১৫ আগস্ট একটা দুঃখজনক দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন সেদিন। তিনি ছিলেন একজন ‘মিস আন্ডারস্টুড’ নেতা। না তাঁর বন্ধুরা, না তাঁর শত্রুরা তাঁকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
তিনি একটা সামরিক ‘কু’র মাধ্যমে নিহত হলেন। আর এক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও তেমনিভাবে। জিয়ার সময়ে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে আঠার-ঊনিশবার ‘কু’ হয়েছে। পরবর্তীতে বিডিআরে ‘কু’ হলে ৫৭ জন চৌকস সামরিক অফিসার নিহত হলেন। বিশ্লেষকদের মতে, এ সবগুলোর একই উদ্দেশ্য। একটি গোষ্ঠী নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, অস্ত্রবলে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে চায়। এই ঘটনাগুলো শুধু ‘কু’ নয়- মস্ত বড় ধরনের সন্ত্রাস, যেখানে রাষ্ট্রেরই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। মজার ব্যাপার, এসব ‘কু’ই ব্যর্থ হয়েছে শেষ পর্যন্ত। যারা এগুলোর নেপথ্যে তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেনি।
১৫ আগস্ট সম্পর্কে একটা বিশ্লেষণ করেছেন মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থে। তিনি পটভ‚মিকা হিসেবে উল্লেখ করেন :
“পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন- এরকম একটা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। ...বিপ্লবী গণবাহিনীর ঢাকা নগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বেশ তৎপর হয়ে উঠে। শেখ মুজিবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষে একটা শক্তির মহড়া দেয়ার চিন্তা করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো বিক্ষোভ বা মিছিলের পরিকল্পনা করা যায়নি।”
চুয়াত্তরের নভেম্বরে বোমা বানাতে গিয়ে নিখিল নিহত হয়েছিলেন। তার নামে ওই বোমার নামকরণ হয় ‘নিখিল’। ‘নিখিলের প্রস্তুতপ্রণালী ছিল খুবই স্থূল। ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের লেকচারার। তিনি ‘নিখিল’ ইমপ্রুভাইজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শেখ মুজিবের আগমন যাতে নির্বিঘ্নে না হয়, সেজন্য আনোয়ারের নির্দেশে গণবাহিনীর সদস্যরা ১৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তিনটি ‘নিখিল’ ফাটায়। এগুলো ছিল টাইম বোমা। আনোয়ারের সরবরাহ করা এই বোমাগুলোর একটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কাছে, একটি সায়েন্স অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের চত্বরে এবং আরেকটি কার্জন হলের সামনে রেখে দিয়েছিলেন গণবাহিনীর সদস্যরা।” (পৃ, ১৭০-১৭১)।
মহিউদ্দিন ‘কু’ নেতাদের সম্পর্কে লেখেন :
“ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। পরে তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। হুদা ১৯৬৫-৬৭ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। তখন তিনি ছাত্রলীগ করতেন। ... তার কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের একজন ছিলেন আবদুল বাতেন চৌধুরী। বাতেন ছিলেন জাসদের ঢাকা নগর পার্টি ফোরামের সদস্য। হুদা বাতেনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। বাতেন স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের সদস্য এবং ১৯৭২-৭৩ সালে-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।” (পৃ, ১৭২)।
‘‘মেজর নূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সদস্য ছিলেন। পরে তিনি সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। সিরাজ শিকদারের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। ১৫ আগস্টের কয়েকদিন পর সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা বাসায় সন্ধ্যাবেলা বৈঠক করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, আকা ফজলুল হক ও মহসীন আলী। তারা নূর ও ডালিমকে ডেকে পাঠান। নূর একাই এসেছিলেন। শেখ মুজিবের পরিবারের সবাইকে হত্যা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর বলেন, ‘ওরা আমার নেতাকে খুন করেছে, আমি সবাইকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছি। নূরের উদ্ধত আচরণের এবং নৃশংসতার পরিচয় পেয়ে জিয়াউদ্দিন ক্ষুব্ধ হন।’ (পৃ-১৭৪-১৭৫)।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, “কর্নেল তাহের সম্ভবত জানতেন না, ১৫ আগস্ট তারিখটি অভ্যুত্থানের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে এরকম একটা ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। কোটি টাকার প্রশ্ন ছিল, কবে, কখন? শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল।...ছিয়াত্তরে তাহের ও অন্যদের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে তাহের উল্লেখ করেন :
‘জনগণের জন্য সঠিক পথ হবে জেগে উঠা এবং প্রতারণার দায়ে মুজিবকে উৎখাত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনগণ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে, তারাই একদিন স্বৈরাচারী মুজিবকে ধ্বংস করবে।’ (পৃ, ১৭৫-১৭৬)।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, ১৫ আগস্ট ’৭৫ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ অফিসে ঢাকা নগর গণবাহিনীর জরুরি সভায় আনোয়ার হোসেন বলেন “ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘-র মেজর হয়েছে, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না। জানো কাল ইউনিভার্সিটিতে কারা বোমা ফাটিয়েছিল? দে আর মাই বয়েজ।” (পৃ, ১৭৭)।
মহিউদ্দিন লেখেন, “লে. কর্নেল আবু তাহের গোপনে গণবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। ডালিম ও নূর তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তাহের ও ডালিমের চিন্তাধারা ছিল একইরকম। তাহের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেননি। তবে ওই দিনই তিনি অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। লে. কর্নেল আবু তাহের মেজর রশিদের অনুরোধে সকাল ৯টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রে যান।...তাহের সব সময় শেখ মুজিবের ‘ফ্যাসিবাদী’ রাজনীতির বিরোধী ছিলেন এবং তার সরকারের উৎখাত চাইতেন। জাসদও একই দাবি করেছে। কিন্তু জাসদ কখনোই দেশে সামরিক শাসন চায়নি।” (পৃ, ১৭৮)।
মহিউদ্দিন লেখেন, যে ১৫ আগস্টের দুই দিন পর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা। নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান। “তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া। ১৫ আগস্টের পর গণবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। লিফলেটের শিরোনাম ছিল, ‘খুনি মুজিব খুন হয়েছে-অত্যাচারীর পতন অনিবার্য।” (পৃ,১৭৯)।
উপরের তথ্য থেকে বোধগম্য হয় যে, বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতি খুবই অস্থির মতিসম্পন্ন। তারা জাতিয় নেতাদের একটা যুক্তিসঙ্গত সময় দিতে কার্পণ্য করেছে। তারা বুঝল না যে, যদি শেখ সাহেব জীবিত দেশে না ফিরতেন তাহলে দেশের কি অবস্থা হতো। চিত্তরঞ্জন সুতারসহ অনেকে তো অখন্ড ভারত বাস্তবায়ন করতে অনুরোধ করেন ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। বুদ্ধিমতি ইন্দিরা বলেন, “ইয়ে না মুশকিল হায়”-এটা সম্ভবপর নয়। তবে শেখ জীবিত ফেরত না আসলে তাই হতো, ‘মুসকিল হতো’ অথবা আমাদের ভাগ্য হতো সিকিম-ভুটানের মতো। আসলে ইন্ডিয়ার নিকট বাংলাদেশ তো সিকিম-ভুটানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভুটানের ডুকলাম সীমান্ত চীন-ইন্ডিয়া প্রশ্নে তাই প্রমাণ করল। বাংলাদেশের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের করিডোর ছাড়া ভারত কোনোক্রমে পূর্ব-ভারত ধরে রাখতে পারবে না।
শেখ জীবিত ফিরে আসায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ধীরে ধীরে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। শেখ স্পষ্ট করলেন যে, দেশটা মুসলিম সংখ্যাধিক্যের দেশ। তিনি ইন্ডিয়ার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ওআইসিতে গেলেন। লাহোরে গেলেন। ভুট্টো বাংলাদেশে এলেন, সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল ছড়ালেন। পাকিস্তান আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘে গিয়ে তিনি ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বললেন। চীনকে তো পরোক্ষভাবে ‘ফিলার’ দিয়েছেনই। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করলেন। এসব কিন্তু ইন্ডিয়ার পছন্দ হয়নি। তাদের পররাষ্ট্র সচিব ডিকসিট ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন যে, শেখ তাদের কথা শুনেন না। যে নেতা পাকিস্তান আন্দোলন করেও পাকিস্তানের অন্যায্য কথা শুনেন নাই, তিনি কি করে অন্যের কথা শুনবেন?
শেখের অবর্তমানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষতি হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে, কাউকে নাক গলাতে দিতেন না। কারণ তিনি ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক।
শেষে বলতে হয়, শেখ নেলসন ম্যান্ডেলার মতো উদারমনা ছিলেন। তাঁর ছিল একটা ভিশন। তাঁর ভেতর ছিল ধর্ম। তিনি মধ্যপন্থী নেতা ছিলেন, উগ্রবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তবে কেউ কেউ তাঁকে ভুল বুঝে। এটা খুবই দুঃখজনক।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন