একুশ বাঙালির আত্মার অনুধাবন। একুশ বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। একুশের কারণে বাঙালি আজ নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল। একুশ বাঙালির- অহংকার, অনুপ্রেরণা, চেতনা, সত্তা, প্রাণের স্পন্দন। বাঙালির বাংলা ভাষার ইতিহাস স্বল্প সময়ের মধ্য সীমাবদ্ধ নয়। অনেক প্রাচীন এর ইতিহাস। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মধ্য এশিয়ার পশ্চিম এবং ইউরোপীয় মধ্যবর্তী-স্থান থেকে দক্ষিন-পূর্বাংশ ভ‚খণ্ডের মধ্য একটি জাতি বসবাস করত। তারা একই ভাষায় সাধারণত কথা বলত। তার নাম দেওয়া হয় ইন্দো-ইউরোপীয় (আনুমানিক ৫০০০ পূর্ব খ্রি.) মূল ভাষা। যার দুটি শাখা। যথা- কেন্তম ও শতম। ‘শতম’ শাখার ইন্দো- ইরানীয় বা আর্য এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম কর আজ আধুনিক যুগে বাংলা ভাষা আমাদের সম্মুখে। আমরা বলতে পারি বাংলা ভাষার বীজটি সেই স‚দুর প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ভেতরই প্রোথিত ছিল। যা স্বমহিমায় দীপ্ত।
বাঙালিরা এলোমলো নানা বর্ণের মেলবন্ধনে তৈরিকৃত শব্দে গঠন করে বাক্য। এ বাক্য হয়ে যায়- কারো ক্ষোভের, কারো ভালোবাসার, কারো ঘুমের ঘরের স্বপ্ন-জাল, কারো বেদনার। বাঙালির এভাবে প্রবহমান ভাষার স্রোতস্বিনীর মাঝে বাধ হয় পাকিস্তানি জারকরা। প‚র্ব বাংলার সর্বত্র “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই জ্বালাময়ী ধ্বনিতে মুখরীত করে তোলে ছাত্র-সমাজ এবং ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছাত্র-জনতা জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে যায়। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর ও জবারসহ নাম না জানা অনেকগুলো শহিদের তাজা প্রাণের তাজা রক্তে পিচঢালা রাজপথ ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ -রক্তের আলপনা এঁকে যায়। আমরা পেয়ে যাই আমাদের অস্তিত্বের ভাষা। শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরাই এভাষায় কথা বলে পিপাসা মেটানোর জন্য রক্ত দেননি। ১৯৬১ সালে ১৯ মে ভারতে আসাম রাজ্যেও “রাজ্যভাষা বাংলা চাই” এই স্লােগানে মুখরীত হয়। সেই দিন ভারতের আসামের বারাক উপত্যকার শীলচরে ১১ জন বাঙালি প্রাণ দিয়েছে- প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য। এছাড়াও ১৯৭২ সালে জুলাই মাসে বাংলা ভাষার জন্য আবার রক্ত দেয় বাংলা ভাষা পাগল সেই আসামের করিমগঞ্জে বাঙালিরা। প্রতিবারই এই বাঙালি জয় লাভ করে তাদের প্রাণের স্পন্দন, তাদের প্রাণের ধ্বনি অর্জন করতে।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি পায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। প্রতি বছর এই তারিখে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করছে পৃথিবীর ১৯০টি দেশ। । এটা অবশ্যই বাঙালি হিসাবে আমাদর অনেক গর্বের। আজ বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, উরিষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের জনগণের ভাষা বাংলা। এ ছাড়া বিশ্বের নানান দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষের বর্তমান মুখের ভাষা বাংলা। আমরা বলতে পারি, পাকিস্তানদের এদেশ থেকে বিতাড়িত বা পরাজয়ের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজটি ঐ একুশের ভাষা আন্দোলনের জয়ের ভেতরই রোপিত ছিল। বাঙালির অহংবোধে একুশ চির উজ্জ্বল থাকবে সর্বদা।
তবে আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের রক্তে অর্জিত ভাষার কদর কতটুকু তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। যে ভাষা হাজার বছর পূর্বে থেকে আমাদের শিকড়ের সাথে, আমাদের সত্তার সাথে জড়িয়ে আছে; তার বর্তমান অবস্থান দেখলে সত্যি হতাশ হতে হয় আমাদের। এর জন্য বেশি দায়ী অপসংস্কৃতি। আমরা মনে করি, প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে বিদেশি ভাষায় কথা বলাটা একধরনের পান্ডিত্য। আজ আমরা আমাদের ভাষার সাথে বিদেশি ভাষা মিশ্রণ করে বলতেও দ্বিধা করিনা। আজ সর্বত্র বাংলা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ লেখার বড় সংকট চলছে। এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু থাকা সত্তে¡ও মাত্র হাতগনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু আছ। তা আবার একরকম অবহেলার মতো। কেন এখনো সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়নি? কেন বাংলা ভাষা এখন অবহেলিত থাকবে? এজাতীয় প্রশ্ন আজ জাতির কাছে লজ্জা বহন করে, কষ্ট বহন করে, ঘৃণা বহন করে।
এর থেকে অবশ্যই আমাদর বেড়িয়ে আসতে হবে। ’৫২তে যেমন সালাম, রফিক, শফিক, জব্বাররা নিজের মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি ভাষা অর্জনের ৬৮ বছর পর সেই ভাষা সর্বত্র ব্যবহারের প্রতিষ্ঠার জন্য আজ আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা শুধু ফেব্রুয়ারি বা লোক দেখানোর যেন না হয়। তা যেন হয় বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবেসেই। তাই বলব, যে ভাষার ইতিহাস সংকীর্ণ নয়, যে ভাষা রক্তে রঞ্জিত, যে ভাষা দেশের সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদাপ্রাপ্ত, যে ভাষা অন্যদেশের জনগণের মুখের ভাষা সে ভাষা অবজ্ঞা করবেন না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন