দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান ’এর আওতায় ২০০৫ সালেই সর্বপ্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয় ১০ দিন। ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিনে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সাল থেকে তা ২২ দিনে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে আগের বছরের তুলনায় দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ২৫.৬৯% বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে একটি পরিপক্ক মা ইলিশ বছরে প্রায় ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরনে প্রবৃদ্ধি গোটা বিষ্ময়কর সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশের অভ্যন্তরীন ও সামুদ্রিক জলাশয় থেকে ইলিশ উৎপাদন ও সহনীয় আহরনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৮৩ লাখ টন। ৯৪-৯৫ সালে তা ২.১৩ লাখ টন ও ২০০০-০১ সালে ২.২৯ লাখ টনে উন্নীত হলেও ২০০২-০৩ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ১.৯০ লাখ টনে হ্রাস পায়। ফলে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে ঐ বছর থেকেই ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে ‘জাটকা নিধন বন্ধ’র প্রাথমিক কর্মসূচী গ্রহন করে সরকার। এর পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচীর আওতায় ইলিশ সম্পদ রক্ষায় একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় গত দেড় দশকে উৎপাদন প্রায় আড়াই গুন বৃদ্ধি পেয়ে ইতোমধ্যে তা ৫ লাখ টন অতিক্রম করেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সুপারিশের আলোকে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাসে, মার্চÑএপ্রিল মাসে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিনে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবিস্থিত পদ্মা নদীর ২০কিলোমিটার এলাকায় এবং বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটা পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার ভাষান চর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ ও নয়া ভাঙনী নদী এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার লতা নদীর ৬০কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ও জাটকার অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল।
এদিকে গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করায় এবার জেলেরা কিছুটা বিপাকে পরেছে। ফলে ১ জুলাই থেকে জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও অপতত সাগরে জাল ফেলতে পারছেনা জেলেরা। তবে মৎস অধিপ্তরের মতে, এতদিন শুধু জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বড় ফাঁসের জাল দিয়ে জেলেরা সব মাছ ধরেছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সাগর যথেষ্ঠ অশান্ত থাকে। ফলে এসময়কালে কোন মাছ ধরা নৌকা বা ও ছোট থেকে মাঝারী ট্রলার সাগরে যেতে পারেনা। উপরন্তু অভ্যন্তরীন নদ-নদীতে মৎস্য আহরনে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে জেলেদের খুব সমস্যা হবার কথা নয়।
তবে মৎস্য মন্ত্রী অবশ্য সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে ১২টি জেলার প্রায় ৪ হাজার জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে ৪০ কেজি করে চাল প্রদানের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। সে চাল এখনো কোন জেলা-উপজেলায় পৌছেনি। তবে মৎসজীবী সমিতিগুলোর মতে সাগরে ইলিশ আহরনরত তাদের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৮ হাজার। এমনকি ১ নভেম্বর থেকে জাটকা আহরন নিষিদ্ধ হলেও এবার বেকার জেলেদের কাছে খাদ্য সহায়তার চাল পৌছে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন