হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলেছে শাহিদা।
রাতের শাহবাগ ঘুমোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাহবাগ মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে শাহিদা ভাবছেÑ অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে রেখে কীভাবে বাসায় গিয়ে ঘুমাবো? সেকেন্ডারি স্ট্রোক করা রোগী; ফাইনাল স্ট্রোক করে কখন কী হয়ে যায় বলা মুশকিল!
অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে কত কী ভেবে পুনরায় হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায় শাহিদা।
শায়িত বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রোগবিষণœ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ও! এরপর ঘুমন্ত বাবার বুকে হাত রেখে বসে পড়ে ও।
চোখ না খুলেই শাহিদার হাতটি চেপে ধরে অস্পষ্ট স্বরে বাবা বললেন, তুই এখনও ঘুমাতে গেলি না, কাল অফিস করবি কেমনে ?
একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে এমডির ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে চাকরি করছে শাহিদা।
নিরুত্তর শাহিদা ফ্লোরে শুয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকাল। বসা থেকে ওঠে বাবা বললেন, শাহিদা, আমাকে কি একটু বারান্দায় নিয়ে যেতে পারিস?
অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি ওখানে যাবা কী করে? তুমি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছো না।
হুইল চেয়ারটায় বসিয়ে হলেও আমাকে একবার বাহিরের পৃথিবীটা দেখিয়ে নিয়ে আয়; বিছানায় শুয়ে থেকে আর পারছি না, মন বিষিয়ে ওঠেছে!
হুইল চেয়ারটা টেনে বেডের সামনে এনে সাবধানে বাবাকে বসিয়ে ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেল।
বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে চেয়ারটি রেখে, বাবার পায়ের নিচে বসে পড়ে শাহিদা। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন, আমার বোধহয় সময় ফুরিয়ে এসেছে! এবার হয়তো সুস্থ্য হয়ে বাড়িতে ফেরা হবে না!
বাবার উরুর ওপর মাথা হেলিয়ে কেঁদে ওঠে শাহিদা, এমন কু-কথা বলো না বাবা, তুমি বহুদিন বাঁচবে! তোমার কোনো জটিল রোগ হয়নি। তুমি মরে গেলে, আমার কী উপায় হবে, বলো?
মেয়ের মায়াভেজা কথায় বাবার চোখ বেয়ে অশ্রæ ঝরছে! আর্দ্র গলাভেজা কণ্ঠে বাবা বললেন, তুই যতই সান্ত¦নার বাণী বলিস না কেন, তিনবার স্ট্রোক করে বেঁচে থাকতে কাউকে দেখিনি; এটা আমার দ্বিতীয়। প্রথম যখন স্ট্রোক করেছিলাম, তখন তোর জন্মই হয়নি; যখন শুনতে পেলাম যে, তিতাস নদীতে তোর বাবার মৃতদেহ পড়ে আছে, সঙ্গে সঙ্গে বুকের বামদিকে ব্যথা শুরু হয়; আমি অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার বলেছিলেন, প্রাইমারি স্ট্রোক।
হাঁটু থেকে মাথা তুলে, বিস্ময়ের চাহনিতে ভুরু কূঁচকিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শাহিদা, আমার বাবার লাশ? প্রলাপের মতো এসব কী আবোলতাবোল বলছো?
কিছুটা টেনশনে পড়ে গেলেন বাবা, কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেললাম!
মেয়েকে টেনে বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন, যে-কথা পয়ত্রিশ বছর বুকের অতলে কবর দিয়ে রেখেছিলাম, আজ বুকের রক্তভেজা কবরের মাটি ভেদ করে সে-কথা কেন বেরিয়ে এলো?
কী কথা বাবা?
যে-কথা শুনলে পাষাণও কেঁদে ওঠে; আর তুই কেমনে সহ্য করবি, বল?
কী কথা! খুলে বলছো না কেন ?
বাবা চুপ করে স্তব্দ রাতের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহিদাও বিস্ময়ের চাহনিতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! অল্পক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা বললেন, সত্য যেহেতু অতর্কিতে বেরিয়ে-ই এসে গেছে, তা কি আর লুকিয়ে রাখা যাবে? যাবে না।
তুমি কোন সত্যের কথা বলছো ?
যে-কথা জানাও তোর কর্তব্য।
বাবাকে চুপচাপ দেখে শাহিদা বলে, তুমি চুপ করে আছো কেন?
চট্ করে বাবার মুখ থেকে বেরুল, আমি তোর আসল বাবা নই রে, আসলে আমি তোর চাচা।
কিছুটা নড়েচড়ে বসে শাহিদা, এসব তুমি কী বলছো? অসুখে তোমার বোধহয় মতিভ্রম হয়েছে।
আমার মতিভ্রম হয়নি, বরং তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না। অবশ্য তা তোর বিশ্বাস করার কথাও নয়। তাহলে শোনÑ
পাকিস্তানি মেলিটেরি তখন ঘাগুটিয়া মসজিদকে কেন্দ্র করে ঘাঁটি বানিয়ে বসেছিল। ঘাগুটিয়ার আশপাশে নির্বিচারে বাঙালির ওপর হামলা চালাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিল সেদিন। ওদের ভয়ঙ্ককর অবস্থান এবং পৈশাচিক বর্বরতায় গ্রামের লোকজন হন্যে হয়ে পালাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধ হয়ে বারবার সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েও ওদের বূহ্য ভাঙতে পারেনি। বরং পাকসেনাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে এলাকার লোকজন মরছে!
তখন কার্তিকের মাঝামাঝি সময়। নিঝুম রাতে রাইফেলের গুলির শব্দে মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। মা ওঠে বসে তোর বাবা, মানে আমার বড় ভাই ওমরকে ডেকে বলেছিলেন, বাজান, যেইভাবে পাঞ্জাবি সেনারা গ্রামের লোকজন মারতাছে; আমরা
বাঁচমু কেমনে? কই গিয়া লুকাইয়া জান বাঁচামু?
ওমর ভাই বলেছিল, ডরাইও না মা, তোমার কিচ্ছুই হইব না; তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধার মা হইয়া মুত্যুকে কেন ডরাইতাছো? দুএক দিনের মধ্যেই আমরা এই এলাকা মুক্ত করবো।
ওমরের হাত ধরে মা বলেছিলেন, তোরা দুই ভাই আমারে না-কইয়া যুদ্ধে চইলা গেলি। তুই মইরা গেলে তর পোয়াতি বউয়ের কী অবস্থা হইব ক দেহি? তোর যে সন্তান জন্ম হইব, তার কী হইব ক তো দেহি?...
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওমর বলেছিল, ‘বীরেরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। আমি মরে গেলেও তোমার কোনো দুঃখ নাই মা, এই দেশ তো স্বাধীন করতেই হবে।
একটা কাম করলে কেমন হয়?
কও, কী কাম?
আমারে তর মামার বাড়ি জয়পুরে রাইখা আয়। হেইখানে মেলিটেরির এমন উৎপাত নাই।
একথা কে বলেছে? কদিন আগেও জয়পুরের বহু বাড়ি-ঘর জ্বালাইয়া দিছে। সেখানে গিয়ে তুমি থাকবা কোথায়?
তোর বড় মামার লগে থাকমু।
ঠিক আছে, কিন্তু এমন ঘোর যুদ্ধের মধ্যে তুমি কেমনে যাইবা! চারদিকে সবসময় মেলিটেরি টহল দেয়।
তুই রাইতের আন্ধারে নৌকায় কইরা লইয়া যাবি। এইখানে থাকলে তো আমরা বাঁইচা থাকতে পারমু না। তুই অহনি গিয়া নৌকাটা লইয়া আয়, আমি তোর বাপেরে লইয়া ঘাটে যাই।
ঠিক আছে, আমি নৌকাটা নিয়ে এখনই ঘাটে আসছি। তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আমি এসে যুদ্ধে চলে যাব!
সাবধানে যাবি বাজান, কাক-পক্ষিও যেন টের না পায়।
তুমি চিন্তা করো না, আমি সাবধানেই যাব।
রাত দ্বিপ্রহর! চারদিকে ঘোর অন্ধকার! নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চটি তখন ঘাগুটিয়া ঘাটে নোঙর করেছে। কিছুক্ষণ ঘাটে থেমে থাকার পর, লঞ্চটি রামচন্দ্রপুরের দিকে যাত্রা করে।
নৌকা নিয়ে তিতাসের স্থির জলের ওপর দিয়ে বাড়ির ঘাটে আসার সময় আচমকা লঞ্চের হেডলাইট জ্বলে ওঠে। দূর থেকে জ্বলেওঠা লাইটের প্রজ্জ্বলিত আলোয় ওমরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এমন সময় খালের ওপারে ওঁৎ পেতে থাকা পাকসেনার বুলেট এসে ওমরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়! সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ঢলে পড়ে ওমর!
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়Ñ ওমরের লাশ দুদিন পর্যন্ত নদীতেই পড়ে রইলো! তিতাসের পানি রক্তে লাল হয়ে ওঠে, রক্তের স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে বীরহারা মায়ের
শুন্যতার ঢেউ তুলে...
ভয়ে কেউ লাশ তুলে এনে দাফনের উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, লাশের দিকে পাকসেনারা রাইফেল তাক করে বসে ছিল। যে কেউ তাকে তুলে আনতে যাবে, তাকেই গুলি খেয়ে প্রাণ বির্সজন দিতে হবে।
আমি তখন গিয়াস উদ্দিন বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত। খবর পেয়ে দ্রæত বাড়ি ছুটে আসি।
গভীর রাতে রাইফেলটি কাঁধে ঝুলিয়েই একেলা মুত্যুকে হাতে নিয়ে ওমরের লাশ তুলে আনতে যাই। আমাকে বারবার বারণ করেছিল মা, বাজান রে, আমার এক পুত্র হারাইছি; তরেও যদি হারাই, তইলে আমি বাঁইচা থাকমু কারে লইয়া।
মায়ের বারণ অমান্য করে ভাইয়ের লাশ তুলে আনার জন্য রওয়ানা হলাম। ধান ক্ষেতের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নদীর পারে গিয়ে দাঁড়াই। কী এক বীভৎস করুণ দৃশ্য! পানিতে ভেসে আছে এক বীর বাঙালির পবিত্র শব! আর ওই নদীতে রক্তের ¯্রােত প্রবাহিত হচ্ছে...! এখনও ওই নদীতে রক্তের ¯্রােত প্রবাহিত হয়, শহীদ বীর বাঙালির তাজা রক্ত...!
ভাইয়ের লাশ এভাবে পানিতে ভেসে থাকতে দেখে, আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল! সবেগে অশ্রæ ঝরেছিল বুক ভাসিয়ে!
চাপা কান্না বুকে চেপে রেখেই ঘন আঁধারে ভাইয়ের শব কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। গ্রামের কিছু লোকের সহায়তা নিয়ে তাকে সমাহিত করিÑ ঘাগুটিয়া মসজিদের অদূরে, আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে। আজও তোর বাবা লাল সবুজের কাফন পড়ে ঘুমিয়ে আছে ওখানে।
এসব তুমি কী বলছো বাবা! তোমার এমন গল্প আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি হয়তো আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্যই এমন গল্প বানিয়েছো। এটা কাল্পনিক গল্প ছাড়া কিছুই না।
তোকে বিশ্বাস করতেই হবেÑ তুই একজন শহীদ বীরের গর্বিত সন্তান। এরপর কী হয়েছিল শোনÑ
দেশ স্বাধীন হবার মাস তিনেক পর তোর জন্ম। তোর মায়ের যৌবন তখন মুকুল ভেদ করে পাপড়ি মেলেছিল মাত্র! তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার জন্যÑ তোর মামারা এসে তোর মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু একজন গর্বিত শহীদ বীরের স্ত্রীকে বিদায় করতে গিয়ে আমার বৃদ্ধ বাবার বুক কেঁপে ওঠেছিল। অবশেষে বাবা তোর মাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। আমিও গর্বচিত্তে তাকে বিয়ে করে তোকে মানুষ করে গড়ার দায়িত্ব মাথায় তুলে নিই।
একথা আগে কখনও বলোনি কেন?
পিতৃহারা বেদনা তোকে কষ্ট দিবে ভেবে বলা হয়নি।
কিন্তু তুমি তো কখনও আমাকে বুঝতেই দাওনি যে, আমি পিতৃহারা; এমনকি এখনও পিতৃহারা বেদনা আমাকে কোনো রূপ প্রভাবিত করছে না।
শাহিদার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বাবা কেঁদে ওঠেন, দেখ রে মা, তোকে এতটাই ভালোবাসি যে, সবকিছু হাতছাড়া হয়ে গেলেও আমি কষ্ট পাবো না; কিন্তু তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও আমার মন শান্তি পায় না। তুই-ই আমার প্রাণ; তোকে ছেড়ে মরেও আমি শান্তি পাবো না।
বাবার বুকে মাথা রেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে শাহিদা! অল্পক্ষণ নীরবতার পর ক্ষীণ কণ্ঠে বাবা বললেন, শাহিদা...
হুম..
আমার বুকের ব্যথাটা আবারও বেড়ে ওঠছে গো! আমাকে বেডে নিয়ে যা।
ত্বরিত বসা থেকে ওঠে, হুইল চেয়ারটি ঠেলে বারান্দা ছেড়ে ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে থাকল শাহিদা...
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন