ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : শহরের টাকা যাচ্ছে গ্রামে। ঈদকে সামনে রেখে রোজা শুরুর পরই গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। নানা মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসরতরা স্বজনদের জন্য এই অর্থ গ্রামে পাঠাচ্ছেন। দেশের বাইরে থাকা আসা রেমিটেন্সের অধিকাংশই যাচ্ছে গ্রামে। প্রবাসীরা গ্রামের স্বজনদের কাছে ঈদের সময়েই বেশি অর্থ পাঠান। এ ছাড়া যাকাত ফেতরার পুরো অর্থই গ্রামমুখী। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে খরচ বাড়ায় গ্রাম ভিত্তিক অর্থনীতি এখন চাঙ্গা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে শহরে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা চার কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার। দৃশ্যমান বাস্তবতা হচ্ছে- এদের বড় একটি অংশ স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে ইতিমধ্যে গ্রামে গেছেন। এরা বাড়তি খরচের কথা চিন্তা করে গ্রামে যাওয়ার আগে থেকেই সাধ্য অনুযায়ী সঞ্চয় ভেঙে এবং বেতন-বোনাস বাঁচিয়ে সঙ্গে করে প্রচুর টাকাকড়িও নিয়ে গেছেন। এসব টাকা এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রামেই হাতবদল হচ্ছে। অন্যদিকে ৮৬ হাজার গ্রাম নির্ভর এ দেশের প্রতিটি গ্রামের মহল্লাতে ৫ থেকে ৭টি এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের কোনো না কোনো সদস্য প্রবাসে থাকেন। জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত এসব প্রবাসীরা ঈদ উৎসবের পরিবারের চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।
অবশ্য গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এই রেমিটেন্সের ওপর ভর করে এমনিতেই গ্রামের পরিবারকেন্দ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ঈদ উপলক্ষে নিয়মিত রেমিটেন্সের বাইরে এখন অতিরিক্ত রেমিটেন্সের টাকাও গ্রামের অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে। এছাড়া একই কারণে শহর-গ্রামের ধনীদের টাকাও সিন্ধুক থেকে ফেতরা ও যাকাত হিসেবে বের হতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক নেতাদের দান-খয়রাত এবং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অনুদান। এর বাইরে গ্রামের দোকানিদের ঈদকেন্দ্রিক বাড়তি মুনাফাও যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে আর এভাবেই চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে দীর্ঘদিন ঝিমিয়ে থাকা গ্রামের অর্থনীতি। নাড়ির টানে ঈদ উদযাপন করতে লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরা এবং এদের সবার পদচারণায় ঈদের সপ্তাহখানেক আগে-পরে মাঝের এই ১৫ দিন সময় মুখরিত থাকে গ্রাম। এর ফলে এই সময়টাতে গ্রামে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে যোগান এবং দামও। মূলত এই বাড়তি চাহিদা এবং যোগান সক্ষমতাই গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী বলেছেন, ঈদের আগে-পরে গ্রামে টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বাড়ে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই টাকার ব্যবহার পোশাক, ভোগ্যপণ্য, সৌখিনতা ও ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতেই বেশি হচ্ছে। কাজেই এটা একটা বড় ভূমিকা রাখে অর্থনীতিতে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চলতি বছর এমন সময়ে রোজা শুরু হয়েছে যখন সরকারি চাকরিজীবীরা সবেমাত্র বেতন পেয়েছেন। বেসরকারি চাকরিজীবীরাও বেতন পেতে শুরু করেছেন। বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে এ রমজানে বাড়তি খরচ হয়ে থাকে। এ কারণে গ্রামের স্বজনদের ভালো থাকা-খাওয়ার প্রত্যাশায় অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি টাকা পাঠিয়েছেন। যার লেনদেন গড়িয়েছে স্থানীয় হাট-বাজার ও দোকানপাটে।
দেশে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ তথ্যমতে, এ শিল্পে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এসব শ্রমিকের ৯৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা। যার ৭০ শতাংশই ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যায়। যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই তারা টাকা জমাতে থাকে। এর সঙ্গে এবার শ্রমিকরা ঈদের মাসের জুন মাসের বেতনসহ বোনাস নিয়ে বাড়ি যাবেন। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, তাদের এক মাসের বেতন ও সঙ্গে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বোনাসের টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এবার গ্রামের অর্থনীতিতে নতুন বিশেষত্ব যোগ করেছে সরকারি চাকরিজীবী ও পেনসনভোগীরা ঈদ-উৎসব ভাতা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বেতন স্কেলের হিসেবে। এর ফলে এবার তারা আগের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বোনাস হিসেবে পাবেন। একই সঙ্গে এবার ঈদে দীর্ঘ ৯ দিনের ছুটি থাকায় এসব চাকরিজীবীরা লম্বা ছুটি কাটাতে গ্রামে যাওয়ায় গ্রামে ভোগব্যায়ের পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এবার ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে প্রবাসীরা প্রচুর রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। শুধু চলতি জুনেই বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১১৩৬.০০ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। এসব রেমিটেন্সের সিংহভাগই গেছে গ্রামে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চিরায়ত এ উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অংকের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকা- যেমন বাড়বে, তেমনি চাঙ্গা হয়ে উঠবে গোটা অর্থনীতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোজার অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এগুলো এখন খুচরা বাজারে বেচা-কেনা হচ্ছে।
ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে। মার্কেটগুলোতে ছেলে-মেয়ে আবাল-বৃদ্ধ জনতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাক বেচা-কেনা হচ্ছে। এ সময় অভ্যন্তরীণ পোশাকের চাহিদা বাড়ে ব্যাপক হারে। এ ছাড়া ঈদ উৎসব পালন করতে রোজার শেষ দিকে শহরের অধিকাংশ মানুষ যান গ্রামের বাড়িতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন