তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান রোববার আলজিয়ার্সে প্রতিবেশি লিবিয়ার ব্যাপারে বলেছেন, উত্তর আফ্রিকার দেশটি ‘অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ’। লিবিয়া এবং তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে দু’দিনের সফরের শুরুতে বিমানবন্দরে আলজেরিয়ান প্রধান ও পূর্ণ সরকারের অভ্যর্থনা লাভ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনে আবদুল মাজীদ তেবৌন আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সরকারি সফরে এখানে আসা প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন এরদোগান। বিমানবন্দর এবং প্রেসিডেন্ট ম্যানশনের মধ্যবর্তী পথে তুরস্কের নেতার প্রতিকৃতি শোভা পায়।
প্রাথমিক বেসরকারি বৈঠকের পর এরদোগান আলজেরিয়ার সাথে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার (৬০০ মাইলেরও বেশি) সীমান্ত নিয়ে লিবিয়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভ‚মিকার সমালোচনা করে বলেন, ‘তারা সিরিয়া এবং লিবিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে’।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এরদোগান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লিবিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে, এবং ‘আলজেরিয়া এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ’। তিনি তেবৌনকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আলজেরিয়া লিবিয়ার সঙ্ঘাতকে শান্তিতে রূপান্তরিত করার প্রয়াসে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। সেখানে দুটি প্রতিদ্ব›দ্বী সরকার বিদেশের দেশগুলির সহায়তায় নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে। তুরস্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ত্রিপোলি ভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকারের পক্ষ নিয়েছে, যা পূর্বে প্রতিদ্ব›দ্বী জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীনে ছিল। বিশ্ব শক্তিগুলি উভয় পক্ষকে একটি অস্থায়ী যুদ্ধের জন্য চাপ দিচ্ছে। আলজেরিয়া গত বৃহস্পতিবার লিবিয়া প্লাস মালির প্রতিবেশী দেশগুলির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের একটি বৈঠক ডাকে।
হাফতারকে মিসর, রাশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থন দেয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকার তুরস্কের পাশাপাশি কাতারের সহায়তায় রয়েছে। দীর্ঘদিনের লিবিয়ান নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে ২০১১ সালে পদচ্যুত ও হত্যা করার পর থেকে সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে।
উচ্চস্তরের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল নিয়ে আলজিয়ার্স বিমানবন্দরে অবতরণ করলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানকে স্বাগত জানান তার আলজেরিয়ান সমকক্ষ আবদুল মাজীদ তেবৌন। বার্তা সংস্থা এসপিএ একথা জানায়।
ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রাকালে উত্তর আফ্রিকান দেশটির বৃহত্তম বিনিয়োগকারী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সাংবাদিকদের বলেন ‘আমরা আলজেরিয়ায় একটি ব্যবসায়িক সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছি’।
তিনি আফ্রিকা সফরের প্রথম পর্বে যাত্রার আগে বলেন, ‘আমরা আমাদের অঞ্চলে বিশেষত লিবিয়ার সর্বশেষ ঘটনাবলী নিয়েও আলোচনা করতে যাচ্ছি’।
তুরস্ক লিবিয়ার জাতিসঙ্ঘ-অনুমোদিত স্বীকৃত জাতীয় সরকার (জিএনএ) কাছে সামরিক সহায়তা প্রেরণ করেছে, যার যোদ্ধারা সামরিক শক্তিশালী খালিফা হাফতারের অনুগত বাহিনীর বিরুদ্ধে গত এপ্রিল থেকে যুদ্ধে লিপ্ত।
আলজিয়ার্স এ যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভ‚মিকা পালনের অংশ হিসাবে গত সপ্তাহে লিবিয়ার প্রতিবেশীদের একটি বৈঠক করেছে যেখানে ‘কোনও বিদেশি হস্তক্ষেপ’ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং আলোচনার সমাধানের আহ্বান জানানো হয়।
বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা লঙ্ঘন করছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, লিবিয়ায় সর্বশক্তি দিয়ে হামলা চালাচ্ছে হাফতার বাহিনী। তবে তারা সফল হবে না। এ বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এরদোগান বলেন, হাফতার বাহিনী দফায় দফায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন তাকে ধ্বংসাত্মক ভ‚মিকায় নিয়ে এসেছে। আমাদের দেখতে হবে, হাফতারের পরিচয় কী? তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি এর আগেও তার ঊর্ধ্বতনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এমন মানুষের কাছে যুদ্ধবিরতি চলাকালেও বোঝাপড়া আশা করা যায় না। গত ৯ মাস ধরে লিবিয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার ও হাফতার বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। স¤প্রতি তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেশটির জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকার। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর না করেই মস্কো ছাড়েন খলিফা হাফতার। এ ঘটনায় এরদোগান বলেছেন, খলিফা হাফতার ও তার বাহিনী যদি লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবে আঙ্কারা। কেননা, লিবীয় স্বজনদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, লিবিয়ার সাথে তুরস্কের ঐতিহাসিক ও সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে। আঙ্কারা হস্তক্ষেপ না করলে হাফতার পুরো দেশটি দখল করে ফেলত। এর আগে জানুয়ারির গোড়ার দিকে ত্রিপোলিতে সেনা মোতায়েনের জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে তুরস্কের পার্লামেন্ট। হাফতার বাহিনীর হামলা মোকাবেলায় লিবিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত অনুরোধ পাওয়ার পর ওই প্রস্তাব পাস করে তুর্কি পার্লামেন্ট। জীবনযাপনের মানের দিকে থেকে তেলসমৃদ্ধ লিবিয়া একসময় আফ্রিকার শীর্ষে ছিল। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রের দায়িত্বে। তবে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ওই ঐশ্বর্য নিশ্চিত করেছিল, সেটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় ২০১১ সালে যখন পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহীদের হাতে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। তারপর থেকে লিবিয়ায় চলছে সীমাহীন সঙ্ঘাত। গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর ত্রিপোলিতে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত একটি মনোনীত সরকার রয়েছে। ওই কর্তৃপক্ষকে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা জিএনএ নামে অভিহিত করা হয়। তবে দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে রয়ে গেছে। পশ্চিমাঞ্চলে জিএনএ-এর কর্তৃত্ব থাকলেও পূর্ব ও দক্ষিণের বেশির ভাগ অঞ্চল হাফতার বাহিনী এলএনএ-এর দখলে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে এ বাহিনী লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে লিবিয়ায় দু’টি সরকার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সূত্র : নিউজ রিপাবলিক, আনাদোলু ও রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন