পৃথিবীর বুকে বিধাতার আর্শীবাদে দু’একজন মহাপুরুষের আর্বিভাব ঘটে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাদের কাছে বিধাতার সেই আর্শীবাদ। ব্যক্তিত্ব, চেতনা, ধর্মসাধনা, সর্বোপরি জ্ঞান তপস্যায় তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
শিক্ষাবিদ, গবেষক, ভাষাবিদ, সাহিত্যিক, অভিধান প্রণেতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই চব্বিশ পরগনার বারাসতের নিকটবর্তী পিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্সী মফীজউদ্দীন মাতা হুরুন্নেসা।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ, সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতিতে অনার্সসহ বি,এ এবং ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্তে¡ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকারী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎ কুমারী লাহিড়ী গবেষণা সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। অবসর গ্রহণের পরপরই বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের ফারসি ভাষার খন্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষপদের দায়িত্ব পান। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তৎকালীন “পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান” প্রকল্পের সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে বাংলা একাডেমিতে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমী কর্তৃক গঠিত বাংলা পঞ্জিকার তারিখ নির্ণয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ওই কমিটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক ও যুক্তি যুক্ত ব্যবহারিক বাংলা পঞ্জিকা প্রস্তুত করে যা বর্তমানেও অনুসৃত হয়ে থাকে। চর্যাপদের পদ কর্তাদের কাল ও ভাষার বৈশিষ্ট্য নির্ণয় বিদ্যাপতির কবিতার পাঠ্যোদ্ধার, চন্ডীদাস সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে মতামত প্রদান করেছেন বলা যায় তা সর্বজন স্বীকৃত।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সারাজীবনের সাধনায় বেশ কয়েকটি ভাষাআয়ত্ত করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত¡ পড়তে এবং সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী করতে গিয়ে তিনি হিন্দি, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, সিংহলি, বৈদিক, প্রাকৃত, তিব্বতি প্রভৃতি ভারতীয় ভাষা আয়ত্ত করেন। তাঁর এরূপ ভাষা জ্ঞান ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত¡ চর্চা, ভাষার ইতিহাস রচনা, অনুবাদ কর্ম, ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির কেবল চর্চা করেই দায়িত্ব শেষ করেননি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষ্যে লেখনির মাধ্যমে ও সভা সমিতির বক্তৃতায় জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে-
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ, ইকবাল, আমাদের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যের কথা (প্রথম খন্ড), বাংলা সাহিত্যের কথা (২য় খন্ড), বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত।
ধর্ম ও সংস্কৃত গ্রন্থঃ শেষ নবীর সন্ধানে, মহরম শরীফ, ইসলাম প্রসঙ্গ, কুরআন প্রসঙ্গ, হজ্জের ও রওযা পাকের জিয়ারতের দোয়া দরুদ, রোযাহ ঈদ ও ফিতরাহ।
অনুবাদগ্রন্থঃ দীওআন-ই-হাফিজ, শিকওয়াহ, ও জওয়াব-ই-শিকওআই, রুবাইয়াত-ই-উমর খইয়ম, মহানবী, বাইআত নামা, বিদ্যাপতি শতক, অমর কাব্য কুরআন শরীফ (অনুবাদ ও ভাষাসহ প্রকাশিত), বুখারী শরীফ, ঈদুল আযহা ও কুরবানীর আহকাম।
ছোটগল্পঃ রকমারী।
শিশু সাহিত্যঃ ছোটদের ইসলাম শিক্ষা, ছোটদের দিনিয়াত শিক্ষা, চরিত্র কথা, জ্ঞানের কথা, কথা মঞ্জুরী, নীতিকথা, সিন্দাবাদ সওদাগর, ছোটদের রাসুলুল্লাহ, সেকালের রূপকথা।
সম্পাদিত গ্রন্থঃ পদ্মাবতী, গল্প সঞ্চয়ন, পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ইসলামী বিশ্বকোষ, উর্দূ অভিধান।
সম্পাদিত পত্রিকাঃ আল ইসলাম (মাসিক), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা (ত্রৈমাসিক), আঙ্গুর (শিশুদের মাসিক পত্রিকা), ঞযব চবধপব (গড়হঃযষু), বঙ্গভূমি (মাসিক), তক্বীর (পাক্ষিক)।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদ লাভ করেন। গবেষণা কর্মের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান “প্রাইড অব পরফরমেন্স” ফরাসী সরকার “নাইট অব দি ওর্ডার অব আটর্স এন্ড লেটার্স (১৯৬৭ খ্রি.)” পদকে ভূষিত করেন। এই মহান জ্ঞান তাপস দেড় বছর পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হল চত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ধর্মের প্রতি এত অটল বিশ্বাস থাকা সত্তে¡ও তাঁর মধ্যে কোন গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু ছাত্রের বিয়ে তাঁকে দাওয়াত করেছেন। ছেলের মতো স্নেহ করেন ছাত্রকে। তার মনে কষ্ট দিতে পারেন না। ব্রাহ্মন ছাত্রের বাড়িতে তাদের হাতের রান্না খেয়ে বরবধুকে সুখময় দাম্পত্য জীবনের আশীর্বাদ করে ফিরেছেন। ছাত্রের স্ত্রীকে বউমা বলে সম্বোধন করতেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন