মানুষ মরণশীল। কেউ চিরদিন বেঁচে থাকবে না। তবু কেউ কেউ অমর হয়ে থাকবেন, চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ঠিক তেমনি একজন মানুষ সাবেক প্রেসিডেন্ট, সেনা প্রধান, জতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা, কবি আলহাজ্ব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। গত ১৪ জুলাই সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহী ওয়াইন্না ইলাইহী রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাঁর ইন্তেকালে সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, দেশের প্রখ্যাত দরবারের পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম, খতিব ও সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ও হচ্ছে গভীর শোক। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি জানিয়েছে আন্তরিক সমবেদনা। দোয়া মুনাজাত করা হয়েছে ও চলছে আল্লাহর দরবারে তাঁর মাগফিরাত কামনা করে, জান্নাত প্রাপ্তির ফরিয়াদ জানিয়েছে। এখনে আমরা তাঁর রূহ্ বা বিদেহী আত্মা না বলে বলেছি “তাঁর”। কারণ মানুষতো কেবল রূহ বা আত্মা নয়, আবার কেবল দেহ নয়। দেহ আর আত্মা- রূহ ও জিসিম উভয়ের সমন্বয়ে মানুষ। হাশরের মাঠে দেহ ও আত্মা বিশিষ্ট পূর্ণ মানুষটাই উঠবে, তার হিসাব নিকাশ হবে। বেহেশত বা দোজখে যাবে দেহ ও আত্মা বিশিষ্ট পূর্ণ মানুষটিই। আমরা এই পূর্ণ মানুষটিরই মাগফিরাত চাই, জান্নাত চাই ও তাঁর জন্য বেহেশত কামনা করি। নবী-রাসূল ছাড়া কোন মানুষই নিষ্পাপ নয়। ভাল-মন্দ, দোষ-গুণ, ছওয়াব-গুনাহ্ নিয়েই মানব জীবন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জন্য পরম ক্ষমাশীল ও দয়াবান মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাই, তিনি তাঁর গুনা-খাতা মাফ করে দিন ও জান্নাত নসিব করুন। এই কামনা, এই মোনাজাত সকলের।
৯০ বছরের দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন। সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে তিনি যেমন আরোহণ করেছেন তেমনি নির্জন কারা কক্ষেও বছরের পর বছর অন্তরীন থেকেছেন। যখন যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন তাঁকে নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বদা। ইনকিলাবের ভাষায়, বিশ্ব রাজনীতির সাফল্যের উদাহরণ এবং বাংলাদেশের রাজনীতির যাদুকর। এলাকার মানুষের কাছে তিনি কতটা আপন ছিলেন, প্রিয় ছিলেন তা বুঝা যায় জেলখানায় বন্দি থাকা অবস্থায়ও তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই দুই বার পাঁচ পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইন্তেকালের পরেও দেশের শীর্ষ পদাধিকারী থেকে সাধারণ মানুষের অনুভূতির প্রকাশ থেকেও তা অনুধাবন করা য়ায়। সর্বস্তর থেকে এত অধিক শোক বাণী, শোক সভা, দোয়ার সভার খবর আসছে যে তা পত্রস্থ করা বা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে যা প্রকাশিত হয়েছে ও চোখের সামনে এসেছে তার মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী, এছাড়া রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিকল্প ধারার প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিএনপি’র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির কাজী জাফর, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হয়দার প্রমুখ। ধর্মীয় সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতে হিজবুল্লাহ’র আমির ছারছীনার পীর ছাহেব মাওলানা শাহ্ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ, আঞ্জুমানে আল ইসলাহ সভাপতি ফুলতলী দরবার শরীফের মাওলানা হুসাম উদ্দীন চৌধুরী, চরমোনাই’র পীর সাহেব ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম গং, মাইজভান্ডার দরবারের সাজ্জাদানশীল ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল হাসানী, নাছির নগরের ফান্দাউক দরবারের পীর মুফতী সৈয়দ ছালেহ্ আহমদ মামুন, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মুফতী শাহ্ মোহাম্মদ হাফিজ গং, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন গং, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্টের চেয়ারম্যান আল্লামা এম এ মান্নান গং। বোয়ালখালী আহলা দরবারের মাওলানা মো. গিয়াস। এছাড়া আরো বহু রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি সংগঠন ব্যক্তির মধ্যে কৃষক শ্রমিকলীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকী, ইঞ্জিনিয়ারস্ ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর গং, জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইনসাব, বিএনএ, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামল, পরিকল্পনা বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ ভ‚খন্ডের গণমানুষের বোধ-বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনাচরণ, কৃষ্টি-কালচার, আশা-আকাক্সক্ষা, সমস্যা-সংকট হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি। তার বিভিন্ন পরিকল্পনা, উদ্যোগ, আয়োজন, কর্মপন্থা, লিখনি, বক্তৃতা, বিবিৃতিতে তা ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বহু সম্মেলন-মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে তিনি শুভাগমন করেছেন, প্রাণখুলে ভাষণ দিয়েছেন, প্রখ্যাত পীর মাশায়েখদের দরবারে তিনি গিয়েছেন। তাঁদেরও অনেকে এস তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছেন। বিশাল ওয়াজ মাহফিলে তিনি যোগদান করে বক্তৃতা করেছেন তার অনেকগুলিতে উপস্থিত থাকার সুজোগ এই লেখকের হয়েছে। তাই এটা শুধু চিন্তা কল্পনা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। উদাহরণ স্বরূপ তার একটি এখানে উল্লেখ করছি। ঢাকার মহাখালীস্থ মসজিদে গাউছুল আজম ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত এক ওলামা মাশায়েখ সম্মেলনে তিনি যোগদান করলেন; ছারছীনার পীর সাহেব হযরত মাওলানা শাহ্ আবু জাফর ছালেহ (রহ.) ছিলেন এই সভার বিশেষ অতিথি। তিনি একপর্যায়ে পবিত্র কোরআন শরীফ ও হাদীসে নবুবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ কিতাব বোখারী শরীফÑ এ দু’খানা পবিত্র গ্রন্থ একত্রিত করে প্রেসিডেন্ট (তৎকালীন) হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হতে তুলে দিলেন এবং বললেন, আমাদের প্রিয় নবী (স.) বিদায় হজ্জের ভাষণে উম্মতদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি তোমদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেলাম যতদিন তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে থাকবে তত দিন পথভ্রষ্ট হবে না, তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ। পীর সাহেব বললেন, আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, আপনার হাতে সেই দু’টি জিনিস তুলে দিলাম। আমাদের অনুরোধ, এ দু’টি জিনিসকে পথের দিশারী করে চলবেন। এরশাদ পরম ভক্তিভরে কিতাব দুটিকে চুম্বন করলেন এবং বললেন, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো। এমনি আরো এক মহাসম্মেলনে তাঁর নিকট দাবি জানানো হলো, জুমাআর নামাজ আদায়ের সুবিধার জন্য শুক্রবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করুন। তিনি ওয়াদা করলেন, করা হবে। তিনি সে ওয়াদা রক্ষা করেছেন। কান্ড ও শেকড়হীন স্বর্ণলতা বুদ্ধিজীবীরা এ বিরুদ্ধে অনেক চেচামেচি করেছেন। তিনি সেদিকে আমল দেননি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার দাবিও উত্থাপন করা হয়েছিল। তিনি তা করার ওয়াদা করেছিলেন এবং এজন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সে ঘোষণা দিলেন। অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ করা হলো এবং সেই সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেও সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ধর্মাবলম্বিদের স্বার্থের বিষয়টিও সংবিধানে যোগ করেছেন। তখনও এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কহীন তথা বুদ্ধিজীবীরা চেচামেচি কম করেনি। চেচামেচি করেছে এ সরকারের আমলেও। কিন্তু এরশাদ যেমন তা আমলে আনেননি, তেমনি তা আমলে আনেননি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনিও শতকরা ৯২ জন ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমান আকিদা আশা-আকাক্সক্ষার সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরিচিত। তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের চাপের মুখে ২০১৬ সালে সংবিধান সংশোধনের বিষয় সংসদীয় কমিটির সঙ্গে এক বৈঠকের পর তিনি বলে দেন, তার দল (আওয়ামী লীগ) সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বাদ দিতে চায় না। গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে থাকবে এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বা ‘বিসমিল্লাহির রাহমনির রাহিম’ বাদ দিতে চায় না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজন করায় ৯২% মুসলমানের দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
মহৎপ্রাণ মানুষ এরশাদ, কোমল হৃদয়ের মানুষ এরশাদ। অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত স্বভাবের মানুষ এরশাদ। মানুষের দুঃখ ব্যথায় তিনি সমব্যথিত হয়েছেন এবং সেই দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সে দৃশ্য হয়তো এখনো অনেকের চোখের সামনে ভাসে যে, তাঁর আমলে ভারত থেকে নেমে আসা মহা প্লাবনে প্লাবিত হয়েছিল দেশের বৃহৎ অংশ। বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল অসংখ্য জনপদ। এরশাদ তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য শুধু চেষ্টাই করেননি নিজে বন্যার পানির মধ্যে নেমে হেঁটে দুস্থ দুর্গত মানুষের দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের সাহস যুগিয়েছেন। ত্রাণের সাথে সাথে নব আশার বাণী শুনিয়েছেন এই সময়ে তিনি আরো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে। আগেই তাঁর মন্ত্রিসভায় ধর্মমন্ত্রী হিসেবে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা এম এ মান্নানকে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এরশাদ জানতেন, মাওলানা এম এ মান্নান আরবদের কথ্য ভাষায় অনর্গল আরবী বলতে পারেন। সৌদি বাদশা কিং খালেদ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন নাহিয়ান , জর্দানের বাদশা হোসেনের সাথে ব্যাক্তিগতভাবে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তাঁর। বন্যা দুর্গত মানুষের প্রতি তাদের সহায়তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। এরশাদ ধর্মমন্ত্রণালয়ের সাথে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও মাওলানা এম এ মান্নানের উপর অর্পণ করলেন। মাওলানা সাহেব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, সফলভাবে সকল আনজাম দিতে লাগলেন। আসতে লগলো বিপুল ত্রাণ সামগ্রী। কিন্তু দেশ তো পানির নিচে, উপদ্রæত এলাকার অনেক স্থানেই স্থল বা নৌ-পথে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। মাওলানা সাহেব প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের কাছে চাইলেন হেলিকপ্টার, তিনি বিশালকায় সাতটি হেলিকপ্টার দিলেন। আমিরাত প্রেসিডেন্ট শেখ যায়েদের কাছে চাইলেন তার জ্বালানি ও অন্যান্য আবশ্যকীয় সামগ্রী। তাও ঢাকা এসে গেল অতি অল্প সময়ের মধ্যে। শহরে বা উঁচু জায়গায় যেখানে হেলিকপ্টার অবতরণ সম্ভব সেই জায়গায়ই হেলিকপ্টার যোগে দ্রæত পৌঁছতে লাগলো ত্রাণ সামগ্রী। আল্লাহর মেহেরবানীতে দুই মহান নেতার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দুস্থ দুর্গত আসহায় মানুষেরা পেল বাঁচার মতো সরঞ্জাম।
এবারে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষা দরদী এরশাদের কিছু কথা বলতে চাই। এ এক বিস্তৃত আখ্যান। এরশাদ চেয়েছিলে শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার শান্ত ও নির্ভর পরিবেশ তৈরি করতে। জ্ঞান ও মেধাচর্চার আবহাওয়া তৈরি করতে। শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মচারীদের আর্ত সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে। শিক্ষার মান উন্নিত করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাবেÑ এজন্য তিনি শিক্ষকদের সাথে সরাসরি আলোচনার সুযোগ করে নিয়েছিলেন স্বউদ্ভাবিত পন্থায়। কথাটা একটু খোলাসা করে বলতে গেলে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠন। তার নেতৃবৃন্দদের সাথে বৈঠক ও এরশাদের এ ফেডারশনের চেয়ারম্যানের আসন অলংকৃত করার কথা এসে যায়। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার গাদ্দাফি রাজধানীতে ত্রিপক্ষীয় এক আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনের আহŸান করেন। আহূত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও যোগদান করেন সে সম্মেলনে। তারা দেখতে পান, লিবিয়ার বিভিন্ন শিক্ষক সম্মেলন এক ছাতার নিচে জমায়েত হয়। অভিন্নভাবে শিক্ষা ও শিক্ষকদের দাবি দাওয়া তুলে ধরার এক কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের শিক্ষক প্রতিনিধিগণ এত্থেকে অনুপ্রাণিত হয়। ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষকদের একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান আহূত সম্মেলনে যোগদান করেন। তাঁকে ঘিরেই অনুরূপ শিক্ষক ফেডারেশন গড়ে তোলার আলোচনা চলে। দেশে প্রত্যাবর্তন করে মাওলানা সাহেব জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অফিসে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি, সরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতি, বেসরকারি স্কুল শিক্ষক সমিতি ও মাদরাসা শিক্ষক সমিতি যার নাম জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এই পাঁচ সংগঠনের শিক্ষক নেতাদের নিয়ে এই পাঁচ সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। নেতৃবৃন্দ বৈঠকের পর বৈঠক করে তাঁদের অভিন্ন দাবি দাওয়ার ফিরিস্তি তৈরি করেন এবং তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাথে আলোচনার জন্য যান পুরাতন সংসদ ভবনে। সেটি ছিল তখন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়। যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সাথে প্রেসিডেন্ট এরশাদ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আলাপ আলেচনা করেন। নিজেও শিক্ষা নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা ও লক্ষ্য তুলে ধরেন। এবং একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি যদি আপনাদের এই ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হই তবে কেমন হয়। আমরা বারবার বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের পথ সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করতে পারবো। প্রস্তাবটি স্বয়ং প্রেসিডেন্টের, যিনি দাবি পূরণ করবেন তাঁর নিজের। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ সানন্দে তা গ্রহণ করলেন। বললেন, এতে তো সব সহজ হয়ে যাবে, আপনি এক হাতে চাইবেন আর এক হাতে দিবেন। শুরু হলো নব যাত্রা। বাড়ল বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন। সরকারি অনুদানের পরিমাণ এবং ক্রমে দাবি উঠল, বেসকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদেরকে জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাকরণের বিষয়। বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনে সরকারি অনুদানে যে পরিমাণ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করলো তা ১৭ মাস পূর্ব থেকে কর্যকর হবে এবং হলো। বঞ্চিত শিক্ষক কর্মচারীগণ এক মাসে ১৭ মাসের টাকা পেলেন হাতে। যে অংকের টাকা একসাথে এর আগে কখনো তারা পাননি, এমনকি পাওয়ার কল্পনাও করেননি। ক্রমে বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি অনেক কিছু যোগ হতে লাগলো এর সাথে। শিক্ষক কর্মচারীগণ হাত তুলে এরশাদের জন্য দোয়া করতে লাগলেন এবং জাতীয় বেতন স্কেলভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তার বহুলাংশই পূর্ণ হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে, তিনি দরিয়া দিল মানুষ। দাবি না করেও অনেক কিছু পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীগণ। সে বর্ণনা দীর্ঘ তাই অন্য প্রসঙ্গে আসছি।
এরশাদ ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত রুচি সম্পন্ন, বিন¤্র, মধুভাষী ও সদালাপী। দেখা হলে সালাম দিলে উত্তর দিয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে দিতেন, কুশল জিজ্ঞেস করতেন, এমনকি কখনো কখনো পরিবার পরিজনেরও খোঁজ খবর নিতেন। সর্বোচ্চ পদে অধিষ্টিত এবং বিপুল ক্ষমতাধর ব্যক্তির আমার মতো নগণ্য জনকে মনে রাখায় এবং আলাপ করায় আমি মুগ্ধ ও মোহিত হয়েছি। কোনো সম্মানিত পীর মাশায়েখের সাথে কথোপকথন কালে তিনি নতশিরে থাকতেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথা বলেতেন। তারা কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে খোঁজ খবর নিতেন এবং নিজে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন। ছারছীনা পীর সাহেব হুজুর মারাত্মক অসুস্থ হলেন এবং তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হলে সেখানে তিনি তাঁকে দেখতে যান। পুরাতন এয়ারপোর্টের প্যারেডগ্রাউন্ডে তাঁর স্মৃতিচারণ ও তাঁর জন্য দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করা হলে এরশাদ যোগদান করে অত্যন্ত আবেগাপ্লুত ও বেদনা ভরাক্রান্ত কণ্ঠে তাঁর স্মৃতিচারণ করেন। জতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাঁর প্রথম জানাজায় তিনি মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ ও ঊর্ধ্বতন সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং লাশ ছারছীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বৃহদাকারের দুটি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেন। সাথে রূহুল আমীন হাওলাদার ও মোস্তফা জামাল হায়দার এ দুজন মন্ত্রীকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাঁর ৯৫/এফ বনানীর বাসায় একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। বাহাউদ্দীন ভাইসহ তার অন্যান্য ছেলে-মেয়েদেরকে সান্ত¦না দেন। সিলেটের ফুলতলী দরবার শরীফের পীর মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী (রহ.) এর সাথে অত্যন্ত আদবের সাথে আমি তাঁকে আলাপ করতে দেখেছি। আটরশি পীর সাহেব (রহ.)কে তো তিনি বলতেন বাবাজান কেবলা। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বেলায়ও তিনি অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করতেন না।
এরশাদ অসহায়, অনাথ, ইয়াতিম শিশুদের লালন পালনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন পথকলি ট্রাস্ট। কথা প্রসঙ্গে তিনি একদিন বললেন, ওরা ¯েœহবঞ্চিত, পুরুষরা ওদের সে ¯েœহ দিতে পারবে না। আমি ১৪/১৫ জন শিশু নিয়ে এক একটা গ্রæপ করে প্রতিটা গ্রæপের জন্য একেকটা মা দিব। সেই মা-ই সন্তান ¯েœহে ওদেরকে লালন পালন করবেন।
এরশাদ পল্লি উন্নয়নের কথা বেশি বেশি বলতেন। বলতেন, গুচ্ছগ্রাম করতে হবে। সেখানে শহরের সব রকম সুযোগ সুবিধা থাকবে। তাতে এক দিক থেকে যেমন চাষের ভ‚মি রক্ষা পাবে তেমনি তাদের জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রতিষ্ঠা করাও সহজতর হবে। তিনি প্রশাসনকে বিকেন্দ্রিকরণের পদক্ষেপ নিয়ে তাঁর অনেকটা বাস্তবায়িত করে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি বলতেন, রাজধানী ঢাকা জনসংখ্যার ভারে পৃষ্ঠ। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সাধারণ একটা কাজের জন্যও মানুষকে ছুটে আসতে হয় ঢাকায়। এতে একদিকে যেমন ভোগান্তি ও আর্থিক ব্যায়, অপরদিকে তেমনি রাজধানীতে সৃষ্টি হয় বাড়তি মানুষের চাপ। উন্নয়নের কাজ, মিল কারখানাও গড়ে তুলতে হবে মফস্বল এলাকায়। উপজেলা প্রতিষ্ঠার জনক তিনিই। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেও উপজেলা বহাল রেখেছে পরবর্তী সরকারগুলো।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরাতন রাস্তার সংস্কার তাঁর আর এক অসাধারণ কৃতিত্ব। সচিবালয়, বাইতুল মোকাররম থেকে সদরঘাট যেতে নওয়াবপুর রোড ছাড়া অন্য কোনো বড় রাস্তা ছিল না। এ অবস্থা বহাল থাকলে এখন কী দশা হতো তা কল্পনা করতেও গা শিওরে উঠে। রাজধানী রক্ষা বাঁধ নির্মাণের ফলে ঢাকা শহরের পশ্চিম উত্তর প্রান্ত অনেকটা বন্যার ছোবল মুক্ত। এর পুরোটা করা গেলে আরো সুফল পাওয়া যেত। এভাবে অনেক নতুন রাস্তা নির্মিত হয়েছে তার আমলে। একজন সাধারণ রিক্সাওয়ালাও এ ব্যপারে তাঁর নাম উচ্চারণ করে ভক্তি আপ্লুত কণ্ঠে পরম শ্রদ্ধাভরে।
দুনিয়ায় মানুষের শ্রেষ্ঠ ঠিকানা কবর। কবির ভাষায়- দোচিজে আদমিরা কাশাদাহ জোরে জোর/ একে আবেদানাত দিগার থাকে গোর। মানুষকে দুটি বস্তু তাঁর দিকে অত্যন্ত জোরে জোরে টানতে থাকে, একটি তার রিযক বা আহার্য দ্বিতীয়টি কবরের মাটি। এরশাদের ইন্তকালের পরে কখনো শুনেছিলাম তাঁর কবর হবে সামরিক গোরস্থানে, কখনো শুনছিলাম ঢাকায়, তবে সর্ব সাধারণের সহজ গম্য উন্মুক্ত অন্য কোনো স্থানে। তবে রংপুরবাসী এ দাবিতে অটল ছিলেন যে, ছাওয়ালের দাফন রংপুরেই চাই। রংপুর সিটিকর্পোরেশন মেয়র ও জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেছেন, আমদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ইচ্ছা অনুযায়ী রংপুরে তাঁর পল্লি নিবাসে তাঁকে দাফন করতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্যার এ বছরের মার্চে রংপুরে এসেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, আমার শরীর ভালো নেই, আমি যেকোন সময় মৃত্যু বরণ করতে পারি তোমরা আমার ডিজাইনে আমার সামধী কমপ্লেক্স করিও। আল্লাহপাক তাঁর এ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তিনি তাঁর কাক্সিক্ষত স্থান পল্লি নিবাসেই ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সমাহিত হয়েছেন।
মরেও অমর হয়ে যদি লোকে ঘোষে/ বাঁচিয়া কি ফল হয় যদি লোকে দোষে। এরশাদের সাফল্যের ঘোষণা সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে। তিনি চির স্মরণীয়। মরেও অমর। রাব্বুল আলামীন মহান আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা- আয় রাহমানুর রাহীম। তোমার বান্দা তোমারই কাছে ফিরে গেছেন, তাঁর জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মকাম মঞ্জুর কর। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন