১৮৭৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১ খ্রি.) শব্দ যন্ত্র আবিষ্কার করে নামদেন ফোনোগ্রাফ। পরবর্তীতে বার্লিনার রেকর্ড সিলিন্ডারের আকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে প্লেটের মতো সমতল রেকর্ডের প্রবর্তন করেন। ফোনোগ্রাফের ডায়াফ্রামের সাথে চোঙা লাগিয়ে স্বর বিস্তারের ব্যবস্থা ছিল বার্লিনারেরই আবিষ্কার। যা টমাস এডিসনের ফোনোগ্রাফেরই উন্নত সংস্করণ। যাকে পরবর্তীতে কলের গান নামে অভিহিত করা হয়। সে সময় থেকে ফোনোগ্রাফকে আদর করে গ্রামোফোন বা কলের গান নামে ডাকা হতে থাকে।
এফ.ডাব্লিউ গেইসবার্গ গ্রামোফোন জগতের সাথে বাংলাকে পরিচিত করেন। তিনি গ্রামোফোন কোম্পানীর প্রথম রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ১৯৯০ হতে ১৯০৭ সালের মধ্যে তিনি বহুবার ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য স্থান সফর করেন। এ শব্দ ধারণ প্রক্রিয়া চালু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত উদ্যোগে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর গোটা ভারত ভুমিতেই গ্রামোফোন রেকর্ডিয়ের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিনটিতেই গেইসবার্গ প্রথম বাঙালি শিল্পীর কন্ঠে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেন। সেই প্রথম গানটি ছিল কীর্তনের “কাঁহা জীবন ধন” কণ্ঠ দিয়েছিলেন ক্ল্যাসিক থিয়েটারের চর্তুদশী নর্তকী মিস শশী মুখী। ওই একই তারিখে দ্বিতীয় গানের রেকডিং হয় ক্ল্যাসিক থিয়েটারের আরেক নর্তকী মিস ফনী বালার কণ্ঠে। পরবর্তীতে ১০ নভেম্বরে আরও কিছু শিল্পীর গানের রেকর্ড করার সুযোগ মেলে কিন্তু এরা কেউই তখন গানের জগতের বড় শিল্পী ছিলেন না। সে সুযোগ এলো কলকাতার বাঙালি রমনী গওহর জানের কল্যাণে। রূপের ছটা আর রেওয়াজি কণ্ঠের দৌলতে গওহর জান সেকালের সৌন্দর্য পিপাসু ও সঙ্গীত রসিক মানুষের মন কেড়েছিলেন। গোটা ভারতবর্ষে তখন তাঁর নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গওহর জানই ছিল গেইস বার্গের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার নিঃসন্দেহে। ১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর গেইসবার্গ গওহর জানের কণ্ঠে গান রেকর্ড করেন। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ডে তাঁর গানগুলি ধারণ করা হয়। গওহর জান হিন্দুস্থানি ভাষায় দাদরা তালে প্রথম গানটি রেকর্ড করেছিলেন। গওহর জানের ধারণ কৃত তাঁর প্রথম বাংলা গানটি ছিল “ভালো বাসিবে বলে ভালো বাসিনে”। পরের দিন আবারও গওহর জানের কণ্ঠে গান রেকর্ড করা হয়। এই রেকর্ডই তাঁকে অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি এনে দেয়। কলকাতার সকল সংবাদ পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর ছবি ছাপা হয়। এভাবেই গোটা ভারত বর্ষে অতিশীঘ্র গ্রামোফোন রেকর্ডের এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে সে আমলে গওহর জান একজন সফল চলচ্চিত্রের নামকরা নায়িকাও ছিলেন।
১৯০২ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুই নামকরা শিল্পী হরিমতী ও সুশীলা ও গেইস বার্গের নজরে পড়েন। তাদের দিয়েই সেইস বার্গ একের পর এক থিয়েটারের বাদক দলের সমন্বয়ে এই দুই শিল্পীর গানের রেকর্ড করে নেন।
রেকডিংয়ের প্রথম পর্যায়ে গানের পুরুষ শিল্পী তেমন পাওয়া যায়নি। একমাত্র অভিজাত পরিবারের সন্তান গায়ক লালচাঁদ বড়াল ছাড়া। লালচাঁদ গ্রামোফোনের শিল্পী হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রেকর্ডের চাহিদা ছিল আকাশ চুম্বি প্রায় শিল্পী গওহর জানের কাছাকাছি। ১৯০৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এই গুণী শিল্পীর অকাল মৃত্যু হয়।
গেইস বার্গ রেকডিংয়ের জন্য মাত্র ছয় সপ্তাহ কলকাতায় অবস্থান করেছিলেন। এই সামান্য সময়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদান করেছিলেন। সাত ও দশ ইঞ্চি মিলিয়ে তিনি মোট সে সময় ৬৫২ খানা কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের রেকর্ড করেন। গেইস বার্গের শুভ সূচনায় এক দশকের মধ্যে গ্রামোফোন হয়ে উঠলো সমগ্র ভারত বর্ষের আম-জনতার জনপ্রিয় বিনোদনের সামগ্রী। এভাবেই সমগ্র ভারতবর্ষে অতিশীঘ্র গ্রামোফোন রেকডিং এক বিশাল বাজারে পরিণত হয়। ১৯০০ সালের মধ্য কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ফোনগ্রাফ যন্ত্র পৌছে যায়। ১৯০৩ সাল নাগাদ সাহিত্য সেবী “বিষাদ সিন্ধু” রচয়িতা কুষ্টিয়ার লাহিনী পাড়া গ্রামে মীর মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে ও কলের গান পৌঁছে যায়। সম্ভবত এর আগে কোনো মুসলমান ঘরে কলের গান পৌঁছানোর নির্দ্দিষ্ট কোনো তথ্য অদ্যাবধি পাওয়া যায় না।
বিংশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জনপ্রিয় বিদেশী গ্রামোফোন কোম্পানী হচ্ছে- হিজ মাষ্টারস ভয়েজ (ব্রিটিশ), কলম্বিয়া (আমেরিকা) এবং পঠে (ফ্রান্স)।
গ্রামোফোনের রেকর্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথম ভারতীয় উদ্যোক্তা হলেন হেমেন্দ্র মোহন বসু (১৮৬৪-১৯১৬ খ্রি.)। ময়মনসিংহের জয়সিদ্ধ গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করেন। হেমেন্দ্র মোহন সুগন্ধী দ্রব্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাই ১৮৯৪ সালে তিনি “বোস পারফিউমারস” বাণিজ্যিক সনদে সুগন্ধী দ্রব্য প্রস্তুত করা শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ে এতে সফলতা অর্জন করেন। শীঘ্রই তিনি তাঁর পণ্য সামগ্রীতে “কুন্তলীন কেশ তৈল” ও অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যযুক্ত করেন এবং কলকাতার ৬ নম্বর শিব নারায়ণ দাস লেনে একটি কারখানা স্থাপন করেন।
১৮৯৬ সালে হেমেন্দ্র মোহন বসু তার প্রস্তুত পণ্যদ্রব্য “কুন্তলীন কেশ তেল”- এর নামানুসারে এক সাহিত্য পুরষ্কার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল ছোট গল্প রচনা প্রতিযোগীতা। বার্ষিক এই প্রতিযোগীতায় পুরষ্কার পাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর “কর্মফল” গল্পটি লিখে পাঠান। ছদ্মনামে পাঠানো শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প “মন্দির” কুন্তলীন সাহিত্য পুরষ্কারে পেয়েছিলো। হেমেন্দ্র মোহন বসু প্রতিবছর প্রতিযোগীতার জন্য প্রাপ্ত গল্পগুলো সংকলন করে সেকালে “কুন্তলীন সাহিত্য পুরষ্কার” নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিজ্ঞাপন রচনায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচিত এমনি একটি বিজ্ঞাপন-
“কেশে মাখো কুন্তলীন
অঙ্গ বাসে দেল খোস,
পানে খাও তান্ব লীন
ধন্য হোক এইচ বোস”
পরবর্তীকালে অনেক পুরষ্কারের সঙ্গে, সে সাহিত্য পুরষ্কারই হোক বা অন্য কোনো বিষয়ই হোক, বিজ্ঞাপন পন্যের নাম সংযুক্ত হতে দেখা যায়।
সুগন্ধি ব্যবসায়ের পাশাপাশি সাইকেল কারখানা, ছাপাখানা, মোটরগাড়ি ও ক্যামেরা বিক্রি প্রভূতি নানা রকমের ব্যবসায়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। হেমেন্দ্র মোহনের পরবর্তী অর্জন গ্রামোফোন বা কলের গান রেকর্ডস। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন