॥ এক ॥
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন ছাড়া একাকী জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে সহজ নয়, তেমনটি কেউ কামনাও করে না। আবার পরিচিত সমাজের বাইরেও মানুষের পক্ষে চলা খুবই কঠিন। পৃথিবীর সমাজবদ্ধ কোনো মানুষই সামাজিক বিপর্যয় কামনা করতে পারেন না। মানুষ সব সময় সুখ ও শান্তি চায়। শান্তি মানুষের একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু এই প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষের পারষ্পারিক সম্পর্কের ওপর। উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এসব পার্থক্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যই এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা হুজরাতে ইরশাদ করেছেন, হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
সুতরাং মানব সমাজের এই পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তেই। যেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গীবত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে। তাই তো মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এই নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলেন,“তোমাদের কেউ যেন পরষ্পরের গীবত তথা পরনিন্দায় লিপ্ত না হয়। কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা তা ঘৃনাই করবে”। রাসূল স. বলেছেন- “গীবত যিনা ব্যাভিচারের চেয়েও বেশি জঘন্য ও ঘৃন্য অপকর্ম” আরেক হাদীসে রাসূল স. বলেছেন- গীবত শ্রবণকারী গীবতকারীদের পাপের ভাগীদার। আলোচ্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট রুপে প্রমাণ হয় যে, গীবত এমন এক জঘন্য অপকর্ম বা গুনাহ, যা মানুষের ঈমান ও আমোলকে ধ্বংস করে দেয়। বরবাদ করে দেয় তাদের ইহ ও পরকালকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, না জেনে না বুঝে আমরা সর্বদা এ জঘন্য অপকর্মে ভেসে চলেছি। বিশিষ্ট ও সাধারণ কেউই আমরা এ মারাত্মক রোগ থেকে মুক্ত নই। সমাজের সর্বস্তরের সকলে এ মাহামারী রোগে এমনভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন যে, এটাকে এখন আর কেউ পাপকর্ম বলেই গন্য করেন না। আমাদের অন্তর থেকে সে অনুভূতিটুকুও লোপ পেয়ে গেছে। বিবেকের ঘটেছে অপমৃত্যু। এর জন্য আমাদের নেই কোন অনুতাপ, অনুশোচনা, নেই কোন তাড়না।
গীবত কি- গীবত আরবী শব্দ, ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় গীবতের অর্থ হলো- কারো অনুপস্থিতিতে মুখে, লিখনীতে, ইশারা-ইঙ্গিতে অথবা অন্য কোনভাবে তার এমন কোন দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পেতে পারে। চাই সে মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম হোক। যদি এমন কোন দোষের কথা আলোচনা করা হয় যা আদৌ সে লোকের মধ্যে নেই, তবে সেটা গীবত নয় মিথ্যা অপবাদ। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা গীবতের চেয়েও গুরুতর অপরাধ। কেননা গীবতের সাথে সাথে এখানে মিথ্যাচারও সংমিশ্রণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এখানে রাসুল সা. এর বেশ কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করা হলো।
একবার এক মহিলা সাহাবী রাসুল সা. এর খিদমতে হাযির হলেন, তখন হযরত আয়েশা (রা.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রয়োজন শেষে উক্ত মাহিলা সেখান থেকে চলে গেলে হযরত আয়েশা (রা.) বললেন- হে আল্লাহর রাসুল সা. মহিলাটি কি বেটে আকৃতির নয়? হযরত আয়েশা (রা.) এর এ কথা শুনে রাসুল সা. খুবই মর্মাহত হলেন এবং বললেন- হে আয়েশা! তুমি গীবত করলে কেন? হযরত আয়েশা (রা.) আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন- হে আল্লাহর রাসুল সা.! আমিতো মিথ্যা কিছু বলিনি! রাসুল সা. বললেন- আয়েশা! যদিও তুমি মিথ্যা কিছু বলোনি কিন্তু তুমি উক্ত মহিলার অনুপস্থিতিতে তার দৈহিক ত্রুটি বর্ণনা করেছো, এটাই গীবত।
হযরত ইব্রাহীম তাবিঈ (রহ.) বলেন- “যদি তুমি কারো প্রকৃত দোষ আলোচনা কর, তবে তুমি তার গীবত করলে আর বলা দোষটি যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে তুমি অপবাদ দিলে।”(ইমাম মুহাম্মদ, কিতাবুল আছার)
রাসুল সা. একদিন উপস্থিত সাহাবা (রা.) দেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবা (রা.) গন বললেন- আল্লাহ ও তার রাসুল সা.-ই ভাল জানেন। রাসুল সা. বললেন- তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার এমন কোন দোষ আলোচনা করা যা শুনতে সে অপছন্দ করবে।” সাহাবা (রা.) গন আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! সে দোষটি যদি সত্যি তার মাঝে থেকে থাকে তবুও কি তা গীবত হবে? তিনি বললেন, যদি তুমি তার এমন দোষের কথা আলেচনা কর যা তার মধ্যে নেই তবে সেটাতো গীবত নয়, তোহমত বা মিথ্যা অপবাদ।
গীবতের হুকুম- গীবত অকাট্যভাবেই হারাম। পবিত্র কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে তা চূড়ান্তরূপে প্রমাণিত। এটা অস্বীকারকারী কাফের হিসেবে গণ্য হবে। কেউ যদি বলে, গীবত করা হালাল, সে কাফের হয়ে যাবে। এবং সরল সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।
গীবতকে গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করার কারণ- বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে গীবত এবং পরনিন্দাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করে একথা বুঝানো হয়েছে যে, কোন মৃত লোকের গলিত ও দুর্গন্ধময় লাশ থেকে গোশত কেটে এনে খাওয়াটা যেমন অত্যন্ত ঘৃন্য মনে হয়, তেমনি কারো গীবতে লিপ্ত হওয়াকেও তোমাদের ঘৃনা করা উচিৎ। কেননা কারো দেহ থেকে গোশত কেটে খাওয়াটা যেমন নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকতার ব্যাপার, তেমনি কারো গীবত বা দোষ বর্ণনা করাও এক পৈশাচিক ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক।
হযরত কাতাদা রা. বলেছেন, মানুষ তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে যেমন ঘৃণা বোধ করে গীবত তথা পরচর্চার বেলায়ও তার তেমনি ঘৃণা বোধ করা উচিৎ।
গীবত শুনার গুনাহ- গীবত করা যেমন গর্হিত ও কদর্য অপকর্ম তেমনি গীবত শুনা এবং তাতে বাধা না দেয়া, কোন মুসলমানের অসম্মানে আনন্দিত হওয়া খুবই গর্হিত ও কদর্য প্রকৃতির পাপ। হযরত ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেছেন, “রাসূল স. আমাদেরকে গীবত করা এবং গীবত শ্রবণ থেকে বারণ করেছেন”।(সীরাতে আহমাদিয়া)
কখনো কারো গীবত শুনে ফেললে কর্তব্য হচ্ছে- ১.যার গীবত করা হয়েছে তার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ না করা। ২. সে লোক সম্পর্কে যে সব দোষ বলা হয়েছে তা বিশ্বাস না করা। কেননা গীবত একটি জঘন্য পাপ। গীবতকারী কখনও বিশ্বস্ত হতে পারেনা। অতএব তার এসব তথাকথিত দোষ তুমি অপরকে বলে বেড়িওনা। হযরত ঈসা (আ.) একবার নিজ হাওয়ারীদেরকে বললেন, ঘুমন্ত অবস্থায় যদি কারো ছতর সামান্য একটু খুলে গিয়ে থাকে, তোমরা তখন কি করবে? তার ছতর ঢেকে দিবে নাকি তাকে আরো উলঙ্গ করে দিবে? সকলে উত্তর দিল; না, বরং আমরা তার ছতর ঢেকে দিব। তখন হযরত ঈসা (আ.) বললেন, তাহলে যখন কোন মানুষের দোষত্রুটি আলোচনা করা হয়, তখন তোমরা কেন তার দোষ গোপন করার পরবর্তে নিজেরাই সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে পড়? ৩. যখন কোন মজলিসে কারো গীবত শুরু হয়, তখন মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে, সে লোকের প্রশংসা বর্ণনা শুরু করে দেয়া। অন্যথায় হাশরের দিন গীবত শুনার অপরাধে শ্রবণকারীকেও গ্রেফতার হতে হবে।
হযরত ইবনুল মুবারক (রহ.) এর মাজলিসে একলোক হযরত আবু হানিফা (রহ.) এর গীবত করা শুরু করলেন। হযরত ইবনুল মুবারক (রহ.) তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, হযরত আবু হানিফা (রহ.) এর গীবত করছো? অথচ আল্লাহ তায়ালার নিকটে তার শান ও মর্যাদা ছিলো অনেক অনেক গুণে বেশী। (আদ দুররুল মুখতার কিতাবের হাশিয়া) হযরত ইমাম গাযালী (রহ.) বলেছেন- “গীবত শুনে তাতে বাধা না দিয়ে যে নিরব থাকবে, সে গীবতকারীর মতই পাপের ভাগীদার হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন