শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী সংখ্যা

স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু

তোফায়েল আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি ১৯৫৭ সালে। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভোলায় গিয়েছিলেন এক জনসভায়। আমি শ্রোতা হিসেবে সভায় উপস্থিত ছিলাম। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হিসেবে সবার বক্তব্যই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যায় একজনের ভাষণ- তিনি শেষ মুজিবুর রহমান। তখন থেকেই স্বপ্ন, এই নেতার আদর্শ অনুসরণ করব। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তির পর এ সুযোগ এসেও যায়। আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়েল সায়েন্সে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তির পর আমার সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। আমি তৎকালীন ইকবাল হল ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হই। এ সময়ই পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সরাসরি দেখা ও কথা হয়। আমি ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হলে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বেড়ে যায়। তার কাছ থেকে সংগঠন গড়ে তোলার বিষয়ে নিয়মিত মূল্যবান পরামর্শ পেতে থাকি। আমরা তখনই বুঝে যাই, বাঙালি একদিন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেই। ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা’ এসব স্লোগান আমাদের সভা-সমাবেশে ধ্বনিত হতে থাকে। ‘জয় বাংলা’ আমাদের রণধ্বনি হয়ে উঠতে থাকে। মুজিব ভাইও নানা আলোচনায় বুঝিয়ে দিতে থাকেন, পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালি তার অধিকার কায়েম করতে পারবে না। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি প্রদানের পর তিনি আমাদের ছাত্রনেতাদের ডেকে বারবার বলেছেন, সাঁকো দিলাম স্বাধীনতা আদায় করে নাও। আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দেওয়ার পর আমাদের আর কোনো সংশয় ছিল যে, স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। উনসত্তরের ১১ দফা গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ের পর আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই, বাঙালির মুক্তির জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে জনগণ প্রস্তুত। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার স্থপতিকেই বেছে নিয়েছিলাম। জনগণও বুঝে গিয়েছিল, তাদের হয়ে একটি কণ্ঠ যখন উচ্চারিত হয় তখন তা গোটা জাতির স্বার্থ ধ্বনিত করে। এ কারণে সে কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে শাসকরা সদাতৎপর। এমনকি তার প্রাণনাশেও হিংস্র হায়েনার মতো। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে গোটা দেশ এমনকি বিশ্ববাসীও মেনে নিয়েছে যে, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় বন্ধু তিনিই এবং তিনি অভিনাশী। তার মৃত্যু নেই।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুক্তির পর থেকেই তিনি আমাকে তার সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। আমি তার স্নেহধন্য ছিলাম। এ ঋণ জীবন দিয়েও শোধ করা যাবে না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি দেশের সর্বত্র অসংখ্য সভা-সমাবেশ করেন। তার সঙ্গে অনেক জনসভায় অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কোনো কোনো দিন ৪০টি পর্যন্ত সভায় তিনি বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমি যদি আমার জীবন-যৌবন পাকিস্তানের কারাগারে কাটাতে পারি, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি তাহলে ৬ দফার পক্ষে একটি ভোট আপনাদের কাছে চাইতে পারি না? জনতা সমস্বরে তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাত আর তিনি স্লোগান তুলতেন, জয় বাংলা। নির্বাচনকে তিনি ৬ দফার জন্য গণভোট হিসেবে অভিহিত করতেন। পাকিস্তানের শাসকরাও জানত, ৬ দফা মানেই স্বাধীনতা। এ কর্মসূচি প্রদানের পরপরই আইয়ুব খান এবং তার সাগরেদরা বলতে থাকে, শেখ মুজিব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী।
সত্তরের নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলাকালেই ১২ নভেম্বর (১৯৭০) দক্ষিণ উপকূল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়। তিনি ত্রাণ কাজে সক্রিয় অংশ নিয়ে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আমরা হাজারে হাজারে প্রাণ দিই। এরপর যদি রক্ত দিই তবে তা দেব স্বাধিকারের জন্য। অনেক সাংবাদিক একযোগে প্রশ্ন করে ওঠেন, আপনি কি স্বাধীনতার কথা বলছেন? বঙ্গবন্ধু বলেন, এখনই নয়। কিন্তু তিনি যে এ পথেই চলেছেন সেটা সবাই বুঝে যায়। প্রকৃতপক্ষে তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা ছিল অতুলনীয় এবং এটিই স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। তিনি একবার যা বলতেন তার সঙ্গে আপস করতেন না। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণের আগে সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা নিতেন। তার সঙ্গে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, তার রাজনৈতিক অবস্থান ছিল নির্ভুল হিসাবে কষা। অঙ্কের মতো। সহকর্মীদের আস্থায় নিতে কখনও তাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখিনি। কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন তিনি করতেন এবং তাদের বিকাশের সুযোগ করে দিতেন। এ কারণেই তারা হতে পেরেছেন জাতীয় নেতা এবং তিনি জাতির পিতা। তার অবর্তমানে আন্দোলনে কোনো ভাটা না পড়ার এটিই কারণ। ৬ দফা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শত শত নেতাকর্মী কারাগারে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-থানা ও গ্রামের কর্মীদের জেলে নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেওয়ার মতো কাউকে পাওয়াই ছিল কঠিন। কিন্তু ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। একজনের শূন্য স্থান পূরণে ১০ জন এগিয়ে এসেছে। তিনি যখন আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত হন তখন ছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি। আর যখন ফিরে এলেন মুক্ত জীবনে তখন দেখলেন গোটা দেশ তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে আমি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। তিনি সুসময়ে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন, কিন্তু দুঃসময়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আমাদের সবার জন্য তিনি ছিলেন প্রেরণা। নিজের ঘরে খাবার নেই, মামলা চালানোর খরচ কীভাবে মিলবে জানা নেই, কিন্তু তিনি সাহসে অটল এবং আমাদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন।

সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতটি আসনে জয়ী হবেন। তিনি বলেছিলেন, ১৬২টি আসনের মধ্যে দুটি আসন হারালে আমি বিস্মিত হবো। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ মাত্র দুটি আসনেই পরাজিত হয়েছিল। তিনি আন্দোলন পরিচালনার পাশাপাশি শত্রুকে মোকাবেলার কৌশল নিয়েও ভাবতেন। এজন্য রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রে থাকা সবার সঙ্গে রাখতেন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পাকিস্তানের গোয়েন্দারা নির্বাচন নিয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাত। তিনি বাঙালি গোয়েন্দাদের বলতেন, আওয়ামী লীগ খুব কম আসন পাবে, এটিই বারবার বলবে। এর ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা টালবাহানা করবে না। এটি এখন সবার জানা যে, পাকিস্তানি শাসকরা সে সময় এটি ধারণাই করতে পারেনি যে, আওয়ামী লীগ একাই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। একাত্তরে বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশ, প্রশাসনের সবাই যে একযোগে জনতার কাতারে শামিল হতে পেরেছিল, সেটি তারই নেটওয়ার্কের ফল। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে করণীয় তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জনতা ও দলের সবার করণীয় নির্ধারিত ছিল। যুদ্ধের কৌশল তিনি বলে দিয়েছিলেন এবং সেভাবেই সবকিছু সম্পন্ন হয়েছিল। আমাদের নেতৃত্বের করণীয় প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কীভাবে সাহায্য-সহায়তা মিলবে, সেটিও তার কাছে স্পষ্ট ছিল। একজন মহান নেতার যা যা গুণ থাকা দরকার সবকিছুই ছিল তার মধ্যে। এ কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব এবং উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে চলার তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার। আমার কাছে স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু তাই সমার্থক।

লেখক: বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবীণ রাজনীতিবিদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন