[১৯৫২ সালের ২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় শান্তি সম্মেলন। সম্মেলনে ৩৭টি দেশের ৩৭৮ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনে অংশ নেন। তাঁর সেই প্রথম চীন সফরের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। এখানে তার অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে।]
শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত এঁকে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুইজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই, আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’
বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব। কতগুলি কমিশনে সমস্ত কনফারেন্স ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসা হলো। আমিও একটা কমিশনে সদস্য ছিলাম। আলোচনায় যোগদানও করেছিলাম। কমিশনগুলির মতামত জানিয়ে দেওয়া হলো, ড্রাফট কমিটির কাছে। প্রস্তাবগুলি ড্রাফট করে আবার সাধারণ অধিবেশনে পেশ করা হলো এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো।
মানিক ভাই কমিশনে বসতেন না বললেই চলে। তিনি বলতেন, প্রস্তাব ঠিক হয়েই আছে। কনফারেন্সের শেষ হওয়ার পর, এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিরাট জনসভায় প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিদলের নেতারা বক্তৃতা করলেন এবং সকলের এক কথা, ‘শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না’। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও যোগদান করেছিল আলাদা আলাদাভাবে শোভাযাত্রা করে। চীনে কনফুসিয়ান ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তারপর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রিস্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্ম-কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না। আমার মনে হলো, জনসভায় তাহেরা মাজহারের বক্তৃতা খুবই ভালো হয়েছিল। তিনি একমাত্র মহিলা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার পরে পাকিস্তানের ইজ্জত অনেকটা বেড়েছিল। ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সাথে কাশ্মীর নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরে একটা যুক্ত বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। তাতে ভারতের প্রতিনিধিরা স্বীকার করেছিলেন, গণভোটের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। এতে কাশ্মীর সমস্যা সমস্ত প্রতিনিধিদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছিলাম।
আমরা ভারতের প্রতিনিধিদের খাবার দাওয়াত করেছিলাম। আমাদেরও তারা দাওয়াত করেছিল। আমাদের দেশের মুসলিম লীগ সরকারের যারা এই কনফারেন্সে যোগদান করেছিল, তারা মোটেই খুশি হয় নাই। কিন্তু এই সমস্ত কনফারেন্সে যোগদান করলে দেশের মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল হয় না। পাকিস্তান নতুন দেশ, অনেকের এদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা নাই। যখন পাকিস্তানের পতাকা অন্যান্য পতাকার পাশে স্থান পায়, প্রতিনিধিরা বক্তৃতার মধ্যে পাকিস্তানের নাম বারবার বলে তখন অনেকের পাকিস্তান সম্বন্ধে আগ্রহ হয় এবং জানতে চায়। রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি। ভারতের ড. সাইফুদ্দিন কিচলু, ডাক্তার ফরিদী ও আরও অনেক বিখ্যাত নেতাদের সাথেও আলাপ হয়েছিল। আমি আর ইলিয়াস সুযোগ বুঝে একবার মাদাম সান ইয়েৎ সেনের সাথে দেখা করি এবং কিছু সময় আলাপও করি।
একটা জিনিস আমি অনুভব করেছিলাম, চীনের সরকার ও জনগণ ভারতবর্ষ বলতে পাগল। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্ব করতে তারা আগ্রহশীল, তবে ভারতবর্ষ তাদের বন্ধু, তাদের সবকিছুই ভালো। আমরাও আমাদের আলোচনার মাধ্যমে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, পাকিস্তানের জনগণ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহশীল। পিকিংয়ের মেয়র চেং পেংয়ের সাথেও ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল আমার কিছু সময়ের জন্য।
আমরা পে ইয়ং পার্ক ও স্বর্ণ মন্দির (টেম্পেল অব হেভেন) দেখতে যাই। চীন দেশের লোকেরা এই মন্দিরে পূজা দেয়, যাতে ফসল ভালো হয়। এখন আর জনগণ বিশ্বাস করে না, পূজা দিয়ে ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব। কমিউনিস্ট সরকার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে চাষিদের মধ্যে জমি বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ফলে ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। চেষ্টা করে ফসল উৎপাদন করছে, সরকার সাহায্য করছে। ফসল উৎপাদন করে এখন আর অকর্মণ্য জমিদারদের ভাগ দিতে হয় না। কৃষকরা জীবনপণ করে পরিশ্রম করছে। এক কথায় তারা বলে, আজ চীন দেশ কৃষক মজুরদের দেশ, শোষক শ্রেণী শেষ হয়ে গেছে।
এগার দিন সম্মেলন হওয়ার পরে দেশে ফিরবার সময় হয়েছে। শান্তি কমিটি আমাদের জানাল, ইচ্ছা করলে আমরা চীন দেশের যেখানে যেতে চাই বা দেখতে চাই তারা দেখাতে রাজি আছেন। খরচপাতি শান্তি কমিটি বহন করবে। আতাউর রহমান খান সাহেব ও মানিক ভাই দেশে ফিরবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। তারা বিদায় নিলেন। ইলিয়াস ও আমি আরও কয়েকটা জায়গা দেখে ফিরব ঠিক করলাম। কয়েকজন একসাথে গেলে ভালো হয়। পীর মানকী শরীফ ও পাকিস্তানের কয়েকজন নেতার সাথে আমরা দুইজনে যোগ দিলাম। ভাবলাম, আমাদের দেশের সরকারের যে মনোভাব তাতে ভবিষ্যতে আর চীন দেখার সুযোগ পাব কি না জানি না। তবে বেশি দেরি করারও উপায় নাই। বেশি দিন দেরি হলে সরকার সোজা এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যেতে পারেন। যাহোক, ইউসুফ হাসান অন্য একটা দলে যোগদান করেন, আমরা অন্যদলে ট্রেনে যাব ঠিক হলো। পিকিং থেকে বিদায় নিয়ে প্রথমে তিয়েন শিং বন্দরে এলাম। পীর সাহেবকে নিয়ে এক বিপদই হলো, তিনি ধর্ম মন্দির, প্যাগোডা আর মসজিদ, এইসব দেখতেই বেশি আগ্রহশীল। আমরা শিল্প কারখানা, কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক মিলনের জায়গা ও মিউজিয়াম দেখার জন্য ব্যস্ত। তিনি আমাদের দলের নেতা, আমাদের তার প্রোগ্রামই মানতে হয়। তবুও ফাঁকে ফাঁকে আমরা দুইজন এদিক ওদিক বেড়াতে বের হতাম। আমাদের কথাও এরা বোঝে না, এদের কথাও আমরা বুঝি না। একমাত্র উপায় হলো ইন্টারপ্রেটার।
তিয়েন শিং সামুদ্রিক বন্দর। এখানে আমরা অনেক রাশিয়ান দেখতে পাই। আমি ও ইলিয়াস বিকালে পার্কে বেড়াতে যেয়ে এক রাশিয়ান ফ্যামিলির সাথে আলাপ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু ইন্টারপ্রেটার না থাকার জন্য তা সম্ভব হলো না। মনের ইচ্ছা মনে রেখে আমাদের বিদায় নিতে হলো, ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। আমরাও তাদের ভাষা জানি না, তারাও আমাদের ভাষা জানে না। রাতে আমাদের জন্য যে খাবার বন্দোবস্ত করেছিল, সেখানে একজন ইমাম সাহেব ও কয়েকজন মুসলমানকে দাওয়াত করা হয়েছিল। মুসলমানরা ও ইমাম সাহেব জানালেন, তারা সুখে আছেন। ধর্মে-কর্মে কোনো বাধা কমিউনিস্ট সরকার দেয় না। তবে ধর্ম প্রচার করা চলে না।
দুই দিন তিয়েন শিং থেকে আমরা নানকিং রওয়ানা করলাম। গাড়ির প্রাচুর্য বেশি নাই। সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর দুই চারখানা বাস। মোটরগাড়ি খুব কম। কারণ, নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। আমার নিজের একটা অসুবিধা হয়েছিল। আমার অভ্যাস, নিজে দাড়ি কাটি। নাপিত ভাইদের বোধহয় দাড়ি কাটতে কোনোদিন পয়সা দেই নাই। ব্লেড আমার কাছে যা ছিল শেষ হয়ে গেছে। ব্লেড কিনতে গেলে শুনলাম, ব্লেড পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে ব্লেড আনার অনুমতি নাই। পিকিংয়েও চেষ্টা করেছিলাম পাই নাই। ভাবলাম, তিয়েন শিং-এ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এত বড় শিল্প এলাকা ও সামুদ্রিক বন্দর! এক দোকানে বহু পুরানা কয়েকখানা ব্লেড পেলাম, কিন্তু তাতে আর দাড়ি কাটা যাবে না। আর এগুলো কেউ কিনেও না। চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না। পুরানা আমলের ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কাটা হয়। আমার আর উপায় রইল না, শেষ পর্যন্ত হোটেলের সেলুনেই দাড়ি কাটতে হলো। এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হলো জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে! এদেশে একটা বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়। আমরাও বাধ্য হলাম চীনা সিগারেট খেতে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিল কড়া বলে, আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
নানকিং অনেক পুরানা শহর। অনেক দিন চীনের রাজধানী ছিল। এখানে সান ইয়েৎ সেনের সমাধি। আমরা প্রথমেই সেখানে যাই শ্রদ্ধা জানাতে। পীর সাহেব ফুল দিলেন, আমরা নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম এই বিপ্লবী নেতাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও চীনের মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রাজতন্ত্রকে খতম করে দুনিয়ায় চীন দেশের মর্যাদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও বুঝতে পেরেছিল চীন জাতিকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, আর শোষণও করা চলবে না।
নানকিং থেকে আমরা সাংহাই পৌঁছালাম। এটা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র। বিদেশি শক্তিগুলি বারবার একে দখল করেছে। নতুন চীন সৃষ্টির পূর্বে এই সাংহাই ছিল বিদেশি শক্তির বিলাসীদের আরাম, আয়েশ ও ফুর্তি করার শহর। হংকংয়ের মতই এর অবস্থা ছিল। নতুন চীন সরকার কঠোর হস্তে এসব দমন করেছে। সাংহাইতে অনেক শিল্প কারখানা আছে। সরকার কতগুলি শিল্প বাজেয়াপ্ত করেছে। যারা চিয়াং কাইশেকের ভক্ত ছিল, অনেকে পালিয়ে গেছে। আর কতগুলি শিল্প আছে যেগুলি বাজেয়াপ্ত করে নাই, তবে শ্রমিক ও মালিক যুক্তভাবে পরিচালনা করে। আমাদেরকে দুনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত টেক্সটাইল মিল দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটা তখন জাতীয়করণ করা হয়েছে। শ্রমিকদের থাকার জন্য অনেক নতুন নতুন দালান করা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল করা হয়েছে, চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করা হয়েছে। বিরাট এলাকা নিয়ে কলোনি গড়ে তুলেছে। আমি কিছু সময় পীর সাহেবের সাথে সাথে দেখতে লাগলাম। পরে ইলিয়াসকে বললাম, ‘এগুলো তো আমাদের দেখাবে, আমি শ্রমিকদের বাড়িতে যাব এবং দেখব তারা কী অবস্থায় থাকে। আমাদের হয়ত শুধু ভালো জিনিসই এরা দেখাবে, খারাপ জিনিস দেখাবে না।’ ইলিয়াস বলল, ‘তাহলে তো ওদের বলতে হয়।’ বললাম, ‘আগেই কথা বলো না, হঠাৎ বলব এবং সাথে সাথে এক শ্রমিকের বাড়ির ভিতরে যাব।’
পীর সাহেব তার পছন্দের অন্য কিছু দেখতে গেলেন। আমরা ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, ‘এই কলোনির যে কোনও একটা বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাই। এদের ঘরের ভিতরের অবস্থা আমরা দেখব।’ আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল। ইন্টারপ্রেটার এবং পাঁচ মিনিটের ভিতরেই এক ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে চলল। আমরা ভিতরে যেয়ে দেখলাম, এক মহিলা আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, ভিতরে নিয়ে বসতে দিলেন। দুই তিনটা চেয়ার, একটা খাট, ভালো বিছানা এই মহিলাও শ্রমিক। মাত্র এক মাস পূর্বে বিবাহ হয়েছে, স্বামী মিলে কাজ করতে গেছে। বাড়িতে একলাই আছে, স্বামী ফিরে আসলে তিনিও কাজ করতে যাবেন। তিনি বললেন, ‘খুবই দুঃখিত, আমার স্বামী বাড়িতে নাই, খবর না দিয়ে এলেন, আপনাদের আপ্যায়ন করতে পারলাম না, একটু চা খান।’ তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে আনলেন। চীনের চা দুধ চিনি ছাড়াই আমরা খেলাম। ইন্টারপ্রেটার আমাদের বললেন, ‘ভেতরে চলুন, দুইখানা কামরাই দেখে যান।’ আমরা দুইটা কামরাই দেখলাম। এতে একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ভালভাবে বাস করতে পারে। আসবাপত্রও যা আছে তাতে মধ্যবিত্ত ঘরের আসবাবপত্র বলতে পারা যায়। একটা পাকের ঘর ও একটা গোসলখানা ও পায়খানা। আবার ফিরে এসে বসলাম। ইলিয়াসকে বললাম, ‘এদের বাড়ি দেখতে এসে বিপদে পড়লাম। সামান্য কয়েকদিন পূর্বে ভদ্রমহিলার বিবাহ হয়েছে, আমাদের সাথে কিছুই নাই যে উপহার দেই। এরা মনে করবে কী? আমাদের দেশের বদনাম হবে।’ ইলিয়াস বলল, ‘কী করা যায়, আমি ভাবছি।’ হঠাৎ আমার হাতের দিকে নজর পড়ল, হাতে আংটি আছে একটা। আংটি খুলে ইন্টারপ্রেটারকে বললাম, ‘আমরা এই সামান্য উপহার ভদ্রমহিলাকে দিতে চাই। কারণ, আমার দেশের নিয়ম কোনো নতুন বিবাহ বাড়িতে গেলে বর ও কনেকে কিছু উপহার দিতে হয়।’ ভদ্রমহিলা কিছুতেই নিতে রাজি নয়, আমরা বললাম, ‘না নিলে আমরা দুঃখিত হবো। বিদেশিকে দুঃখ দিতে নাই। চীনের লোক তো অতিথিপরায়ণ শুনেছি, আর দেখছিও।’ আংটি দিয়ে বিদায় নিলাম। পীর সাহেবের কাছে হাজির হলাম এবং গল্পটি বললাম। পীর সাহেব খুব খুশি হলেন আংটি দেওয়ার জন্য।
পরের দিন সকালবেলা শ্রমিক মহিলা আর তার স্বামী কিংকং হোটেলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। হাতে ছোট্ট একটা উপহার। চীনের লিবারেশন পেন। আমি কিছুতেই নিতে চাইলাম না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে হলো। এটা নাকি তাদের দেশের নিয়ম। সাংহাইয়ের শান্তি কমিটির সদস্যরা তখন উপস্থিত ছিল।
দুই-তিন দিন সমানে চলল ঘোরাফেরা। যদিও সাংহাইয়ের সে শ্রী নাই, বিদেশিরা চলে যাওয়ার পরে। তবুও যেটুকু আছে তার মধ্যে কৃত্রিমতা নাই। ঘঁষামাজা করে রঙ লাগালে যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় তাতে সত্যিকারের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। নিজস্বতা চাপা পড়ে। এখন সাংহাইয়ের যা কিছু সবই চীনের নিজস্ব। এতে চীনের জনগণের পূর্ণ অধিকার। সমুদ্রগামী জাহাজও কয়েকখানা দেখলাম।
নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারিদিকে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে। সাংহাই থেকে আমরা হ্যাংচোতে আসলাম। হ্যাংচো পশ্চিম হ্রদের পাড়ে। একে চীনের কাশ্মীর বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ফলে ফুলে ভরা এই দেশটা। লেকের চারপাশে শহর। আমাদের নতুন হোটেলে রাখা হয়েছে, লেকের পাড়ে। ছোট ছোট নৌকায় চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে চীন দেশের লোকেরা। তারা এখানে আসে বিশ্রাম করতে। লেকের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে দ্বীপ আছে। হ্যাংচো ও ক্যান্টন দেখলে মনে হবে যেন পূর্ব বাংলা। সবুজের মেলা চারিদিকে। পীর সাহেব একদিন শুধু প্যাগোডা দেখলেন, পরের দিনও যাবেন অতি পুরাতন প্যাগোডাগুলি দেখতে। আমি ও ইলিয়াস কেটে পড়লাম। নৌকায় চড়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। দ্বীপগুলির ভিতরে সুন্দরভাবে বিশ্রাম করার ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েরা এখানে নৌকা চালায়। নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নাই। বড়, ছোট সকল অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম।
এক দ্বীপে আমরা নামলাম, সেখানে চায়ের দোকান আছে। আমরা চা খেয়ে লেকে ভ্রমণ শেষ করলাম। হ্যাংচো থেকে ক্যান্টন ফিরে এলাম। ক্যান্টন থেকে হংকং হয়ে দেশে ফিরব। এবার ক্যান্টনকে ভালভাবে দেখবার সুযোগ পেলাম। চীন দেশের লোকের মধ্যে দেখলাম নতুন চেতনা। চোখে মুখে নতুন ভাব ও নতুন আশায় ভরা। তারা আজ গর্বিত যে, তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই ক্যান্টনেই ১৯১১ সালে সান ইয়েৎ সেনের দল আক্রমণ করে। ক্যান্টন প্রদেশের লোক খুবই স্বাধীনতাপ্রিয়। আমরা চীন দেশের জনগণকে ও মাও সে তুং-এর সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতিহাস বিখ্যাত চীন দেশ থেকে বিদায় নিলাম। আবার হংকং ইংরেজ-কলোনি, কৃত্রিম সৌন্দর্য ও কৃত্রিম মানুষ, চোরাকারবারিদের আড্ডা। দুই-তিন দিন এখানে থেকে তারপর দেশের দিকে হাওয়াই জাহাজে চড়ে রওয়ানা করলাম। ঢাকায় পৌঁছালাম নতুন প্রেরণা ও নতুন উৎসাহ নিয়ে। বিদেশে না গেলে নিজের দেশকে ভালভাবে চেনা কষ্টকর।
আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে, আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে। চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সাথে। চীন সরকার নিজেকে কমিউনিস্ট সরকার বলে ঘোষণা করে নাই, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সকল কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন