বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

বিহুর দেশে

শাশ্বতী মুখার্জী | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড়ে অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার গুয়াহাটি বা গৌহাটি। পল্টনবাজারের আশেপাশে ছোটো- বড়ো মার্কেট আছে, বিগবাজার, ভিশাল সেন্টার, কিছু মেগা শপও চোখে পড়লো, তবে ফুটপাথের মার্কেটেই ভিড় বেশি, দরদাম চলছে ক্রেতা- বিক্রেতা’র মধ্যে

এদিক-ওদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে, না -পছন্দ ডিনার সেরে হোটেলে ফিরলাম, রাতে এসি রুমে নাইস নিদ্রা।
পরের দিন, সাতসকালে স্নান সেরে শুদ্ধ চিত্তে, উপবাস করে মা কামাখ্যা মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গৌহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। কামাখ্যা ৫১টি পবিত্র পীঠের অন্যতম শক্তিপীঠ।
মন্দিরের আশেপাশে রাত্রিবাসের জন্য যাত্রীনিবাসের সন্ধান করলাম, ঘর নেই, সব ফিল আপ, ফুল সিজন চলছে এই সময়, শেষে মন্দিরের কাছে একটি হোটেলে লাগেজপত্তর রেখে রওনা হবো ভাবছি, বেলা দশটা বাজে, হোটেলবয়টি জানালো, মায়ের দর্শন করতে মিনিমাম সাড়ে চার ঘন্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে, তারথেকে বেটার বিকেল চারটেয় গেলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। বিকেল পাঁচটার পর আর লাইন দেওয়া যাবে না। বেজায় গরম, অগত্যা রুমেই লাঞ্চ অর্ডার করবো ভাবছিলাম, হোটেলবয়টি জানালো, মায়ের ভোগ দেওয়া হয় কূপন নিয়ে। সাড়ে বারোটায় ভোগ দেওয়া শুরু হয়।
অন্ন সেবা কূপন সংগ্ৰহ কেন্দ্র থেকে কূপন নিতে হয়
বিনা পয়সায় ! অতি সযতনে ,আন্তরিকতার সঙ্গে এত সুন্দর ভোগ বিতরণ ! নরনারায়নের সেবা ! দেখে মুগ্ধ আমি।
সুস্বাদু খিচুড়ি, আলুর দম, মুচমুচে পাঁপড়, সুমিষ্ট পায়েস স্টিলের খোপ করা থালায় সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশন। ভোজনে বড়ো তৃপ্তি পেলাম।
ঘন্টা তিনেকের বিশ্রাম, পূজার সামগ্ৰী নিয়ে রওনা
হলাম মায়ের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। মাথার উপর ছাদ, গ্ৰিল দিয়ে ঘেরা, দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য দুপাশে বসার জায়গা, মাথার উপরে টেবিল ফ্যান ফিট করা, রেস্টলেস পরিষেবা।
গ্ৰিলের বাইরে মায়ের মন্দিরের আঙিনায় বাঁদরের বাঁদরামি শুরু, এক দর্শনার্থীর হাত থেকে পূজোর প্যাকেট নিয়ে দে দৌড় ! জলের সুসজ্জিত জারগুলোর ওপর এক লাফ, মুহূর্তের মধ্যে সেগুলো তাসের ঘরের মতো ঝুরঝুর করে পড়ে গেলো।
কামাখ্যাই কামের মুক্তি, এখানে সতীর যোনিই শক্তির উৎস।
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, শিবঠাকুরের স্ত্রী সতীর পিতা দক্ষ এক মহাযজ্ঞ করেছিলেন, সেই অনুষ্ঠানে জামাই শিবকে তিনি নিমন্ত্রণ করেননি, সতী এতে চরম অপমান বোধ করেন, স্বামীর শত অনুরোধে তিনি বাপের বাড়ি গেলে পিতা জামাইয়ের নামে কুবাক্য বর্ষণ করলে, পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তিনি দেহত্যাগ করেন। মহাদেবাদিদেব স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করলে ভগবান বিষ্ণু জগতের মঙ্গল কামনার্থে সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেন, ফলে সতীর দেহ ৫১টি খন্ডে খন্ডিত হয়, সেই খন্ডগুলি ভুখন্ডের যেস্থানে পড়ে সেখানেই এক একটি পবিত্র পীঠ হয়, সতীর যোনি কামরূপে পতিত হয়েছিল, এই স্থানকে বলা হয় তীর্থচূড়ামনি।
কালিকা পুরান অনুসারে, কামাখ্যার পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দির আছে। ভূবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা --দশদেবীর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন।
মূল মন্দিরে সিংহাসনে আসীন অষ্টধাতুর কামাখ্যা দেবীর বিগ্ৰহ। যাদুবিদ্যার তীর্থস্থান এই কামাখ্যা মন্দির।
মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে, গর্ভগৃহ ও তিনটি মন্ডপ, এগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরতœ ও নাটমন্দির।
গর্ভগৃহটি আসলে একটি ভূগর্ভস্থ গুহা। এটি ছোটো ও অন্ধকার। এই গৃহ প্রদীপের আলোয় আলোকিত। সরু খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়।
ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খন্ড আছে যেটি যোনি আকৃতিবিশিষ্ট। নানা রঙের ফুল দিয়ে আবৃত। এখানেই লুকানো তাবৎ রহস্য, রোমাঞ্চ আর গল্পগাথা। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায় একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত। প্রতি বছর অম্বুবাচীতে কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতীকে কেন্দ্র করে মেলা বসে, ঐ কদিন মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে।
অন্ধকার গর্ভগৃহ দেখে ভয় লাগছিল, সরু সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠা, হুড়মুড় করে একে অপরের ঘাড়ে পড়লেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত, পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল, শ্বাসকষ্ট ও দেখা দিতে পারে। মূল মন্দিরের পুরোহিতকে বলেই ফেললাম, মায়ের ঘর এত অন্ধকার কেন ?
পুরোহিত বিনীতভাবে জানালেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, অন্ধকার লাগবে না, দেবীদর্শন করুন প্রদীপের আলোয়।
মায়ের পূজো, দর্শন, প্রণাম করে বড়ো তৃপ্তি পেলাম কোনো ঠেলাঠেলি নেই, শান্তিপূর্ণ, সুন্দর সারিবদ্ধভাবে একে একে এগিয়ে চলেছেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন