বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোগবালাই মহান আল্লাহর পরীক্ষা

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

বিশাল এ পৃথিবীতে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিনের বিপুল অনুগ্রহ ভান্ডার শুধুই মানুষের কল্যাণের জন্য। তবে মাঝে-মধ্যে মহান আল্লাহ্র পরীক্ষা হিসেবে প্রকৃতিতে নেমে আসে বহুমুখী বিপর্যয়। সাম্প্রতিককালের ‘ডেঙ্গু’ নামের ব্যাধি ও বন্যা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মহান আল্লাহর বাণীর নিত্যতা। সুরা বাকারা ১৫৫ নম্বর আয়াতে আছে “আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, সম্পদহানী, প্রাণহানী, শস্যহানী দ্বারা...”।

বর্তমানে বর্ষার প্রভাবে দেশে চলছে বন্যার ন্যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দেশব্যাপী বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক। বিরতিহীন বৃষ্টি ও উজানের পানি লাখ লাখ মানুষকে করেছে ‘পানিবন্দি’। বন্যার্ত মানুষজন এখন দিশেহারা ও অসহায়। এমন প্রাকৃতিক বিরূপতায় অনেক মানুষের সহনমাত্রা ছাড়িয়ে দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়া, পেটেরপীড়া, চমর্রোগ, জ্বর, সর্দি-কাশি, হাপানিসহ নানান জটিল রোগশোক। অন্যদিকে ঢাকায় বন্যা না থাকলেও জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে ‘ডেঙ্গু’।

ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। মশার বংশবৃদ্ধি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ মানুষের অপকর্ম। তাই মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর কিছু নিদর্শন দেখান, যেন মানুষের বোধোদয় ঘটে। তিনি বলেন “আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আযাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই” (বনি ইসরাইল: ৫৯)।

এগুলোর পথধরেই মানুষ কিয়ামতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে সতর্ক করে প্রিয়নবী (স.) বলেন “........সে সময় তোমরা অপেক্ষা করো: রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (এসিড বৃষ্টি) ভূ-কম্পনের, ভূমিধ্বসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন) পাথর বৃষ্টির এবং সূতোছেড়া (তাসবিহ্) দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনসমূহের জন্য” (তিরমিযি)।

ডেঙ্গু বা কোনো রোগেই মু’মিন বান্দার হতাশ হওয়া উচিত নয়। কেননা, প্রিয়নবী (স.) বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ রোগ ও চিকিৎসা দু’ই পাঠিয়ে দেন..... সুতরাং চিকিৎসা গ্রহণ কর” (আবু দাউদ)। ইবনু আব্বাস (রা.) বর্ণিত ‘একদা ইব্রাহিম (আ.) জিজ্ঞেস করলেন: হে আমার প্রতিপালক রোগ কার পক্ষ থেকে? আল্লাহ্ বলেন “আমার পক্ষ থেকে”! জানতে চাইলেন ঔষধ কার পক্ষ থেকে? জবাব এলো “আমার পক্ষ থেকে” আবার জানতে চাইলেন তবে চিকিৎসক? জবাব এলো “চিকিৎসকের মাধ্যমে ঔষধ পাঠানো হয়....”।

আমাদেরকে বুঝতে হবে, আমাদের এই শরীর আমাদের নয়, এটা আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে কিছুদিনের জন্য। তাই ডেঙ্গুর ব্যাপারে হতাশার কারণ নেই, বরং মনে রাখতে হবে পবিত্র কুরআনের অভয়বাণী “আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না” (ইউসুফ: ৮৭)। মহান আল্লাহ্ কষ্ট দেওয়ার জন্য বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেননি। বরং রোগ-শোকের মাধ্যমে মু’মিন বান্দাকে পরীক্ষা করা হয়, এতে তার ঈমানিশক্তি বৃদ্ধি পায়। হাদিসে তো এ জন্যই জ্বরের মধ্যেও কল্যাণের বার্তা পাওয়া যায়। যেমন: একদা প্রিয়নবী (স.) হযরত আবু হুরাইরাকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে জ্বরের রোগী দেখতে যান। তিনি (স.) বলেন “সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহ্ বলেন, ‘আমার আগুন দুনিয়াতে আমি আমার মু’মিন বান্দার ওপর প্রবল করি, যেন তা আখিরাতের আগুনের বিনিময় হয়ে যায়’” (তিরমিযি)। ইবনু উমর (রা.) বর্ণিত অন্য এক হাদিসে আছে, প্রিয়নবী (স.) বলেন “জ্বর জাহান্নামের উত্তাপ থেকে হয়। কাজেই তাকে পানি দিয়ে নিভাও”। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলতেন ‘রাসুল (স.) আমাদের নির্দেশ করতেন, আমরা যেন পানির সাহায্যে জ্বরকে ঠাÐা করি’ (মুসলিম শরিফ)।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্লোগান প্রিভেনশন ইজবেটার দ্যান কিউর এ জন্যই যে জিনিসগুলোর কারণে মানুষের রোগ হয়, তা আগেই ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানুষের রোগ-শোকের অন্যতম কারণ অবহেলা, অপরিচ্ছন্নতা, অলসতা ইত্যাদি। এ জন্যই প্রিয়নবীর (স.) মুনাজাত “হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি”।

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এমন কাজ ইসলামে স্বীকৃত নয়। আমরা জানি, প্রিয়নবীর (স.) সুন্নাতগুলো স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক। কেউ যদি ঘুম থেকে জাগা, পানাহার, চালচলন, মলমূত্র ত্যাগসহ সবকিছু সুন্নাত অনুযায়ী সম্পাদন করেন, তবে তিনি বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। টয়লেট পেপার ব্যবহার, কাশি ও হাঁচি-হাই এর সময় নাক ঢেকে রাখা, মেসওয়াক করা, মশারি ব্যবহার, রাগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সহায়ক। তাছাড়া রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারণ অপরিচ্ছন্নতা ও নোংরা পরিবেশ, আর প্রিয়নবীর (স.) শিক্ষা বলে “পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ”। দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে মশার মাধ্যমে। তাই পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন যেমন জরুরি, তেমনি সাবধাণতার বিকল্প নেই এ কথাও সত্য। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মেনে চলতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ও জাতীয় গাইড লাইন।

ইসলাম সবসময় একটি সুস্থ-সক্ষম মানবগোষ্ঠীর ধারণা দেয়। মানুষের ‘হায়াৎ’ তথা জীবনকালের সঙ্গে ‘হিসাব’ বা জবাবদিহিতা ও ইবাদতের সঙ্গে সুস্থতার সম্পৃক্ততা সুনিবিড়। শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে নামাযের সামর্থ্য প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন “তোমরা আল্লাহ্কে স্মরণ কর, দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে” (নিসা: ১০৩)। সুস্থদেহ সুন্দর মনন ও সক্ষম মানবগোষ্ঠী বিনির্মাণে যথাযথ চিকিৎসা ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বর্তমানেও সব রোগের প্রতিকার, প্রতিরোধ সম্পর্কে আমরা সঠিক ধারণা পেতে পারি পবিত্র কুরআন থেকে। মহান আল্লাহ্ বলেন “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত” (বানি ইসরাইল: ৮২)।

সাম্প্রতিককালের বন্যা জনিত রোগ-শোকে বা ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত না হয়ে বরং বিশ্বাস রাখা জরুরি, মহান আল্লাহ্র রহমতেই রোগ থেকে আরোগ্যলাভ করা সম্ভব। রোগের কোনো ক্ষমতা নেই কাউকে আক্রান্ত করবার। মহান আল্লাহ্ চাইলেই মানুষ রোগাক্রান্ত হয়, নতুবা নয়। এজন্যই দেখা যায়, রোগীর সংস্পর্শে গেলেও অনেকে রোগাক্রান্ত হন না। প্রিয়নবী (স.) বলেন “রোগ-ব্যধি (তার নিজের শক্তিতে) একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না” (মুসলিম শরিফ)। আবার হযরত মু’আজকে (রা.) দেওয়া প্রিয়নবীর (স.) নির্দেশসমূহের অন্যতম ছিল “কোনো এলাকায় যদি মহামারীর প্রাদূর্ভাব হয়, তবু তুমি সেখানেই অবস্থান করবে (পালিয়ে যাবে না)” (আহ্মাদ)।

পরিশেষে মুনাজাত, মহান আল্লাহ্ বাংলাদেশের মানুষকে ডেঙ্গুর যন্ত্রণা ও বিস্তার থেকে উদ্ধার করুন। পবিত্র কুরআনে আছে, মহান আল্লাহ্র পরিচয় প্রসঙ্গে হযরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন “ওয়া ইযা মারিয্তু ফাহুয়া ইয়াশ্ফিন” অর্থাৎ ‘যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন’ (শু’আরা: ৮০)। অন্যদিকে মহান আল্লাহ্র শাহি দরবারে প্রিয়নবীর (স.) মুনাজাত ছিল “হে আল্লাহ্ আমি তোমার কাছে সুস্বাস্থ্য কামনা করি....” (বায়হাকি)।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন