(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
অস্পষ্ট স্বরে অনামিকা বলেছিল, চল না, তোমার বাগান থেকে ঘুরে আসি, দেখে আসিÑ তোমার বাগানে আজ কী কী ফুল ফুটেছে! মুসাফিরের পড়ার ঘরের সামনে ছিল ফুলের বাগান, এখনও আছে। বাগানটি ওর নিজে হাতে গড়া। গাছ লাগানো, আলবালে জল সেঁচনসহ সব কাজ নিজহাতে করতো মুসাফির। গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বানিয়ে রেখেছিল ইট পেতে। সেখানে বসে বসে ফুলের ঘ্রাণ নিত অনামিকা।
হা¯œাহেনার অনাঘ্রাত সুঘ্রাণে চারদিক আমোদিত হয়েছিল তখন! অনিন্দ্য চাঁদের মনহরী জোছনা বিকশিত হয়েছিল সানন্দে! বর্ষার জল বাগানের পাশে এসে কলকল ঢেউ তুলছিল!
বাগানের শেষ মাথায় গিয়ে বসে অনামিকা বলেছিল, তোমাকে একটি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারি না মুসাফির, কেমন ডর ডর লাগে!
কত কথাই তো তুমি বলে থাক, ডর আবার কীসের?
কীভাবে বলব, সেটাই বুঝি না।
যেভাবে সবসময় বলে থাকো, সেভাবেই বলো।
অল্পক্ষণ নীরবতার পর মুসাফিরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল অনামিকা। সহসা মুসাফিরের হাতে ফুলগুলো দিয়েই ত্বরিত বাগান থেকে বাড়ির দিকে ছুট লাগায় অনামিকা...
যাবার সময় অস্পষ্ট স্বরে বলে গেল, মুখ খুলে বলতে পারব না, তুমিই বুঝে নিয়ো!.
মুসাফিরের বুঝতে কিছুটা বিলম্ব হলেও, অনামিকার বিয়ে ঠিক হতে বেশি দেরি হয়নি। প্রবাসফেরত এক ধনবানের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। শৈশবের দীপ্তিময় ভালোবাসা ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে রেখেই শ্বশুরবাড়ি চলে গেল অনামিকা। এরপর আর মুসাফিরের সঙ্গে দেখা হয়নি অনামিকার।
গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় মুসাফির। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি হয় কোম্পানিতে। বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে। ছুটিতে বাড়িতে গেলেও আর অনামিকার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ কিছুই হয়ে ওঠে না।
আজ এমনো মেঘমেদুর সাঁঝের বেলায় কোত্থেকে অনামিকা এসে মুসাফিরের সামনে উদয় হয়েছে মেঘপরীর বেশে, মুসাফিরের মনের আকাশে মেঘের আয়োজন!
অনামিকার ছবি মুসাফিরের মনের আকাশে মেঘ হয়ে উড়ে বেড়ায়। আকাশের মেঘের আয়োজন হলেই, মেঘের আয়নায় ভাসে অনামিকার ছবি; আর ওই ছবি নিয়ে লিখে কতই-না কবিতা, ছোটগল্প। অনামিকাকে নিয়ে লেখা বিরহের ছন্দ কবিতা, স্ত্রীর নামে চালিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন; তাতে স্ত্রীর মনও খুশিতে নেচে ওঠে!
আজ কুমিল্লায় বেড়াতে এসে মুসাফিরের মনে বারবার উঁকি মেরে তাকাচ্ছে অনামিকার সাথে ওর ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কখন গিয়ে অনামিকার সঙ্গে দেখা করবে, ওর পাশে বসে হারানো প্রেমের পুরনো সৌরভে নিজেকে আমোদিত করবে; সেজন্য মন পাগলা হাওয়ায় উড়ছে...
বিষণœমনে হেঁটে চলার মাঝে পলেন বলে ওঠে, তোমার মুখের হাসি কোথায় গেল, এমন চুপ করে আছো কেন?
ঘুরতে ভালো লাগছে না আর, চল জাদুঘরের দিকে যাই।
মুখ ভেঙচিয়ে পলেন বলে, জাদুঘরের দিকে যাব কেন, অনামিকা অপেক্ষা করছে, তাই না?
মুসাফিরকে কথা বলতে না দেখে পলেন বলে, আজ জাদুঘরের আশপাশেও যাওয়া যাবে না, আরো বলে দিচ্ছি যে, ওই অনামিকার সঙ্গে কিছুতেই দেখা করা যাবে না, এমনকি দেখা হয়ে গেলেও কোনো কথা বলা যাবে না, এই বলে দিলাম!
বিষণœ চাহনিতে তাকিয়ে মুসাফির বলে, কেন, ওর সঙ্গে দেখা করলে কিংবা কথা বললে সমস্যা কোথায়?
কোনো সমস্যা আছে, একথা তো বলিনি; আমার কথা একটাইÑ ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে না, কথাও বলা যাবে না। যদি করতে চাও, তবে এখন এই মুহূর্তে আমি চলে যাব...
বিচিত্র বাকবচসার মধ্য দিয়ে শালবন ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাময় মুসাফির দেখতে পায়, সন্তানদের সামনে রেখে জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। ছেলেবেলায় স্কুলে যাবার সময় একসঙ্গে যাবার জন্য এভাবেই পথের পাশে দাঁড়িয়ে মুসাফিরের জন্য অপেক্ষা করতো অনামিকা। কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর পর অভিমানার্দ্র চাহনিতে তাকিয়ে অনামিকা বলতো, এই বুঝি তোমার সময় হলো, চলো, তাড়াতাড়ি চলো, ক্লাশের সময় হয়ে গেল।
ছুটির পর স্কুলের গেটেও দাঁড়িয়ে মুসাফিরের জন্য অপেক্ষা করতো অনামিকা, দুজনে পাশাপাশি হেঁটে বাড়ি ফিরে যেতো।
শালবন থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াবার আগেই গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পলেন বলে, বড্ড দেরি হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি ওঠে বসো।
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মুসাফির উদাস চাহনিতে তাকিয়ে রইলÑ জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ অনামিকার দিকে! ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে মুসাফিরের বুক ভেদ করে!
অভিভূত চাহনিতে তাকিয়ে থাকাবস্থায় পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে পলেন বলে, ওদিকে আর তাকিও না বাপু, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো, তোমার পাশেই আমি আছি।
ধাক্কা খেয়ে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আসন চেপে বসে মুসাফির; গাড়ি স্টার্ট হওয়ার শব্দটি গিয়ে মুসাফিরের হৃদযন্ত্রে সুচের মতো বিঁধে ওঠে।
গাড়ি যখন গতিমান হয়ে চলতে শুরু করে, পেছন ফিরে তাকিয়ে রইল মুসাফির...
হাতের ওপর হাত রেখে অনামিকা বলে, গাড়ি চলেছে সামনের দিকে আর তুমি তাকিয়ে আছো পেছনের দিকে; এভাবে পেছনের দিকে ফিরে যেতে চাও কেন? চোখ যেহেতু সামনের দিকে, সামনের দিকেই তাকাও...
অতি কষ্টে মুখ ফিরিয়ে আনে মুসাফির, গাড়ি কোটবাড়ি ছেড়ে বিশ্বরোড ধরে ছুট লাগায় রাজধানীর দিকে...
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন