আশরাফ পিন্টু
মন্তাজ মাস্টার দরজার বাইরে এক পা দিয়ে পুনরায় ঘরের ভেতর ঢুকলেন।
আকাশেমেঘ, ছাতাটা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া দরকার। তিনি ঘরের মধ্যে ছাতা খুঁজতে লাগলেন কিন্তু কোথাও ছাতার দেখা মিলল না। ছাতা না পেয়ে উচ্চস্বরে স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন, ‘রাজিয়ার মা, আমার ছাতাটা খুঁজে পাচ্ছি না?’
স্ত্রী রান্নাঘর থেকেই জবাব দিলেন, ‘দ্যাখো দরজার কানিতে ঝুলানো আছে।’
মন্তাজ মাস্টার স্ত্রীর কথামতো দরজার কোণে খুঁজতে লাগলেন কিন্তু ছাতা পাওয়া গেলনা। মন্তাজ মাস্টার আবার চেঁচিয়ে উঠলেন ,‘কই, পাচ্ছি না তো?
স্ত্রী এবার রান্নাঘর থেকে অগ্নিশর্মা হয়ে বের হয়ে এলেন। এসে দেখলেনÑ সত্যিই দরজার কোণে ছাতাটি নেই। এদিক-সেদিক খোঁজার পর দেখা গেল ছাতাটি বড়বাক্সের উপর রয়েছে। ছাতাটি স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘একটু ডানে-বায়ে চায়া দেখতি অয়।’
ছাতাটি হাতে পেয়েই মাস্টারের ভুল ভেঙে গেল। বললেন, ‘এ তো নতুন ছাতা, পুরানটা কই?’
‘পুরানটা দিয়া তুমি কি করবা?’
মন্তাজ মাস্টার আর উত্তর দিতে পারেন না। তিনি ছাতা নিয়ে স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ফেয়ারওয়েলে পাওয়া এ নতুন ছাতাটি তার সে ভুল ভেঙে দিয়েছে। আজ তো তার স্কুল নেই। তিনি তো গতকাল অবসর নিয়েছেন। মন্তাজ মাস্টার দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘ না থাক। বৃষ্টির মধ্যে আর কোথাও যাব না।’
স্বামীর ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে জরিনা বেগমের মনে যে জমাটকৃত রাগ ছিল তা মুহূর্তে মিইয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন তার মনের অবস্থা। দীর্ঘ ত্রিশ বছর স্কুলে ছাত্রদের পড়িয়েছেন। সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন ফিরেছেন বিকেল ৫টায়। এই ত্রিশ বছরে তেমন ব্যতিক্রম হয় নি। শুধু একদিন ব্যতিক্রম হয়েছিল। যেদিন তার ছেলে রাজু জাম গাছ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ছিল। শুধুু সেদিনই তিনি একঘণ্টা দেরিতে স্কুলে গিয়েছিলেন।
জরিনা বেগম তার স্বামীর মুখের দিকে পুনরায় তাকিয়ে দেখেনÑ তার চোখ দুটো এক অব্যক্ত বেদনায় ছলছল।
জরিনা বেগম মোলায়েম স্বরে বলেন, ‘তুমার তো আজ স্কুল নাই।’
‘ হ, মনে করেছিলাম...।’
‘হোনো, স্কুল ছাড়াও তো পোলাপান গো পড়ান যায়। তুমি কাল থাইকা বাড়ি বাড়ি যাইয়া ছেলেপেলে পড়াইবা।
‘এডা কী কও বৌ? আমি প্রাইভেট পড়ামু! এই তিরিশ বছরে কাউরে আমি প্রাইভেট পড়াই নি, ক্লাস থাইকাই ছাত্রগো পড়া তৈরি কইরা দিছি।’
‘এখন তো তুমার স্কুল নাই। তুমি তো স্কুল ফাঁকি দিয়া প্রাইভেট পড়াইবা না। এতদিন তুমি যে জ্ঞান বিতরণ করছাও, এহন শুধু সেই জ্ঞান ফেরি করবা। এতে তুমার ভালোও লাগব সময়ও কাটব।’
জরিনা বেগম কথাটা মন্দ বলে নি। ভালো বি.এস.সি শিক্ষক হিসেবে শে সুনাম ছিল মন্তাজ মাস্টারের। আগে তো গ্রামের স্কুলগুলোতে বি.এস.সি শিক্ষক পাওয়াই যেত না। এখনো গ্রামের স্কুলগুলোতে ভালো বি.এস.সি’র অভাব রয়েছে। শুধু নিজ স্কুলেই নয়, আশপাশের স্কুলগুলোতেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তার। এজন্য অনেক ছাত্র-ছাত্রীই তার কাছে পড়তে ভিড় জমাত। কিন্তু তিনি কখনও কাউকে প্রাইভেট পড়ান নি।
এতদিনের পড়ানোর অভ্যাস তিনি কীভাবে ভুলে থাকবেন? কাজেই স্ত্রীর কথাটা তার মনে ধরে গেল। তাছাড়া বিদ্যা অমূল্য সম্পদ; শুধু এটিই দানে বাড়েÑ অন্য কিছু নয়।
পরদিন থেকেই মন্তাজ মাস্টার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ানো শুরু করলেন। ক্রমশ তার চাহিদা বাড়তে লাগল। পূবের্র মতো তিনি বাড়ি থেকে বের হন সকাল ৯টায়, ফেরেন বিকেল ৫টায়। দুপুরের খাবার টিফিন কেরিয়ারে করে নিয়ে যান। অভিভাবকেরা খাওয়াতে চাইলেও তিনি তাদের বাড়িতে খান না। মাস শেষে যে যা মাইনে দেয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে পড়ান।
সেদিন একটু আগেভাগেই বাড়ি ফিরলেন মন্তাজ মাস্টার। ঘরে ঢুকেই শুনতে পেলেন স্ত্রীর কান্নার স্বর। এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। কী হলো, জরিনা কানছে ক্যানো?
কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে জরিনা বেগম, ‘তুমি তুমার ছাওয়ালের কোনো খবর রাহো?
‘কী অইছে রাজুর?’
‘ও পরীক্ষায় ফেল...। বলেই স্বর আটকে যায় জরিনা বেগমের।
রাজু এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে ছিল। ছোটবেলা থেকেই খুব দুষ্ট প্রকৃতির সে। একবার গাছে থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ছিল, মাথায়ও চোট পেয়ে ছিল খুব। শাসন করতে চাইলেও স্ত্রীর জন্যে পেরে ওঠে নি। নিজে পড়াতে চেয়েছে কিন্তু বাবার কাছে পড়তে নাকি লজ্জা করেÑ এ অজুহাতে পড়ে নি। তবে অন্য মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়েছে। ছাত্র একবারে খারাপ নয় রাজু। তবুও...
‘ও কোথায়?’
‘ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘রাজিয়ার বাসায় খোঁজ নিয়েছো?’
‘হ, ওহানেও নাই।’
মন্তাজ মাস্টারের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। একমাত্র ছেলে তার। বড়মেয়ে রাজিয়াকে পাশের গ্রামের এক বৃত্তশালীর ছেলের সাথে কিশোরী অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর দীর্ঘদিন তাদের সংসারে ছেলেপুলে আসে নি। দীর্ঘ ১০ বছর পর রাজু আসে তাদের সংসারে। ফলে অতি আদর-সোহাগে গড়ে ওঠে রাজু।
মন্তাজ মাস্টার কোনো রকমে স্ত্রীর কাছে থেকে উঠে গিয়ে বারান্দার চৌকির ওপর বসেন। কী করবে ভেবে পান না। হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসতে থাকে। আগে কখনো এমন হয় নি। তার হাত দিয়ে কত ছেলেমেয়ে মানুষ হয়ে গেল! দেশের কত বড় বড় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তার ছাত্র। এ নিয়ে তিনি কত গর্ব করেন। কেউ বিখ্যাত কোনো ডাক্তারের কথা বললে সগর্বে তিনি বলেছেনÑ আরে ও তো আমার ছাত্র! বলেই গর্বে তার বুক ভরে যেত। আজ তার ছেলের কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে...
‘স্যার, কলম লইবেন? খুব সুন্দর সুন্দর কলম। এ কলম দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শুধু অঙ্কই করাইবেন না; সুন্দর সুন্দর গল্প-কাহিনীও লিখতে পারবেনÑ সহজে কালি শ্যাষ অইব না।
এমন অসময়ে কোত্থেকে ফেরিওয়ালা এলো! মন্তাজ মাস্টার উঠানের দিকে তাকান। দেখেনÑ এক ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ ফেরিওয়ালা, লাঠির সাথে রং-বেরঙের অনেকগুলো কলমের পাতা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কলমের দিকে তাকাতেই তার হঠাৎ মনে পড়ে যায়Ñ কিছুদিন আগে ক্লাস টেনের এক ছাত্রের কথাÑ ‘কলম তুমি কাহিনী লিখ তোমার কাহিনী কী...’
‘‘একটি কলমের আত্মকাহিনী’’ রচনায় সুকান্তের কবিতার এই লাইনটি ছিল। ছাত্র লাইনটির মর্মার্থ কি তা জানতে চেয়েছিল তার কাছে। সেদিন সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেদিনের কথাটা মনে করতে চাইলেন মন্তাজ মাস্টার কিন্তু পারলেন না। সবই কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভাবছিলেন ছেলের কথা কিন্তু এর মধ্যে ফেরিওয়ালা, কলম এসব এসে পড়ছে কেন? চারদিকে কি আঁধার ঘনিয়ে আসছে?
ফেরিওয়ালাটিকে তো আর দেখা যাচ্ছে না।
‘রাজিয়ার মা!’ বলে স্ত্রীকে ডাকার চেষ্টা করলেন মন্তাজ মাস্টার কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন