বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু, যিনি জাতির জন্য জীবন দিয়ে গেছেন

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। জোট-নিরপেক্ষ (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলন। ভেন্যু, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স। উপস্থিত হন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরবের কিং ফয়সাল, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফি। এরা ছিলেন স্ব স্ব দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসকল নেতাকেই ঘাতকের নির্মম আঘাতে নিহত হতে হয়েছে।

১৯৭৫ সালে কিং ফয়সাল ঘাতকের হাতে নিহত হন। ঘাতক দূরের কেউ ছিল না। আপনজনের হাতেই তিনি নিহত হন। আনোয়ার সাদাত ছিলেন মিশরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর আনোয়ার সাদাত নিজ বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হন। সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ৪ জন সেনা অফিসার তাকে গুলি ও গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা করে। ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সেদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নন্দিত নেতা। ২০০৪ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি ছিলেন লিবীয় নেতা। তাকে লৌহমানব বলা হয়ে থাকে। তিনি পাশ্চাত্যের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে দীর্ঘ ৪২ বছর দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। তিনি শতধাবিভক্ত আরববিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালান। তার শাসনামলে লিবিয়ায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছিল। ২০১১ সালে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে তিনি নিহত হন। ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আর আজ পর্যন্ত ভারতের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী তিনিই। তিনি ভারতের চার চার বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীর হাতে তিনি নিহত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয় সামরিক অফিসারের হাতে বাংলাদেশে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও কারিগর। ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। প্রায় শতভাগ ভোট পেয়েই এ পদটি অলংকৃত করেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার নন্দিত নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছিলেন এশিয়ার অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর নামটি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক। তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনদরদি এক সংগ্রামী নেতা। তিনি তাঁর সারাটা জীবন বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যয় করেছেন। এ আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে ১৩ বছর জেল খাটতে হয়েছে। অথচ, তারই প্রাণ কেড়ে নিল ১৮টি নির্মম বুলেট। ঘাতকের নির্মম আঘাতে ছিন্নভিন্ন হলো তার সুগঠিত দেহ। শুধু তাকেই হত্যা করা হলো না। হত্যা করা হলো তার সাথে পরিবারের মোট ১৮ জন সদস্যকে। অন্যান্য বিশ্বনেতার মতো তাকেও হত্যা করল তার পাশের লোকজন। এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল কিছু বিপথগামী সেনা অফিসার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঐদিনই নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন খন্দকার মোশতাক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর ১৫ আগস্ট। সর্বমোট ৮৩ দিন এই পদে সমাসীন ছিলেন খন্দকার মোশতাক। তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী। আর দেশ স্বাধীনের পর ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী। ১৯৭৫ সালে তাকে দেয়া হয় বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। অথচ, এ মোস্তাকই কিনা বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরকে পুরস্কৃত করেছেন! তাদেরকে জাতির সূর্য সন্তান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন! পরবর্তীতে তিনি এ বিচার বন্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শাসনক্ষমতায় আসীন হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর নির্বাচিত হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে বাংলাদেশ। দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু নন্দিত এ নেতা হত্যার বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ হত্যা ও বিচারহীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কলঙ্ক লেপন শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার লড়াই।

সদ্যস্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে শুরু হয় বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি। শুরু হয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব, পদোন্নতি নিয়ে কামড়াকামড়ি ও ঠেলাঠেলি। একদিকে কর্মকর্তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার নেশা, অন্যদিকে তাদের দুর্নীতি, স্বাধীনতার মূল স্পিরিটকে ম্রিয়মাণ করে তোলে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার দূর হতে থাকে। একের পর এক খুন হতে থাকেন দেশের ক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার। খুন হন জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুর। ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে শুরু হয় হত্যা, অপসারণ এবং অবসর। চলে নির্যাতন এবং হয়রানি। এসব হত্যা এবং নির্যাতনের কোনো সুষ্ঠু বিচার দেশে আজও সম্পাদিত হয়নি। ফলে এভাবেই দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি দিনে দিনে দীর্ঘ হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা হলো। মামলাটি দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারি আ ফ ম মহিতুল ইসলাম। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল করা হলো। ১৯৯৮ সালে গঠিত আদালত ১৫ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করলেন। ২০০৯ সালে এ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৬ জন আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩৪ বছর পর বিচার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। অথচ, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় নেতা। বাঙালি জাতির জন্য এটা ছিল এক দুঃখজনক ঘটনা। মহান এ দেশনায়কের পরিবারের এতগুলো সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। কিন্তু দেশে একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। স্বাধীনতার চেতনা মলিন হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ ক্ষীণ হয়ে গেল। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং মানবতাবোধ নিষ্প্রভ হয়ে গেল। ক্ষমতায় যাওয়ার অনৈতিক নেশা যেন নেতাদেরকে মাতাল করে ফেলল। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ও দলীয় স্বার্থ তাদেরকে মোহাবিষ্ট করল। দলীয় অন্ধত্ব ও মানসিক দৈন্য তাদেরকে যেন পাগল করে তুলল। ফলে সুদীর্ঘ ৫০ বছরেও দেশে জাতীয় কোনো একটি বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হলো না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

যেকোনো খুনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে জাতীয় চেতনা ও দেশাত্মবোধ। শুধু মুখে নয় বরং কাজ এবং আচরণ দিয়ে সেটা প্রমাণ করতে হবে। স্বাধীনতার মূলনীতিকে সমুন্নত করতে হবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার ফিরিয়ে আনতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার। আর এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে রণাঙ্গনে অংশ নেয়া জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। আগামী ১৫ বছর পর হয়ত রণাঙ্গনে অংশ নেয়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা দেশে বেঁচে থাকবেন না। তাই তাদেরই জাতির কান্ডারীর দায়িত্ব নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় জাগিয়ে তুলতে হবে। অন্যায় অবিচারকে রুখে দিতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে একাত্তরের মতো ঐক্য ও সংহতি। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। দেশে সৃষ্টি হবে আরো অনেক কালো অধ্যায়। আর সে অন্ধকার থেকে জাতিকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন