সেই ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে শতাধিক বছর। কী যে ঠিক ঘটেছিল, তা নিয়েও রয়েছে নানা মতভেদ। মঙ্গলবার তুরস্কের জাতীয় দিবসে মার্কিন প্রতিনিধি সভা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাব পাশ করিয়ে ঘোষণা করল— ১৯১৫-১৬ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যাই চালিয়েছিল অটোমান তুর্কিরা, যাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৫ লাখ মানুষ। এ ঘটনায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ তুরস্ক। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘যে দেশের ইতিহাস গণহত্যা ও দাসত্বের দাগে পূর্ণ, তুরস্কের বিষয়ে কিছু বলার বা উপদেশ দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।’
বুধবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, ‘মার্কিন প্রতিনিধি সভায় এই ভোটাভুটি একেবারেই মূল্যহীন। এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তার কথায়, ‘আমাদের জাতীয় দিবসে এই ভোটাভুটি করে তুর্কিদের অসম্মান করা হল।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাসে গণহত্যা অবশ্যই নিষিদ্ধ। আমরা এই জাতীয় অভিযোগকে আমাদের জনগণের পক্ষে সবচেয়ে বড় অবমাননা বলে বিবেচনা করি।’ এরদোগান বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেসে ভোটটি রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তিনি তুরস্কের সংসদে একটি পাল্টা রেজুলেশন পাস করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কোন বিষয়ে সেই রেজুলেশন আনা হবে তা নির্দিষ্ট করে না বললেও ভাষণে তিনি আদিবাসী ও দাসদের প্রতি আমেরিকানদের অত্যাচারের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পূর্ব আনাতোলিয়া থেকে কয়েক লাখ আর্মেনীয়কে সিরিয়ার মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেয় তুরস্কের তৎকালীন অটোমান শাসকেরা। সেখানে খাবার ও পানীর সংকটে এবং রোগে ভুগে বহু মানুষ মারা যান। মার্কিন প্রস্তাবে ১৫ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও তুরস্ক সরকারের দাবি, সংখ্যাটি ৩ লাখের নীচে। আবার ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স’ নামে একটি সংগঠন তাদের রিপোর্টে বলেছে, সে দিনের ঘটনায় অন্তত ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
মার্কিন প্রতিনিধি সভা সেই ঘটনাকে শুধু ‘গণহত্যা’ উপাধি দিয়েই থেমে থাকেনি, ১০৯ বছর আগের সেই ‘অপরাধের’ দায়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারির জন্য সুপারিশ করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। ৪০৫-১১ ভোটে পাশ হয়েছে প্রস্তাবটি। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে কিছুটা এগিয়ে থাকা জো বাইডেন টুইট করেছে, ‘গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে আমরা সে ঘটনায় নিহতদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানালাম। আমাদের ঘোষণা: আর কখনও নয়।’ হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়ঙ্কর একটি ঘটনাকে আমরা স্মরণ করলাম।’ বহু আর্মেনীয় বংশোদ্ভূতের বসবাস ক্যালিফোরনিয়ায়। সেখানকার প্রতিনিধি অ্যাডাম স্কিফ বলেন, ‘১৯ বছর ধরে এই ভোটাভুটি চেয়ে আসছি আমি। আমার এলাকার হাজার হাজার আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক দশকের পর দশক ধরে চেয়ে এসেছেন, সরকার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিক।। এই গণহত্যা আমরা ভুলতে পারি না, তাকে অস্বীকার করাটা হবে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।’
এর আগে যে এই প্রস্তাব পাসের চেষ্টা হয়নি, তা নয়। বস্তুত কূটনৈতিক কারণেই এত দিন বিষয়টি নিয়ে এগোয়নি ট্রাম্প সরকার। তুরস্ককে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী দেশ হিসেবে মেনে এসেছে মার্কিন প্রশাসন। ‘ন্যাটো’-র সদস্য হিসেবেও তুরস্কের অবদান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইরাকি কুর্দদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো নিয়ে সম্প্রতি ট্রাম্প সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে তুরস্কের এরদোগান সরকার। একশো বছর ধরে আটকে থাকার পরে ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’-র মার্কিন স্বীকৃতি তারই ফলশ্রুতি বলে মনে করা হচ্ছে।
এরদোগানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগ্লু প্রস্তাবটি কুর্দিদের বিরুদ্ধে এরদোগানের পদক্ষেপের 'প্রতিশোধ’ বলে মন্তব্য করেন। সূত্র: ডেইলি মেইল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন