রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বেলুন ফুলানো গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত শিশুর নাম নিহাদ (৮)। গত বুধবার রাত ১টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। এ নিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত শিশুদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেডিক্যালে আহত ৭ জনের চিকিৎসা চলছে। এরমধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছে পরিবার ও স্বজনরা। আদৌ এসব শিশুরা স্বাভাবিক জীবনের ফিরতে পারবে কি না সে শঙ্কা যেন কাটছে না।
এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় রূপনগর থানায় মামলা করেছে পুলিশ। এতে বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে ঢামেক হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তারা। কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির সময় সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন তারা। প্রকাশ্যে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি নিষিদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর জোড়ালো নজরদারি দাবি করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। এর আগে গত বুধবার বিকালে মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীত দিকে ১১ নম্বর সড়কে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
রূপনগরের এডাফ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সিয়াম (১১)। আগামী ১৭ তারিখে তার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। গত বুধবার বিকেলে কোচিং শেষে ১১ নম্বর রোডের মনিপুরি স্কুলের পাশ দিয়ে বাসায় ফিরছিল সে। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দে কিছু একটার বিস্ফোরণ ও কিছু একটা এসে তার গায়ে লাগে। মুহূর্তেই চোখ, মুখ ও হাত-পা ঝলসে যায় তার। খবর পেয়ে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। বর্তমানে ঢামেক বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে সিয়াম। ১৭ তারিখ পরীক্ষা হলেও দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত তার পরিবার।
একই সময়ে বাজার থেকে পেপে আর মুরগি কিনে বাসায় ফিরছিলেন জান্নাত। হঠাৎ এক বিস্ফোরণ তার সবকিছুই পাল্টে দেয়। জান্নাত এখন হাসপাতালে। নার্সারি পড়–য়া মেয়ে সুমাইয়া মুরগি দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। আহাজারী করে এমনটাই বলছিলেন জান্নাত। বুধবারের বিস্ফোরণে গৃহকর্মী জান্নাতের একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
চিকিৎসাধীন জান্নাত বলেন, মেয়ে ও স্বামীসহ স্থানীয় বস্তিতে থাকেন। গৃহকর্তার বাবায় কাজ শেষে পাশের বাজার থেকে মেয়ের জন্য মুরগি আর পেপে কিনে বাসায় ফিরছিলাম। ভ্যানে রঙিন রঙিন বেলুন দেখে হাতে বাজার থাকা সত্ত্বেও বেলুন বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর আর কিছু মনে নেই। তবে হাসপাতালে আসার পর দেখতে পাই তার একটি হাত নেই। তখন বার বার মেয়ে সুমাইয়ার কথা বলতে থাকি। শুধু সিয়াম এবং জান্নাত ই নয়; বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় ২০ জনের মতো আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এদের কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে।
ঢামেকে ভর্তি ৬ বছরের শিশু মিজানুর রহমানের বাবা রোকন মিয়া বলেন, বিস্ফোরণে ছেলের পেটের ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। বুধবার রাতেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তারপর থেকে আইসিইউতে। ছেলেটা সারারাত যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারেনি। তার চিন্তায় আমাদেরও ঘুম হয়নি। সিয়াম, জান্নাত ও মিজানের মতো ঢামেকে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিশু মুস্তাকিন ও জনি একং জুয়েল সর্দার। আহতদের চিন্তায় স্বজনদের ঘুম হারাম। কবে তারা সুস্থ হবে, সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনাÑ এই চিন্তা যেন তাদের প্রতিনিয়ত পীড়া দিচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাদ্দিন বলেন, মিরপুরের ঘটনায় ঢামেকে ৭ জন ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে ২/১ জনের অবস্থা একটু খারাপ। তবে সবাইকে সারিয়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, বিস্ফোরণের পরপরই নিহাদকে ঢামেকের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তার চোখে ও মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে। নিহাদ নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সরোয়ার হোসেন সরুর ছেলে। সে বস্তির ব্র্যাক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলো। গতকাল ঢামেক মর্গে নিহাদের মা হালিমা বেগম বলেন, বেলুনওয়ালাকে দেখে নিহাদ আমার কাছে টাকা চায়। আমি কয়েকবার না বললে জোরাজুরি করে ১৫ টাকা নেয়। এর কিছুক্ষণ পরই বিকট শব্দ ও মানুষের চিৎকার শুনে রাস্তায় গিয়ে দেখি নিহাদ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। টাকা পাওয়ার খুশিতে আমার পোলাডা যে হাসি দিছিলো, সে হাসি এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে বলে তিনি আবারও কান্ন শুরু করেন। গতকাল ঢামেকে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ পরিবারের কাছে হস্থান্তর করা হয়।
এদিকে, বিস্ফোরণের দিন নিহত ৬ শিশুর লাশও গতকাল দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্থান্তর করা হয়েছে। নিহত ৬ শিশু হলোÑ ভোলার চরফ্যাশন থানার দুলারহাট উপজেলার নুর ইসলামের ছেলে রুবেল (১২), একই উপজেলার ও একই বাড়ির নুর আলমের মেয়ে নুপুর (৭), ভোলা সদরের আবু তাহেরে মেয়ে ফারজানা (৭), রোকন মিয়ার ছেলে রিফাত (৮), নেত্রকোনার আটপাড়ার মিলনের রিয়া মনি (৮) ও কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের মো আলমের শিশু সন্তান রমজান (১১)। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। আর আহত সাতজনকে ৫-১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম। নিহত প্রত্যেককে নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলে পারিবারগুলো জানায়।
রূপনগর থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিস্ফোরণের পর ঘটনার মূলহোতা তথা বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদকে চিহ্নিত করা সম্ভব না হলেও রাত ১১টার দিকে তার সন্ধান পায় পুলিশ। বিস্ফোরণের পর কেউ তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাত ১১টায় তার খালাতো ভাই মফিজুল ইসলাম তাকে ঢামেক হাসপাতালে এনে ভর্তি করায়।
তিনি বলেন, বুধবার মধ্যরাতে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। পরে ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে ঢামেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পুলিশ জানায়, মিরপুর-১১ এর দুয়ারীপাড়ায় একটি মেসে থাকেন সাঈদ। ৮-১০ বছর ধরে টেইলার্সের কাজ করতেন। গত ১০-১৫ দিন ধরে ভ্যানে করে বেলুনে গ্যাস ঢুকিয়ে বিক্রি শুরু করেন।
গ্রেফতারের আগে ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এটা একটা দুর্ঘটনা। আমিও তো এই ঘটনায় আহত। দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ওইদিন গ্যাস শেষ হওয়ার পর সাদা ছাই জাতীয় কিছু এবং আরেকটা ক্যামিকেল সিলিন্ডারের ভেতরে ঢুকিয়ে তিনি ঝাকি দেন। ঠিক তখনই বিকট শব্দে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। তার দাবি, ছাই জাতীয় পাউডার ও ওই ক্যামিকেলের নাম তিনি জানেন না। কিন্তু কিভাবে গ্যাস তৈরি করা হয় তা তিনি শিখেছেন। বিস্ফোরণে তার বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত থেঁতলে গেছে এবং পেট ও বাম রান ঝলসে গেছে।
এদিকে বুধবার সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তদন্তে তারা বলছেনÑ কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির করার সময় সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণ ঘটেছিল। হাউড্রোজেন গ্যাস তৈরির পদ্ধতি জানলেও হয়তো এর ভয়াবহতা জানতেন না বেলুন বিক্রেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মো. শামসুল আলম বলেন, সিলিন্ডারের মুখ বদল করে বাল্ব খুলে ভেতরে ক্যামিকেল দিয়ে হাইড্রোজেন তৈরি করার জন্য রিএক্টর বানানো হয়। তারপর কস্টিক সোডা আর অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করা হয়। হাইড্রোজেন তৈরি করার সময় রিএক্টরে জোরে চাপ পরায় সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ ঘটে। তদন্তকারী দু’জন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এমনটিই জানতে পেরেছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, এসব সিলিন্ডারের মেয়াদই থাকার কথা না। পুরোটাই অবৈধ কাজ। তবে এসব তারা দেখশোনা করেন না। ভাসমানসহ কাউকে এ ধরণের সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরতে দেখলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিএমপিসহ সারাদেশের ওসিকে চিঠি দিয়ে কয়েকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে চোখে পড়ার মতো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
গতকাল দুপুরে আহতদের দেখতে ঢামেক হাসপাতালে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। এ সময় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রকাশ্যে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এটা খুব মানবিক বিপর্যয়। এতোগুলো শিশু অকালে মারা গেল। আহতদের কেউ কেউ বেলুন কিনতে সিলিন্ডারের কাছে যাননি। তারা পথচারী ছিলেন, তবুও তারা হতাহত হয়েছেন। তিনি বাসা-বাড়িতে সতর্ক হয়ে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারসহ অবৈধ সিলিন্ডার প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি দাবি করেন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন