শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

চিঠির ভাঁজে ভাঁজে

এনাম রাজ | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:৫২ এএম

জনপ্রিয় কবি আবুল হাসানের একমাত্র কুসংস্কার কবিতার লাইন মনে পড়ে গেলো-
‘আমরা তো ভুলতে ভুলতে সব পাখিদেরও আজ
ডাক নাম ভুলতে বসেছি!’ এই কবিতাংশ পড়লেই আপনার বোধে আসবে, আমরা কতোটা বদলে গেছি। বিশ্বায়নের যুগে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে মানুষের জীবনের আচার-আচরণেও। একসময় মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের প্রধানের মাধ্যম ছিলো চিঠি। রুপকথার গল্পের মতো বাস্তব জীবনেও ছিলো সে সময়ের চিঠির বাহকগুলো। অনেক সময় এই চিঠির বাহক থাকত কবুতর, বানর, হংসসহ অনেক পোষাপ্রাণী। চিঠি লেখা হতো গাছের বাকলে, পাতায়, পশুর চামড়ায়, পাথরে খোদাই করে। তবে এই চিঠির প্রচলন কবে থেকে শুরু হয়েছে তার নির্দিষ্ট দিন-তারিখ ইতিহাসে লিপিবন্ধ নেই। মানব সভ্যতা বিকাশের আদি যুগেই চিঠির প্রচলন শুরু হয়। সেসময় শব্দ সৃষ্টি করে ভাব বিনিময় করত। আগুন জ্বেলে, ধোঁয়া সৃষ্টি করে সংকেত পাঠানো হতো। এই নানাবিধ শব্দই সময়ের সাথে সাথে চিহ্নের জন্ম দিলে সৃষ্টি হয় কিছু বর্ণ। সে বর্ণ নিয়ে ভাষা লেখ্য রূপ পেল। এর আরও বহুকাল পরে কার্ল লুন কাগজ তৈরি করলে লেখা এবং বার্তা আদান-প্রদানের বিপ্লব ঘটে। ধীরে ধীরে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে শুরু হয় মনের কথা লিপিবন্ধ করে দূর-দূরান্তে আদান-প্রদানের প্রচলন। বাংলা সাহিত্যসহ বিশ্বের সকল সাহিত্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে এই চিঠি। শুধু সাহিত্য নয় সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চিঠি রেখেছে বিশেষ অবদান। আদি কবি কালিদাসের কাব্যে বিরহী যক্ষ মেঘের মাধ্যমে অলকাপুরীতে প্রিয়তমার কাছে বার্তা প্রেরণের উল্লেখ আছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেক পত্র ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও স্বীকৃত। সেদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার রচনার একটি প্রধান অংশ চিঠি। কবির মানসলোকের অনেক রহস্য এই চিঠিপত্রের মধ্যেই প্রজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিন্নপত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলী এবং পথের প্রান্তে নামে তিন খ-ে চিঠিপত্র সম্পাদনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ‘চিঠিপত্র’ নামে বিশ্বভারতী থেকে ১৩ খ-ে রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলী প্রকাশিত হয়। যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার প্রিয় নার্গিস এবং কাজী মোতাহার হোসেনকে যে চিঠি লেখেন তা এখনও পাঠকদের ভালোলাগার প্রথম সারিতে রয়েছে। চিঠির আদান-প্রদান হয়েছে কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও তসলিমা নাসরিনের মধ্যে। যুগে যুগে এরকম অনেক লেখক সাহিত্যিকের চিঠি সমৃদ্ধ করেছে বিশ্ব সাহিত্য ভা-ারকে। সেই সাথে ইতিহাসের পাতায় দলিলের মতোও কিছু চিঠি লেখা রয়েছে।
প-িত জওহরলাল নেহেরুর আদরের কন্যা ইন্দু’র কাছে অনেক পত্র লিখেছেন। এসকল চিঠি পরবর্তীকালে সংকলিত হয়ে ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গে’ নামক বইয়ে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার পুত্রকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করে প্রধান শিক্ষকের নিকট একটি ঐতিহাসিক পত্র লিখেনÑ
‘মাননীয় মহাশয়,
আমার পুত্রকে জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি। তাকে শিখাবেন পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অনেক মূল্যবান। এও তাকে শিখাবেন কিভাবে পরাজয় মেনে নিতে হয় এবং কিভাবে বিজয় উল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দিবেন। যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য্য তাকে শিখাবেন। বইয়ের মাঝে কি রহস্য আছে তাও তাকে বুঝতে শিখাবেন। আমার পুত্রকে শিখাবেন বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। যারা নির্দয়, তাদের সে যেন ঘৃণা করতে শিখে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন। কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন সাহসী হওয়ার ধৈর্য্য। তাকে এ শিক্ষাও দিবেন নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে আর তখনই তার আস্থা থাকবে সমগ্র মানবজাতির প্রতি।
ইতি- আপনার বিশ্বস্ত আব্রাহাম লিংকন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও প্রিয়জনকে লেখা চিঠি বাংলাদেশের ও বিশ্ব ইতিহাসের জন্য বিশাল সম্পদ এবং প্রামাণ্য দলিল। এই সম্পদগুলো খুব যতœ সহকারে প্রথম আলো প্রকাশ করে ‘একাত্তরের চিঠি’ নামে।
সময়ের পরিবর্তনে সাদা খাতায় কালো অক্ষরে লেখা চিঠির আদান-প্রদানের পরিসর কমলেও চিঠির গুরুত্ব এখনো আগেই মতোই। শুধু মাধ্যম পরিবর্তন হয়েছে। এখনো সাহিত্য ক্ষেত্রের মতো পৃথিবীর সকল দেশেই জনগনের সকল দাবি চিঠির মাধ্যমেই প্রেরিত হয়। চিঠির মাধ্যমে এই আধুনিক যুগেও বর্ডার, প্রাচীর পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চিঠির মাধ্যমেই কার্য সাধিত হয়ে থাকে। তাই ইন্টারনেট, কম্পিউটারের এই তাপদাহের সময়েও বলা যায় চিঠির গুরুত্ব টিকে আছে, টিকে রবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আবদুল আহাদ কাউসার ১২ নভেম্বর, ২০১৯, ৬:৩১ পিএম says : 0
চিঠির যুগ ছিলো আছে,রবে চিরদিন। চমৎকার লিখনী।বেশ ভালো লাগলো। ভিজিয়ে দিলেন মনটা
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন