শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহান বিজয় দিবস সংখ্যা

বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এই বিজয় আর স্বাধীনতার সাথে যে নামটি সামনে আসে তিনি হলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের এই মাসে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন বাংলাদেশকে। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিল কেবলই বাংলাদেশ। এজন্য সারাজীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। ফাঁসির দড়িও তাকে লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি কখনো। টানা ৯ মাস সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তার প্রিয় জনগণের মাঝে। নিজেকে সঁপে দেন দেশ গড়ার কাজে। শুরু হয় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রাম। সেটা আরেক সংগ্রাম। দেশের মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংগ্রাম। সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু একটা সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যে সোনার বাংলার উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে।

বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ সব প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন। এর মধ্যে তিনি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিল্পকে। শিল্পে বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর এ দর্শন বাস্তবায়নে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ। বঙ্গবন্ধুর শিল্প ভাবনাকে পাথেয় করে ইতিবাচক মানসিকতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে শিল্প আন্দোলনকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে যথার্থ অর্থে কাজে লাগানো উচিতই।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। দেশকে এগিয়ে নেয়ার অগ্রনায়ক। তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করে গেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ভাবতেন দেশ কীভাবে সমৃদ্ধশালী হবে। তাইতো কৃষি ক্ষেত্রে মনোযোগী হন তিনি। শিল্প বিপ্লব ঘটাতে নানা পরিকল্পনা হাতে নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থমকে যায় তার সকল পরিকল্পনা।

আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি। যিনি আমাদের দেশমাতৃকা উপহার দিলেন, এই তাকেই কত না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। জাতির জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হলো সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ঘাতকদের হৃদয় স্পর্শ করল না। শুধু তই নয়, তারা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারা দিয়েছে। সেখানে কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐের ছবি এদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারকরা তাতে ভয় পেত। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানত জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা আরও জানত, সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোনো কিছুতেই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে। সেই স্বপ্ন সফল করার আহŸান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব। ক্ষাত্র শক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্ব›দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক এবং নিরন্তর প্রেরণার উৎস। এইসব উপাদানের সমন্বয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল নামটি স্থানটি যে বঙ্গবন্ধুর যুক্তিবাদী, বিচারশীল এবং ইতিহাস বোধসম্পন্ন সকল মানুষই এটা স্বীকার করবেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তবুও কিছু লোক বিতর্ক তুলেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার জোরে অন্যায়ভাবে একদা বাতিলও করে দেয়া হয়েছিল।

ঐতিহাসিক ভাষণের কথা কি ভুলা যায়? স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা ছিল সেখানে। সেই ৭ মার্চের ভাষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ঘোষণা যে শুনেছে তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। ওই ভাষণে ছিল এ দেশের সর্ব শ্রেণির মানুষের অকথিত বাণীর প্রকাশ, তাদের চেতনার নির্যাস। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তো শত্রæ দেশে বন্দি থাকা সত্তে¡ও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকলে, তেমনি প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলায় বিজয় এসেছে। বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন দেশ।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন-দিল্লি হয়ে আজন্ম লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করেন পরম মমতায়। সেদিন স্বজন হারানো সর্বস্বান্ত মানুষ হৃদয় উজাড় করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণ করে নিয়েছিল। নেতা ও জনতা মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়, যা স্মৃতির আকাশ থেকে কখনো মুছবার নয়। তার জীবন ও রাজনীতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও ক্রমবিকাশমান ধারায় ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ, সর্বোপরি আবহমান বাংলার বৈশিষ্ট্যকে তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন। তার কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনবোধ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শন থেকে তার উন্নয়ন চিন্তা চেতনার কিছু উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। সামষ্টিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকারে মূল অনুষঙ্গ হলো, তার দেশের মানুষ এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন। তিনি সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সেজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন; পরে শিল্প বিপ্লবে হাত দেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু নির্ভীক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয় ভূমি ব্যবস্থাপনা,শিল্পের বিকাশ, ক্ষুদ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা ও মানসম্পন্ন যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি। মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারের ভূমিকা কেমন হবে? বিশ্ব মানের দক্ষ মানব সম্পদ বিভাবে গড়ে তোলা যায়। এ সব কর্ম পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে পুনর্গঠন করা যায় তা ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। পরিকল্পনায় অতি নি¤œ আয় এবং সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত মানুষের জন্য বাস্তব সম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন-ই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের কৃষি ও শিল্প বিপ্লব সেই সাথে বাঙ্গালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম, বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমেই কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। আর রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। এ দর্শনে ছিল সোনার বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখের হাসি ফোটানোর স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন গোটা অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক নির্ভরতা থেকে মুক্তি। হয়তো সেটা স্বল্প সময়ে সম্ভব না ও হতে পারে, কিন্তু তা নিরাপদ ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে নিশ্চিতভাবে, এভাবেই চিন্তা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে আজকের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পরে স্বপ্ন দেখা মানুষ গুলো। তিনি চলে গেলেন। আর ফিরে এলেন না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mohammad. Hossain ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:৪৬ এএম says : 0
Look like to me BNP found Another Robert Clive and Mir jaforali khan ,BNP trying to do another phalasi war. Inquilab should not support them ,history need to read and memories. Joy Bangla Joy Father of nation Thank
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন