৫২তম বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে কী দেখছি? ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কায়েম হওয়ার দুই বছর পর প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তারপর আওয়ামী লীগের দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের বয়স ৫১ বছর, কিন্তু আওয়ামী লীগের বয়স ৭৩ বছর। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দেওয়া হয়। সেটি আওয়ামী লীগের পরিবর্তিত আদর্শের একটি দিক। তবে আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রধান দিকটি ছিল পাকিস্তানে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। কারণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তার কোনো শাসনতন্ত্র বা সংবিধান ছিল না। অবশ্য শুরুতে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ভারতেও ছিল না। উভয় দেশই ভারত শাসন আইন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল।
ভারতে স্বাধীনতার ৩ বছরের মাথায় ১৯৫০ সালে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণীত হয়। আর পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। শুরুটা হয় বিপিসি বা বেসিক প্রিন্সিপলস কমিটি রিপোর্ট বা মূলনীতি প্রণয়ন কমিটি রিপোর্ট দিয়ে। তারপর সেই প্রক্রিয়া গড়াতেই থাকে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হয় এবং ২৬ মার্চ এই শাসনতন্ত্র কার্যকর হয়। ততদিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ বছর পর্যন্ত দেশটি বৃটিশ প্রণীত ভারত শাসন আইন অনুযায়ী চলে। এই আইনে রাষ্ট্রের প্রধান অর্থাৎ গভর্নর জেনারেলের হাতে অসীম ক্ষমতা ন্যাস্ত ছিল। গভর্নর জেনারেল কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল মন্ত্রিসভা, ফেডারেল অ্যাসেম্বলি, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা এবং প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলি ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর দেশটিতে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়। এই ব্যবস্থায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। মাত্র দুই বছর পাকিস্তানে গণতন্ত্র টিকেছিল। ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। তারপর ১০ বছর তিনি দেশ শাসন করেন। আইয়ুব খানের এই ১০ বছরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রবল আন্দোলন চলে। পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলনের পুরো ভাগে সব সময়ই ছিল সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘঠিত হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলেই। পশ্চিম পাকিস্তানে নেতৃত্ব দেন জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান। এই গণ অভ্যুত্থানের পিঠে সওয়ার হয়ে নতুন সামরিক শাসক হন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দেন। বিদেশিরা বলেন যে, পাকিস্তানের ২৪ বছরে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল ইয়াহিয়া খানের আমলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রশ্নে, অর্থাৎ ৬ দফার হুবহু বাস্তবায়নে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো রাজি না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম লাভ করে।
আমরা এখানে পাকিস্তান আমলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করলাম, এই বিষয়টি দেখাতে যে, নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই ছিল পাকিস্তান আমলের প্রধান সমস্যা। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নটির চিরতরে সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের প্রশ্নটি রয়েই গেছে। দুঃখ হয়, যখন দেখি, ৫১ বছর পরেও গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকারের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আরো অবাক ব্যাপার হলো, এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, অন্য কথায় জনগণকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতৃত্বাধীন দুইটি জোটই গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকারের কথা অবিরাম বলে যাচ্ছে। যখন বিএনপি পাওয়ারে থাকে তখন আওয়ামী লীগ বলে যে, দেশে গণতন্ত্র নাই। আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অনুরূপভাবে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে তখন বিএনপি বলে যে, দেশে গণতন্ত্র নাই এবং আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স বা স্ববিরোধিতা হলো যখন বিএনপি পাওয়ারে থাকে তখন আওয়ামী লীগ বলে যে দলীয় সরকার অর্থাৎ বিএনপি সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকার সরকার বা তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই দাবিতে আওয়ামী লীগ নিরন্তর আন্দোলন বা সংগ্রাম করে। সংগ্রামের অংশ হিসেবে তারা জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে, রাজপথে মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করে। আবার আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন বিএনপি বলে যে, দলীয় সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকার সরকার বা তত্ত¡াবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই দাবিতে বিএনপি নিরন্তর সংগ্রাম করে। এই সংগ্রামের অংশ হিসাবে দলটি এখন বিভাগীয় গণসমাবেশ পর্ব শেষ করে বিক্ষোভ মিছিল ও গণমিছিলের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচি যদি হরতাল বা অবরোধের পর্যায়ে যায় তাহলে আমরা বিস্মিত হবো না।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর যোগ করে এই ৭৫ বছর পর্যন্ত যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতার অর্থ কী? আমি অতীতের সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর অনেক বই-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। পত্রপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর হাজার হাজার প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এসব বই-পুস্তকের অনেকগুলো আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। তাছাড়া অনেক প্রবন্ধ ও নিবন্ধের পেপার কাটিংও আমার সংগ্রহে রয়েছে। তবে আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এত এত বই-পুস্তক এবং প্রবন্ধ নিবন্ধে ইতিহাস সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। সেইসব কথা বলতে গেলে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থই রচনা করতে হবে। অনেক পুস্তকের নামই তো বলা হচ্ছে। কিন্তু দুই একজন ব্যক্তি এবং দুয়েকটি পুস্তক এখনো আড়ালেই রয়ে গেছে। এগুলোর তেমন প্রচার হয়নি। এরমধ্যে ব্যক্তি হিসেবে রয়েছেন এমন একজন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যার অবদান অসামান্য। তিনি হলেন জনাব সিরাজুল আলম খান। আর তার যে পুস্তকটি রয়েছে, তার নাম ‘আমি সিরাজুল আলম খান/ একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’। লেখক শামসুদ্দিন পেয়ারা। আসলে শামসুদ্দিন পেয়ারা এই পুস্তকটির লেখক নন। সিরাজুল আলম খান বয়সের ভারে নুব্জ। এছাড়া অনেক রোগ বালাই তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। তাই সিরাজুল আলম খান ডিক্টেশন দিয়ে গেছেন এবং শামসুদ্দিন পেয়ারা লিখে গেছেন।
আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হলো, ভারত বিভক্তি বিশেষ করে বাংলার বিভক্তি। সেই সাথে পাঞ্জাবেরও বিভক্তি। আমি এখনও মনে করি যে, এসম্পর্কে সঠিক ইতিহাস আজও বিধৃত হয়নি। ভারতে জয়া চ্যাটার্জির মতো দুয়েক জন পÐিত এবং গবেষক সঠিক ইতিহাসের অনেক কাছাকাছি চলে গেছেন। কিন্তু তার পরেও ছোটখাট দুয়েকটি ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের ৫১ বছরের ইতিহাস কেউ কেউ রচনা করেছেন। প্রথমা প্রকাশনী একজন গবেষকের একাধিক বই প্রকাশ করেছে। ওই গবেষক সিরাজুল আলম খানের ওপর বই লিখেছেন, সিরাজ সিকদারের ওপর লিখেছেন, বিএনপি এবং জাসদের ওপর লিখেছেন। আওয়ামী লীগের ওপরও লিখেছেন। কিন্তু এই শেষের বইটি লেখার সময় তিনি একটি বিশেষ সময়ের মধ্যে আবদ্ধ থেকেছেন। তিনি সেই সময়ের গন্ডি পার হননি। এই ধরনের কাজ করে আর যাই হোক, সঠিক ইতিহাসবিদ হওয়া যায় না।
শেষ করবো একটি প্রশ্ন দিয়ে। এত বছর ধরে গণতন্ত্র আমাদের কাছে সোনার হরিণ হয়েই রয়েছে। এই হরিণটিকে কি আমরা ছুঁতে পারবো? ছুঁলে কি আসল হরিণের স্পর্শ পাওয়া যাবে? নীরদ চৌধুরী একজন আনপপুলার লেখক। কারণ, তার অটোবায়োগ্রাফিসহ একাধিক গ্রন্থে তিনি অনেক অপ্রিয় সত্য লিখেছেন। অরুন্ধতি রায়ও অনেক তিক্ত সত্য বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা একজন জয়া চ্যাটার্জি, একজন অরুন্ধতি রায় বা একজন নীরদ চৌধুরী কবে পাবো? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলুন বা গণতন্ত্রের সংগ্রাম বলুন, এসবের যতগুলি বয়ান আমরা পেয়েছি, তার সবগুলির মাঝে একটি হাইফেন রয়েছে। কবে সেই হাইফেন পূরণ হবে? কে সেই হাইফেন পূরণ করবেন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন