বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কথসাহিত্যিক ও পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দুতে পৌছনো খ্যাতিমান অন্যতম লেখক হুমায়ূন আহমেদ ১৩ই নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন (বর্তমানে আয়েশা ফয়েজ নামে পরিচিত)।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একই সাথে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার। ছাত্রজীবনে নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ‘নন্দিত নরক’ এর মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবন শুরু। ১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি পরবর্তীতে ১৯৭২ এ আহমদ ছফার সহযোগীতায় খান ব্রাদার্স কতৃক প্রথম প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ। তিনি দুই শাতধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘গল্প সমৃদ্ধ’। তাঁর গল্প উপন্যাসসমূহ সংলাপ প্রধান। ঐতিহাসিক প্রক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘মধ্যাহ্ন’ তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এছাড়াও ‘জোছনা ও জননী গল্প’ যা কি না ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে রচিত। তাছাড়া তিনি অসংখ্য যুবকের অন্তরে রয়েছেন হিমু চরিত্রটির মাধ্যমে। তাঁর অমর সৃষ্টি হিমু একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র। যা বর্তমান সময়ের যুবক-যুবতীদের মন জয় করে নিয়েছে চরিত্রটি। হিমু একজন বেকার যুবক যার আচরণ কিছুটা অজাগতিক। হিমুর প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষী। এর প্রাথমিক সাফল্যের পর হিমু বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন উপন্যাসে প্রকাশিত হতে থাকে। হিমু ও মিসির আলি হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট সর্বাধিক জনপ্রিয় দুটি কাল্পনিক চরিত্র। কিছু নারী-পুরুষ হিমুকে সত্যি বলে মনে করেন। আবার কোন কোন হিমুভক্ত পাঠক নিজেকে হিমু বলে দাবি করেন এবং হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ান রাতের শহরে। হিমু স্বতন্ত্র ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। সে প্রায়ই যুক্তি-বিরোধী মতানুসারে আচরণ করে, এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং তার এরকম অযৌক্তিক ব্যাক্তিত্বের কারণে সে অনেক সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। তার এরূপ আচরণ অনেক মানুষকে তাকে মহাপুরুষ ভাবতে প্রভাবিত করে। হিমুর এই সৃষ্ট চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদকে বাঁচিয়ে রাখেন পাঠকের অন্তরে অন্তরে। লেখক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো বিশাল পাঠকসমাজ তৈরি এবং তরুণ প্রজন্মকে বই পাঠে আগ্রহী করে তোলা।
হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত থেকেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থেই অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। তাঁর চলচ্চিত্র জীবন বর্নাঢ়্য, রঙিন ও সাফল্যমন্ডিত। তিনি চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু করেছিলেন লেখালেখির মাধম্যেই। ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক মুস্তফিজুর রহমান -লেখক নাট্যকার ও টিভি নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘শঙ্খনীল কারাগার› উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। এর মাধ্যমেই হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র জগত শুরু। ফলাফল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মোট চারটি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হওয়া। যার মধ্যে এটা ছিল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলমুখী করে তোলেন। এবং চলচ্চিত্র নির্মানের আগেই শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী হন তিনি। এছাড়াও তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ‘নন্দিত নরকে’ যার জন্য ১৯৭৩ সালে পান ‘লেখক শিবির› পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে পান শিশু একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে পান জয়নুল আবেদীন ‘গোল্ড মেডেল›, ১৯৮৭ সালে ‘ মাইকেল মধুসূদন পদক› ১৯৮৮ সালে বাকসাস পুরস্কার, ১৯৯০ সালে ‘ হুমায়ূন কাদের স্মৃতি› পুরস্কার, ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৯৪ সালে পান ‘একুশে পদক’ এবং ২০০৭ সালে পান সেলটেক পদক। এছাড়াও তিঁনি পেয়েছেন অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদের বহুমাত্রিক সৃজনকর্মের মধ্যে সঙ্গীত একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তিনি কেবল নিজের নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করেছেন। গল্প, উপন্যাস, নাটক সিনেমার পাশাপাশি তিনি রেখে গেছেন ৩৫/৪০ টি গান। হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গানের সুর করেছেন মাকসুদ জামিল মিন্টু। হুমায়ূন আহমেদের সাথে মাকসুদ জামাল মিন্টুর ছিল দারুণ বোঝাপড়া। তিনি বুঝতে পারতেন হুমায়ূন আহমেদ কি আদায় করিয়ে নিতে চেয়েছেন তার কাছ থেকে। ফলে সাহিত্যাঙ্গনে প্রশান্তি বইয়ে দিয়েছে তার জনপ্রিয় কিছু গান। যেমন একটা ছিল সোনার কন্যা, আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চাল, আইজ আমার কুসুম রাণীর বিবাহ হইবো ইত্যাদি ইত্যাদি। তার গানের শিল্পিদের তালিকা ছিল বেশ লম্বা।। এবং মেহের আফরোজ শাওন তাঁর বেশ কিছু গান গেয়েছেন। অথচ ছেলেবেলায় গান শেখার প্রতি হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহ ছিল খুব। তাই তিঁনি গান শেখার অনুরোধ জানান বাবাকে। বাবা গানের শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দিলেও গলায় সুর না থাকায় হতাশ হন শিক্ষক। অতঃপর তবলা শিখতে গিয়েও অকৃতকার্য হোন। তবলা বিষয়ে তিঁনি ‘ছবি বানানোর গল্পে ‘লিখেছেন– তেরে কেটে ধিনতা পর্যন্ত যাবার পরই তবলা শিক্ষক পালিয়ে যান। সঙ্গিতের দরজা বন্ধ হলেও তিঁনি সবসময় ভালোবেসে গেছেন সঙ্গিতকে। যেখানেই গেছেন গ্রামগঞ্জে বাউল মানুষদের ডেকে মগ্ন হয়ে শুনেছেন গান।
হুমায়ূন আহমেদের সকাল ১০-১১ অবধি লিখতেন। অবসরে আঁকতেন ছবি। জীবনের প্রায় শেষ একযুগ তিঁনি কাটিয়েছেন গাজীপুরের বাগানবাড়ি নুহাশপল্লীতে। সেখানে থাকতেই তিঁনি ভালোবাসতেন। গল্প রসিকতা করতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার শর্তেও সাধারণ জীবন যাপনে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। লেখালেখির সময়ে কী করতেন তিনি এ প্রসঙ্গে তার মেয়ে শীলা বলেন – লেখালেখির আগে হুমায়ূন আহমেদ পায়চারি করতে করতে চিন্তা করতেন। প্রচুর সিগারেট খেতেন। লেখার মাঝখানে উঠে হাঁটতেন। ঘন ঘন চা পান করতেন। লেখালেখিতে আরোও অদ্ভুত একটি বিষয় ছিলো তাঁর তা হলো, তিঁনি নিরব ঘরে লিখতে পারতেন না। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, চিৎকার চেঁচামেচি, এসবের মধ্যেই তিঁনি লিখতে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। অনেক সময় সারারাত জেগে একটা উপন্যাস লিখে ফেলতেন তিঁনি। তারপর কখনই তিঁনি তা পড়তেন না। আমাদের পড়তে দিতেন।
ব্যাক্তিজীবনে হুমায়ূন আহমেদ দু›বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। ১৯৭৬ সালে গুলকেতিন খানকে ভালোবেসে বিয়ে করেন এবং ২০০৩ সালে বিচ্ছেদ সম্পন্ন করেন এবং সে বছরই মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন তিনি। শাওন ও হুমায়ূন দম্পতির ঘরে দুইপুত্র সন্তান আসে। নিনিত তাদের মধ্যে একজন। নিনিতকে কতটা ভালোবাসতেন সে সম্পর্কে জানা যায় হুমায়ূন আহমেদের আরোও বেশিদিন বাঁচার চেষ্টা দেখে। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন
“আমি কখনো অতিরিক্ত কিছুদিন বাঁচার জন্য সিগারেটের আনন্দ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারকে বলব, আমি একজন লেখক।
নিকোটিনের বিষে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ অভ্যন্ত। তোমরা আমার চিকিৎসা করো, কিন্তু আমি সিগারেট ছাড়ব না। তাহলে কেন ছাড়লাম?
পুত্র নিনিত হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শিখেছে। বিষয়টা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। দু-এক পা হেঁটেই ধুম করে পড়ে যায়। ব্যথা পেয়ে কাঁদে। একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে।
সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল।
তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুদিন আমার থাকা উচিত। সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই নিয়ে নিলাম।”
কিন্তু মৃত্যু একদিন সবাইকেই গ্রাস করে। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুরে শারিরীক রুটিন পরীক্ষা করতে গিয়েই আকস্মিকভাবে ধরা পড়ে কোলন (বৃহদান্ত) ক্যান্সার। তাও চতুর্থ পর্যায়ে। ক্যান্সারের চতুর্থ পর্যায় মানে ক্যান্সার সবচেয়ে পরিণত। এই স্টেজে কোষগুলোর মূল জায়গা ছাড়াও শরীরে অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়েও তাঁর লেখা কলাম ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ ছাপা হয় বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে। পরে সংকলিত গ্রন্থ হিসেবে ছাপা হয় কলামগুলো। হুমায়ূন আহমেদ তার সে গ্রন্থের উৎসর্গ পাতায় লেখেন
‘কেমোথেরাপি হলো একটি দীর্ঘ বেদনাদায়ক নিঃসঙ্গ ভ্রমন’
এ সময়ে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং শেষদিন পর্যন্ত নিয়মিত খোঁজ খবর রেখেছিলেন বিজ্ঞানী গবেষক ও লেখক পূরবী বসু। নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার চিকিৎসা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। বরাবর হুমায়ূন আহমেদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ছিল দৃঢ়। এবং তিনি প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু আমেরিকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই মারা যান জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। প্রায় দশমাস চিকিৎসার পর নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। অবশেষে হুমায়ূন আহমেদের নুহাশপল্লীর লিচুবাগান নামের একটি স্থানে সমহিত করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন