২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের বিশাল সমাবেশ চলছিল। কেন্দ্রীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অস্থায়ী মঞ্চে উঠে সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তার ভাষণ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে একের পর এক গ্রেনেড হামলা চলতে থাকে।
ইতিহাসের বর্বরোচিত ও নৃশংস ছিল এ হামলা, যা আগে কোনো দিন কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। এ সময় দ্রুত মানবঢাল বানিয়ে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছিলেন উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মীরা। ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন, আহত হন ৪০০ জন। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বুধবার, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণা করেন রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। নারকীয় গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন আদালত। যাবজ্জীবন দন্ড দেয়া হয় তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে। এ ছাড়াও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়।
ঘটনায় হতাহত : তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতা এই গ্রেনেড হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ভয়াবহ ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হন।
মামলা দায়ের : বর্বরোচিত ও নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন ২২ আগস্ট পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করে। মামলার বাদী মতিঝিল থানা পুলিশের ওই সময়ের এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ।
অভিযোগপত্র : ঘটনার প্রায় চার বছর পর ২০০৮ সালের ৯ জুন অভিযোগপত্র (চার্জসিট) দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে এ মামলা অধিকতর তদন্তের আদেশ হয় ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট। তদন্ত শেষে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয় ২০১১ সালের ২ জুলাই।
অভিযোগ গঠন : প্রথম অভিযোগপত্রের আলোকে অভিযোগ গঠন করা হয় ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। সম্পূরক অভিযোগপত্র আমলে নেয়ার পর অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১২ সালের ১৮ মার্চ।
আসামি সংখ্যা : ওই ঘটনায় হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, ঘটনায় সহায়তাসহ বিভিন্ন অভিযোগে একটি মামলা যাতে আসামি সংখ্যা মোট ৫২ জন (ইতোমধ্যে অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় এখন আসামি ৪৯ জন)। একই ঘটনায় ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনে (সংশোধনী-২০০২) অপর একটি মামলায় আসামি সংখ্যা ৩৮জন। আসামিদের মধ্যে ৩৮ জন উভয় মামলায়ই আসামি। এর মধ্যে এখন হত্যা মামলায় ৪৯ জন ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৩৮ জন আসামি।
সাক্ষী সংখ্যা : এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ২২৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেয়। আসামিপক্ষ সাক্ষীদের জেরা করেছে। গত বছরের ৩০ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দের জেরা শেষের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অপর দিকে আসামি পক্ষ ২০ জন সাফাই সাক্ষ্য দেয়। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জেরা করেছে।
আলোচিত জজ মিয়া ‘নাটক’: ভয়াবহ এ হামলা মামলার তদন্তের একপর্যায়ে ২০০৫ সালের ৯ জুন জজ মিয়াকে আটক করা হয়। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে নেয়া হয় সেনবাগ থানায়। পরবর্তীতে সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে ফাঁস হয়ে যায় ‘জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো নাটক।’ এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন