॥ শেষ ॥
গীবতের ভয়াবহ পরিনতি- প্রকৃত পক্ষে গীবত শুধু নিজের জন্য অকল্যাণ ও ধ্বংসই বয়ে আনে। যার গীবত করা হয় তার জন্য বয়ে আনে কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি। এজন্যই জনৈক বুজুর্গ বলেছেন- তোমার মনে যদি করো গীবত তথা দোষ আলোচনার এতই সাধ জাগে, তবে নিজের মায়ের গীবত করাই উত্তম। কেননা এতে মায়ের কল্যাণ হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে লোক পৃথিবীতে মানুষের গীবত বা দোষ বর্ণনায় লিপ্ত থাকবে, হাশরের ময়দানে তার সামনে যার গীবত করা হয়েছে তার মরদেহ উপস্থিত করে বলা হবে- যেহেতু পৃথিবীতে বসে তুমি এ লোকের গোশত খেয়েছ, তাই আজ মৃত অবস্থায়ও তোমাকে এর গোশত খেতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে সে দাঁত দিয়ে কামড়ে তার গোশত খাবে এবং ঘৃনায় চেহারা বিকৃত করে ফেলবে। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) দের কাছে পবিত্র মেরাজের ঘটনা আলোচনা প্রসঙ্গে রাসুল সা. বলেছেন, আমি একদল এমন লোক দেখলাম যাদের দেহ থেকে গোশত কেটে কেটে তাদের মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে আর বলা হচ্ছে- দুনিয়াতে তোমরা অপরের গোশত খেয়েছ এখন নিজেদের গোশত খাও। আমি জিব্রাইল (আ.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে জিব্রাইল! এরা কারা? কেন এদের এরুপ কঠিন শাস্তি হচ্ছে? তিনি বললেন, এরা পৃথিবীতে মানুষের গীবত করে বেড়িয়েছে। তাই এদেরকে আজ এরুপ কঠিন শাস্তি পেতে হচ্ছে।
যাদের দোষ বর্ণনা করা যায়- গীবত নিঃসন্দেহে হারাম। তারপরও যাদের দোষ বর্ণনা করা যায় তা হচ্ছে ১. কোনো অত্যাচারীর অত্যাচারের কাহিনী প্রতিকারের আশায় বর্ণনা করা। ২. সন্তান ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে তার পিতা ও স্বামীর কাছে অভিযোগ করা। ৩. ফতোয়া গ্রহণ করার জন্য ঘটনার বিবরণ দেয়া ও প্রয়োজন ও উপযোগিতার কারণে কারো দোষ বর্ণনা করা জরুরি। ৪. আবার যাদের স্বভাব গীবত করা তাদের সম্পর্কে অন্যদের সাবধান করার জন্য তার দোষ বর্ণনা করা জায়েজ। যেমন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা এক ব্যক্তি (মাখরামা ইবনে নওফেল) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তখন তিনি বললেন, তাকে আসার অনুমতি দাও, সে গোত্রের কতই না নিকৃষ্ট লোক। অতঃপর তিনি তার সাথে প্রশস্ত চেহারায় তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেন। অতঃপর লোকটি চলে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন, অতঃপর আপনিই প্রশস্ত চেহারায় তার প্রতি তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেন। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি কখনো আমাকে অশ্লীলভাষী পেয়েছো ? নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বাধিক নিকৃষ্ট সেই লোক হবে, যাকে মানুষ তার অনিষ্টের ভয়ে ত্যাগ করেছে। (বুখারি, মুসলিম)
গীবতের কাফফারা- হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসুল সা. বলেছেন- গীবতের কাফফারা হলো এই যে, তুমি যার গীবত করেছো তার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করবে। তুমি দোয়া এভাবে করবে যে, হে আল্লাহ তুমি আমার এবং তার গুনাহ মাফ কর। (বায়হাকী)
গীবত পরিহার নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম- শেখ শাদী (রহ.) তার সুপ্রসিদ্ধ গুলিস্তা কিতাবে লিখেছেন- এক রাতে আমি আমার পিতার সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলাম। আমাদের পাশে কয়েকজন মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন। আমি বললাম এরা এমন ভাবে ঘুমিয়ে আছে, মনে হয় যেন মৃত্যু বরন করেছে। এরা যদি উঠে দুরাকাত নামাজ পড়ে নিতো তবে কতইনা উত্তম হতো। আমার পিতা আমাকে বললেন, কিন্তু তুমি তাহাজ্জুদ নামাজ না পড়ে ওদের মত ঘুমিয়ে থাকতে তবে আরও উত্তম হতো। গীবত তথা দোষ বর্ণনার গুনাহ থেকে অন্তত মুক্ত থাকতে পারতে।
গীবত পরিহরের উপায়- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) উপদেশ ছলে বলতেন- “তোমার মনে যখন কারো দোষ আলোচনার ইচ্ছা জাগে তখন নিজের মধ্যে বিদ্যমান দোষ গুলির কথা একবার স্বরন করে নিও, তুমি গীবত করা থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে।” অতএব আমাদের সকলের আবশ্যক কর্তব্য হচ্ছে, গীবত করা এবং তা শোনা থেকে পুরো মুক্ত থাকা এবং সর্বদা মহান আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করা।
উপসংহার- আমাদের সব সময় আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন অনুগ্রহ করে গীবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন। এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রে। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি ঠিক থাক, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। (তিরমিজি) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ (বুখারি)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন