শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহান বিজয় দিবস সংখ্যা

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

নিরাভরণ অনুভূতি


বিজয় দিবস আসলেই বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে অনুরোধ আসে কিছু লেখার জন্য। যারা অনুরোধ করেন তারা ব্যক্তি স্বার্থে করেন না; অনুরোধটি আসে জনস্বার্থে। এই বাক্যটির একটু ব্যাখ্যা দিই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যাদের বয়স ত্রিশ বছরের নিচে ছিল তাদের বয়স এখন আশির নিচে। যাদের বয়স পাঁচ বছর ছিল বা যাদের জন্ম ১৯৭১-এ তাদের বয়স এখন চুয়ান্ন বা ঊনপঞ্চাশ বছর। যাদের জন্ম ১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত, তাদের বয়স পাঠক সমাজ কষ্ট করে হিসাব করতে পারেন। ১৯৭১ সালে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তারা এখন সংখ্যাগতভাবে দেশের জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু। বছরে একদিন বা দুইদিন বা পাঁচদিন রাষ্ট্র বা সমাজ বা তার অংশ আমাদেরকে সম্মান জানায়। নিশ্চিতভাবে সেনা অফিসার হলে সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল অথবা অন্যদের ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর দশ-বারো জন সদস্য সংবলিত একটি দল আমাদের মৃতদেহকে এবং বিদেহী আত্মাকে সম্মান জানায় জাগতিক নিয়মে, মৃত্যুর অব্যাহিত পরে; এটাকে বলা হয় গার্ড অব অনার প্রদান। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কি শুধু এতটুকুতেই সীমিত? আজকে আমি কোনো যুদ্ধের কথা লিখবো না; বরং মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু সাধারণ কথা যেগুলো অনেকেই জানে না বিধায় বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করে থাকেন সেরকম কিছু কথা লিখবো।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহর থেকে। একইসাথে তৎকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বা তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর বাঙালি সদস্যগণ, বা তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীর আগ্রহী সদস্যগণ, বা ছাত্র-জনতা হাতে যা কিছু ছিল তাই নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা নিঃসৃত হয়। মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওই মুহূর্তে বা ওই রাত্রে বা ওই সকালে বা এমনকি প্রথম দুইদিনে কে কোথায় কোন নিয়মে যুদ্ধ শুরু করলেন সেই খবর সকলের নিকট জানা ছিল না। কিন্তু, যেখানেই কোনো না কোনো সশস্ত্র দলকে কাছে পেয়েছে, সেখানেই জনগণ তাদেরকে কেন্দ্র করে নিজেদেরকে সংগঠিত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট দল গড়ে উঠেছে। অন্যত্র, নিজেদেরই উদ্যোগে সাহসী ব্যক্তিগণ নিজেদেরকে সংগঠিত করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সমন্বয়ের উদ্যোগ তৎকালীন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে প্রথম গৃহীত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ব্যাটালিয়নগুলোকে কেন্দ্র করে। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের আবাসস্থল বা বাংলোতে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রথম সমন্বয় সভা বা প্রথম অপারেশনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উপস্থিতগণের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম ছিলেন কর্নেল এমএজি ওসমানী। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর পক্ষ থেকে মেজর সফিউল্লাহ এবং মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আমি এত কনিষ্ঠ ছিলাম যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পর্যায়ের প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য ছিলাম না। আমি আমার তৎকালীন অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে একান্তভাবেই একজন অপারেশনাল সহকারী ছিলাম। আমাদের মতো কনিষ্ঠতম সেকেন্ড লেফটেনেন্টগণের অন্যতম কাজ হতো অধিনায়ককে সহায়তা করা। ওই সমন্বয় সভায়, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার একটি প্রাথমিক রূপরেখা স্থির হয় এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমটি স্থির হয়েছিল।
বিভিন্ন সেক্টরের এলাকা বিন্যাস
ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে আসা অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে আসা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ঢাকার সন্নিকটে জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে আসা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা এবং বাংলাদেশের আখাউড়া, এই দুটি শহরের মধ্যে দূরত্ব দুই কিলোমিটার। আখাউড়া একটি রেল জংশন শহর এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখার থেকে কোনোখানে দশ গজ, কোনোখানে একশত গজ দূরে অবস্থিত। আখাউড়া থেকে আট-দশ কিলোমিটার উত্তরে একটি বিন্দু চিহ্নিত ছিল। ওই বিন্দুর উত্তরে সীমান্ত রেখা অনুসরণ করে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল শহরের দক্ষিণে এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই শহরের উত্তরে সীমান্তরেখায় অবস্থিত বিন্দু পর্যন্ত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা নির্ধারিত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে এই এলাকাটি তিন নম্বর সেক্টর হিসেবে পরিচিতি পায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই সেক্টরগুলো চিহ্নিত হয়নি। কয়েকটি সেক্টরের বর্ণনা নিচের অনুচ্ছেদে আছে, সেক্টর কমান্ডারগণের নূন্যতম পরিচয়ও সঙ্গে সঙ্গে আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যেই সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগলিকভাবে ১১টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল। ১০টি অঞ্চল কার্যকর ছিল, ১টি অঞ্চল কার্যকর হয়নি। এই অঞ্চলগুলোকে সেক্টর বলা হতো। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ এলাকা পর্যন্ত সেক্টরগুলো বিভক্ত ছিল।
জিয়া ও মেজর রফিক
চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল ১ নম্বর সেক্টর এবং সেই ১ নম্বর সেক্টরে প্রথমেই যুদ্ধ শুরু করেছিল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং তৎকালে চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর উইং হেড কোয়ার্টারের এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বাঙালি ইপিআর সদস্যগণ। পরবর্তীতে ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হন মেজর রফিকুল ইসলাম। মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের নিকট বর্তমানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হিসেবে পরিচিত। এবং মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম জুন ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৮ এর শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, বর্তমানেও একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
মেজর খালেদ মোশাররফ
মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কেন্দ্র করে দুই নম্বর সেক্টর গড়ে উঠেছিল। এই সেক্টরটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ছিল এবং তাদের সাহসী কর্মকাÐের কারণে দেশে-বিদেশে প্রচুর পরিচিতি লাভ করেছিল। এই সেক্টরটির গেরিলা বাহিনীর প্রধান প্রশিক্ষক ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার। ক্যাপ্টেন হায়দার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রæপ বা সংক্ষেপে এসএসজি বা ‘কমান্ডো’ নামে সুপরিচিত বাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং সেখান থেকে পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগদান করেন। তৎকালীন ঢাকা মহানগর দুই নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাগণের দায়িত্বপূর্ণ এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিছুসংখ্যক দুর্র্ধর্ষ গেরিলাদেরকে, ঢাকা মহানগরের অভ্যন্তরে অপারেশনের জন্য, ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ হিসেবে সংগঠিত করা হয়েছিল। অন্যতম কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি। ঢাকা মহানগরের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদের সাবেক সভাপতি, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের বর্তমান সভাপতি, ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, মুক্তিযোদ্ধা খালেদ হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আহমেদ খান, মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা (শহীদ) বদিউল আলম বীর উত্তম প্রমুখ। মেজর খালেদ মোশাররফ পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অফ দি জেনারেল স্টাফ হয়েছিলেন এবং তিন দিনের জন্য সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত সময়ের অস্থিরতায়, একটি অপ্রীতিকর অবস্থায় তিনি এবং লেফটেনেন্ট কর্নেল এটিএম হায়দার একইসাথে একইস্থলে নিহত হয়েছিলেন। উভয়েই বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত।
মেজর সফিউল্লাহ
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ৩ নম্বর সেক্টর। মেজর কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক। অধিনায়ক মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে না পারায়, তিনি অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। তার পরপরই যেই বাঙালি অফিসার জ্যেষ্ঠতম ছিলেন তিনি হলেন তৎকালীন মেজর নুরুল ইসলাম (ডাক নাম শিশু)। এরপরে ছিলেন তৎকালীন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। তারপর ক্রমান্বয়ে একের পর এক ছিলেন ক্যাপ্টেন এএসএম নাসিম, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী, লেফটেনেন্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট আব্দুল মান্নান এবং সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ২৭ মার্চ ১৯৭১ যেদিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় সেদিন ইবরাহিম এর চাকরি ৬ মাস ২০ দিন মাত্র। ৩ নম্বর সেক্টর থেকে, জুলাই-আগস্ট ১৯৭১ এর সময়কালে যখন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে আবারও বের করে নিয়ে পুনর্গঠিত করা হয় তখন, তিন নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মেজর এএনএম নুরুজ্জামান এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হয়েছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও তিন নম্বর সেক্টর ...উভয় সংগঠন থেকে সহায়তা নিয়ে নতুন করে গঠন করা হয়েছিল এগারো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যার অধিনায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন মেজর এএসএম নাসিম। মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ বীর উত্তম পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিলেন, প্রায় সতেরো বছর বাংলাদেশের রাজধানীতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন বর্তমানে (২০১৯) সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের আহŸায়ক। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এডজুটেন্ট জেনারেল থাকা অবস্থায় ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রদূত হয়ে যান এবং প্রায় ষোলো বছর ঐরূপ ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। আট বছর আগে তিনি মরহুম। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা লেফটেনেন্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় মে-জুন ১৯৯৬ সময়কালে অপ্রতীকর পরিস্থিতিতে দায়িত্বচ্যুত ও চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বীর উত্তম বিডিআর এর মহাপরিচালক থেকে অবসরে যান। মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী জেনারেল নাসিমের সঙ্গেই চাকরিচ্যুত হন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম বগুড়ার জিওসি থাকা অবস্থায় ২০ মে ১৯৯৬ তারিখে অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন এবং যথাসম্ভব তারই উষ্কানীতে জেনারেল নাসিমও জড়িয়ে পড়েছিলেন।
সেই সময় জেনারেল মোর্শেদ বরখাস্ত হয়েছিলেন, বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পরিকল্পিত-নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ১৯৯৬ সালের মে-জুন মাসের অপ্রীতিকর ঘটনার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় বাধ্যতামূলক অবসর পেয়েছিলেন তখনকার আমলের যশোরের জিওসি মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। রাজনীতিতে ইবরাহিম এর বয়স বারো বছর, পত্রিকার কলাম লেখক ইবরাহিম এর বয়স ঊনিশ বছর, টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থিতির বয়স সতেরো বছর। ক্যাপ্টেন এএনএম নুরুজ্জামান ১৯৬৭-৬৮ সালে ইতিহাসখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন এবং পরে চাকরি হারান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় রক্ষী বাহিনীর প্রথম এবং একমাত্র মহাপরিচালক হয়েছিলেন; নভেম্বর ১৯৭৫-এর পরে রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন এবং ঐরূপ দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
জলিল, জিয়া, ওমর ও সুন্দরবন
ইতিহাস ও ভূগোলখ্যাত সুন্দরবন অঞ্চলসহ বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল নয় নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করা কোনো রেজিমেন্ট বা ব্যাটালিয়ন ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্মড কোর বা সাঁজোয়া বাহিনীর অফিসার মেজর এমএ জলিল ছুটিতে এসেছিলেন। ছুটি শেষে ফেরত না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। একইরকমভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোর-এর অফিসার ও আমার ব্যাচ-মেইট, তখনকার আমলের সেকেন্ড লেফটেনেন্ট জিয়াউদ্দিনও ছুটি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বা অবসরপ্রাপ্ত (ডাক্তার) মেজর জেনারেল শাহজাহান ছিলেন নয় নম্বর সেক্টরের অকুতোভয় সেনানায়ক। বীর শ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত নৌ বাহিনীর একমাত্র সদস্য রুহুল আমিন নয় নম্বর সেক্টরের দায়িত্বপূর্ণ অঞ্চলেই যুদ্ধ করেছেন। নয় নম্বর সেক্টরের বেশিরভাগ যুদ্ধ ছিল গেরিলা পদ্ধতির। যুদ্ধ শেষে, একমাস শেষ হওয়ার আগেই, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে, সদ্য সমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জলিলের অপরাধ ছিল, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। কিসের প্রতিবাদ? ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর পরবর্তী দিনগুলোতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বড় বড় ট্রাক ও লরি বোঝাই করে বাংলাদেশী অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য অনেক ভারী মেশিন ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কারো অনুমতি ও দুই দেশের সম্মতি ছাড়া; জলিল এই কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন দেশের স্বার্থে। জলিল প্রায় চার সপ্তাহ বন্দী ছিলেন যেখানে বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর-পশ্চিম কোনায় সাবেক পুলিশ কন্ট্রোল রুমের লম্বা ব্যারাক আছে, সেখানে। মেজর র‌্যাংকের কোনো অফিসারকে না পাওয়ায়, লেফটেনেন্ট ইবরাহিমকে নিযুক্ত করা হয়েছিল মেজর জলিলের পাহারাদার-অফিসার হিসেবে। ইবরাহিম এবং জলিল অসম বয়সের বন্ধু হয়ে পড়েছিলেন। কোর্ট মার্শাল-এর মাধ্যমে জলিলের বিচার করা হয়েছিল।
গেরিলা যুদ্ধ ও ক্র্যাক প্লাটুন
স্থানাভাবে সকল সেক্টরের বর্ণনায় আজকে যেতে পারছি না। অনেক জ্যেষ্ঠ সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আমরা বর্তমান প্রজন্মের সামনে নিতে পারি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কিছু সংখ্যক রাস্তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করেছেন। এখন মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আরেকটু কথা বলি। যুদ্ধ চলাকালে এক প্রকারের যোদ্ধা ছিলেন যারা নিয়মিত বাহিনীর সদস্য বা সেনাবাহিনীর সদস্য। তারা ব্যাটালিয়নে থাকতেন এবং ব্যাটালিয়নগুলোকে সম্মিলিতভাবে ব্রিগেড বানানো হয় এবং যুদ্ধ করা হয়। আরেক প্রকার নিয়মিত সদস্য ছিলেন যারা সেক্টর ট্রুপস হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারাও নিয়মিতভাবে যুদ্ধ করতেন কোম্পানী বা সাব-সেক্টর সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত থেকে। আর তৃতীয় প্রকারের যোদ্ধা ছিলেন যাদেরকে আমরা বলতে পারি গেরিলা-যোদ্ধা। পানির মধ্যে যেমন মাছ চরে বেড়ায়, এই গেরিলা যোদ্ধাগণ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে মিলেমিশে থেকে হানাদার বা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সহায়তা করেছেন দেশের ভেতরের আপামর জনসাধারণের বিরাট অংশ। সার্বিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহযোগিদের একটাই কামনা ছিল যে, কত দ্রæত বাংলাদেশকে শত্রæমুক্ত করা যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় যুদ্ধের কারণেই সাড়ে আট মাসের মাথায় এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, ভারতীয় মিত্র বাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে যেই অগ্রাভিযান চালু করে, সেই কাজটা অনেক সহজ হয়েছিল। এই কলামের শেষাংষে, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় দিতে গিয়ে, অন্য এক প্রকারের যোদ্ধার কথা না বললেই নয় তাদের নাম ছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ এবং সাধারণভাবে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত। তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল তৎকালীন ভারত সরকারের উদ্যোগে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে। বিএলএফ, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর নিয়ন্ত্রণে বাইরে ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, সংখ্যা ও মূল্যায়ন
৪৮ বছর আগে একবার ডিসেম্বর এসেছিল। এরপর প্রতি বছরই ডিসেম্বর এসেছে। এবারও এসেছে। যারা জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা, জীবিত আছেন বা নেই, তাঁদের সকলের প্রতি সম্মান। তার থেকেও বেশি সম্মান হাজার হাজার সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের প্রতি যাঁদের রক্তের বিনিময়ে, শ্রমের বিনিময়ে, ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু তাঁদের সেই ত্যাগ উপযুক্তভাবে মূল্যায়িত হয়নি।
১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের বিগত নয় মাসের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে লক্ষ কোটি শব্দে এবং অন্তরের অন্তস্থল থেকে অসীম ব্যাপকতায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করি যে, তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন এবং অন্তরকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করেছিলেন; তাই আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে, কোটি কোটি মুক্তিযোদ্ধার একজন। ১৯৭২ সাল থেকে নিয়ে আজ অবধি কমপক্ষে পাঁচ বার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বা সরকারের অনুমতিতে অন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক, মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশের পূর্বে যাচাই বাছাই করা হয়েছে বলে জানানো হতো। প্রত্যেকবারই মুক্তিযোদ্ধাগণের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে তথা কম বা বেশি হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে সকল বাঙালি সদস্য বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তাদের নামের তালিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে আছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দপ্তরদ্বয়ে, মুক্তিযোদ্ধা বিমান ও নৌ সেনাদের বা অফিসারদের তালিকা আছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর যে সকল ব্যাটালিয়ন মুক্তিযুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তাদের সংগে যোগ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা নিয়েও বিশেষ ঝামেলা নেই। ঝামেলা অন্যত্র তথা: দলীয় রাজনৈতিক কারণে তালিকাভুক্ত হওয়ার, বা তালিকাভুক্ত করানোর, বা তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা, অথবা মুক্তিযোদ্ধাগণের পারস্পরিক বৈরী সম্পর্কের কারণে কেউ কাউকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা, অথবা কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ভুলক্রমে বাদ যাওয়ায় সেই নামটিকে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টাকালে রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত বাধার সৃষ্টি, ইত্যাদি। অভিযোগ আছে যে, কোনোরকমেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, বা এমনকি পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, এমন প্রচুর সংখ্যক ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, তৎকালীন (১৯৭২) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এর স্বাক্ষর করা সনদ পত্র সংগ্রহ করেন অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদ পত্র সংগ্রহ করেন, যে কোনো নীতিবহির্ভুত পন্থায়। ১৯৭২ এর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক-প্রশাসনিক পরিবেশে এ কাজটি ঘটে যায়। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণের সংখ্যা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও গণযুদ্ধ
অস্ত্র নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তথা রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাগণই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা, একথাটি আমি কখনও বলি না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সম্প্রদায়ের মধ্যে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাগণ ছিলেন বর্শা-ফলকের আগার মতো, তরবারির ধারের মতো, বন্দুকের নলের মতো। কারণ তারাই ছিল যুদ্ধের ময়দানে প্রথম সারিতে। রণাঙ্গন শুধু দেশের সীমান্ত অঞ্চলে সীমিত ছিল না, দেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে অব্যাহতভাবে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাগণকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় মার্জিনালাইজড বা প্রান্তিককরণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এটাও বলতে হবে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণের যুদ্ধ বা গণযুদ্ধ। জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রæর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশের আপামর জনগণের জীবন হুমকির মুখে ছিল। জনগণের পক্ষে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাগণ সম্মুখ সমরে গিয়েছিলেন। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাগণ হাসিমুখে নিজেদের প্রাণ বিসর্জণ দিয়েছেন অথবা আহত হয়েছেন। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিলেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। সকল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাতো বটেই, বিশেষভাবে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাগণ কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধ করতে পারতেন না, যদি জনগণ সাহায্য-সহযোগিতা, প্রেরণা-উৎসাহ না দিতেন। নোট : সত্যের খাতিরে এটাও বলে রাখতে হবে, সুযোগ পেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করেনি এমন ব্যক্তি ও পরিবারও হাজার হাজার আছে। আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে আমার আবেদন, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নিখুঁত তালিকা প্রকাশের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হোক। দ্বিতীয় আবেদন, দেশব্যাপী, ইউনিয়নওয়ারি বা উপজেলাওয়ারি, ত্রিশ লক্ষ শহিদের নাম খোদাই করা মুক্তিযুদ্ধের শহিদ মিনার বা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হোক।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন