শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষাখাতের নাজুক চিত্র

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ‘প্রাথমিক সমাপনীতে ঝরে পড়ার হার ২০১৪ সালে ২৪.৩%, ২০১৫ সালে ২৩.৯%, ২০১৬ সালে ১৯.২%, ২০১৭ সালে ১৮.৮%, ২০১৮ সালে ১৮.৬% ও ২০১৯ সালে ১৭.৯%।’ বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ২০১৪ সালে ৪১.৫৯%, ২০১৫ সালে ৪০.২৯%, ২০১৬ সালে ৩৮.৩০%, ২০১৭ সালে ৩৭.৮১%, ২০১৮ সালে ৩৭.৬২%। আর চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০ লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ। উচ্চ পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার আরও অনেক বেশি। অথচ সা¤প্রতিককালে প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২.২০ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে, শিক্ষার হার ৭৩% হয়েছে, বছরের প্রথম দিনেই সব শিশুকে বিনামূল্যে সব বই প্রদান করা হয় বলে সরকার দাবি করে। এসব নিয়ে অনেকেই গর্বও করেন। অপরদিকে, বিবিএস ও ইউনিসেফ এর ‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ১৩% কিশোর-কিশোরী নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। আর ১৫-২৪ বয়সী মানুষের শিক্ষার হার ৮৮.৭%। যা’হোক, প্রাথমিকে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ঝরে পড়তে থাকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। ঝরে পড়তে পড়তে শেষাবধি এক চতুর্থাংশ থাকে না! এর কারণ- দারিদ্র্য, বাল্য বিবাহ, নারীদের নিরাপত্তার অভাব, বেকারত্ব, শিক্ষা ব্যয় বেশি ইত্যাদি

দেশে নিরক্ষরতার হার অনেক। বিবিএস প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক-২০১৮ অনুযায়ী, ‘দেশে ২৫-৬০ বছর বয়সের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৭% নিরক্ষর।’ ২৫ বছর বয়সীর চেয়ে কম বয়সের মানুষের নিরক্ষরতার হার কত? বিশ্বব্যাংকের ‘এন্ডিং লার্নিং পভার্টি: হোয়াট উইল ইট টেক?’ শীর্ষক প্রতিবেদন-২০১৮ মতে, ‘বাংলাদেশের ৪.৯% শিশু এখনো বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়গামী একজন শিক্ষার্থীর যা শেখার কথা, তার ন্যূনতমও শিখতে পারছে না ৫৬% শিক্ষার্থী। সব মিলে বাংলাদেশের ‘লার্নিং পভার্টি’র হার ৫৮%’। অথচ ‘লার্নিং পভার্টি’ কমিয়ে আনার বিষয়টি এসডিজি ৪-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বিশ্বব্যাংক ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ‘শিক্ষা দারিদ্র্য’ অর্ধেকে নামিয়ে আনার টার্গেট করেছে। এখন দেখা যাক, দেশে সাক্ষরতার হার কত এবং তার অবস্থা কী? সরকার সাক্ষরতার হার যা বলে, বেসরকারিভাবে তার সাথে দ্বিমত করা হয়। দ্বিতীয়ত আগে সাক্ষরতার মানদন্ড ছিল- নাম লিখতে পারলেই সে সাক্ষর। কিন্তু বর্তমানে সে মানদন্ড পরিবর্তন করে বলা হচ্ছে, লিখতে ও পড়তে পারা এবং তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণাসম্পন্নই কেবল সাক্ষর। সে মতে, দেশের নিরক্ষরদের মধ্যে প্রকৃত সাক্ষর নগণ্য। কারণ, যারা সাক্ষর হয়,তাদেরও বেশিরভাগই কিছুদিন পর সবকিছু ভুলে যায় চর্চার অভাবে। সর্বোপরি বয়স্কদের সাক্ষরতার আওতায় আনার কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
ঝরে পড়া, শিক্ষা দরিদ্র ও নিরক্ষর মিলে দেশের প্রায় ৮০% মানুষ অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের অভিমত: ‘কেবল ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রায় ৪৬% লোক মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেছে এবং একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের (৪%) উচ্চস্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগে অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত মানুষ প্রায় অচল। এখন দেখা যাক যারা শিক্ষিত, তাদের অবস্থা কী?

দেশের শিক্ষার মান অতি নিম্ন। স্বাধীনতার পর থেকে অটো পাশ, নকলে পাশ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষকদের অদক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষক, অবকাঠামো, ল্যাবরেটরি, অনুকূল পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মান কমতে কমতে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে! বিশ্বব্যাংকের গত বছরের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাথমিকের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা তার চাইতেও বেশি। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার সুফল তেমন নেই। শিক্ষার এই মানহীনতার জন্য বেশিরভাগ শিক্ষকের যেমন অদক্ষতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব আছে, তেমনি স্বল্পতাও আছে। এছাড়া, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও পরিবেশেরও ঘাটতি আছে ব্যাপক। গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৮,৮৩২ শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে’। এছাড়া, শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষাবহির্ভূত ১২-১৪ ধরনের সরকারি কাজ করানো হয়। ফলে শিক্ষকদের পাঠদান ব্যাহত হয়। এভাবে প্রাথমিকে শিক্ষার মান অতি নিম্ন, যার প্রভাব পড়ে পরবর্তী পর্যায়সমূহে। তাই প্রাথমিকের ন্যায় মানহীনতা পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে অতি নিম্ন। এর প্রভাব পড়ছে কর্মজীবনে। অর্থাৎ আউট পুট ভাল হচ্ছে না। বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতা সূচকে বাংলাদেশ তলানিতে। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, কূটনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শিক্ষা খাতেরই কয়েকটি ঘটনার কথা বললেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভুল প্রশ্ন বিতরণের পর এবার আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বোর্ড। প্রথম দিনই বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় অনেক জেলায় ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণের ঘটনার মধ্যে গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়ার ঘটনা নিয়েও চলছে বিতর্ক। গত ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে এসএসসির বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় কয়েকটি কেন্দ্রে ২০২০ সালের নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের ২০১৮ সালের অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়। এতে বিপাকে পড়ে পরীক্ষার্থীরা। হবিগঞ্জের কয়েকটি কেন্দ্রে প্রশ্নের মাঝে উত্তর লিখে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহের অপরাধে কেন্দ্র সচিবসহ ৩ শিক্ষককে ৬ মাসের কারাদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার ও উন্নয়নে ১৬৪ জন কর্মী নিয়োজিত থাকলেও পরীক্ষায় অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির বিষয়ে ৯.২৬ লাখ শিক্ষক ও কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পেলেও এর সুফল মিলছে না। রংপুর বিভাগের ৩৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৩১টি বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষক ২১টি ও সহকারী শিক্ষকের ১৮৫টি পদও শূন্য রয়েছে। এভাবে সারাদেশেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিপুল পদ শূন্য আছে। তদ্রুপ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও অসংখ্য শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। সব মিলে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের শূন্য পদ লাখ ছাড়িয়েছে। এছাড়া, প্রশাসনিক লোকবলেরও ব্যাপক ঘাটতি আছে। দেশের ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের দায়িত্বে আছেন ২৩ কর্মকর্তা। এর মধ্যেই গত দেড় মাস ধরে সব ধরনের পরিদর্শন কার্যক্রম বন্ধ। অথচ দেশে বিপুল উচ্চ শিক্ষিত মানুষ বেকার আছে। তবুও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণে। অপরদিকে, বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোরও অবস্থা তথৈবচ। ইউজিসি’র ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে মতে, ‘পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের তোয়াক্কা করছে না দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে এখনও ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে। শিক্ষার্থী ভর্তিতে মানছে না অনুমোদিত আসন সংখ্যা। ভিসি-প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধানও মানা হচ্ছে না। মিটিং আর নানা কেনাকাটার আড়ালে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। এর মধ্যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দই রাখা হয়নি। শিক্ষার্থী ভর্তি, ক্লাস-পরীক্ষা আর সার্টিফিকেট প্রদান করেই দায় সারছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। উপরন্তু ২০১৮ সালে ৮৫% বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই আইন মেনে আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব জমা দেয়নি। নামে-বেনামে নানা সুবিধা ভোগ করছেন ট্রাস্টিরা। শিক্ষার্থীদের বেতন-ফির টাকায় গাড়ি-বাড়ি বিলাস কিংবা উচ্চ বেতন গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। আর এসব অনিয়ম ঢাকতেই ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছে না’। এই অবস্থায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান আন্তর্জাতিক মানের নয়। কিউএস এর ২০১২ সালের জরিপে ঢাবি’র বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৬০১তম। ২০২০ সালে তার অবস্থান হয়েছে ৮০১তম। আর এসআইআর’র ২০১২ সালের জরিপে বুয়েট’র বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৭২৫তম। ২০১৯ সালে তার অবস্থান হয়েছে ৭৫৬তম। শুধুমাত্র ঢাবি ও বুয়েটই নয়, মানের দিক থেকে কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক সূচকে নিম্নগামী দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ২০০৯-১৮ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নেয়া হয়েছে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হেকেপ। তবুও এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সূচকে দেশের উচ্চশিক্ষার মান তেমন বাড়েনি; বরং কয়েকটি সূচকে কমেছে। কারণ, গোড়ায় গলদ রেখে উচ্চ পর্যায়ে শত চেষ্টা করলেও লাভ হয় না। অপরদিকে, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশাসনে রয়েছে হযবরল অবস্থা।প্রথম শ্রেণিতে এক বছর হবে, না দুই বছর হবে, প্রাথমিকের শিক্ষার স্তর ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে, না ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত হবে, এইচএসসি পর্যন্ত গ্রেডিংয়ের সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ থাকবে, না জিপিএ-৪ করে উচ্চ শিক্ষার সাথে সমান্তরাল করা হবে, বহুমুখী শিক্ষা থাকবে, না একমুখী করা হবে, এসব নিয়ে চলছে দীর্ঘদিন যাবত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিন্তু কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া, সেকেল শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে যে, কর্মমুখী করতে হবে, সেদিকে কোন গুরুত্ব নেই। তদ্রুপ শিক্ষা নীতি/আইন বাস্তবায়ন করার দিকেও তেমন গুরুত্ব নেই। তেমনি গুরুত্ব নেই শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে।

দেশের শিক্ষা খাতে বর্ণিত নাজুক পরিস্থিতির কারণে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি হচ্ছে না। গত ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত ইউনিসেফের তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশের মোট তরুণ সমাজের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২৬% দক্ষতা অর্জন করেছে’। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের অভিমত: ‘আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরে দক্ষতার প্রশিক্ষণগুলোতে অংশগ্রহণ নগণ্য। জনসংখ্যার মাত্র ২.১% আনুষ্ঠানিক স্কুলিং সিস্টেমের বাইরে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। এই জায়গাগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আর পরিবর্ধন সাধন না করতে পারলে বিদেশি দক্ষ শ্রম-নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কখনও খুলবে না।’ উল্লেখ্য যে, বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের সর্বত্রই বেশিরভাগ কাজ ও কথা ইংরেজিতে হয়। তবুও এ দেশের উচ্চ শিক্ষিতদেরও বেশিরভাগই ইংরেজিতে অদক্ষ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এডুকেশন ফার্স্ট গত বছর প্রথম ভাষা ইংরেজি নয় এমন ১০০টি দেশে জরিপ চালিয়ে ইংরেজি দক্ষতার সূচক তৈরি করেছে। তাতে ৪৮.১১ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ তালিকায় ৭১তম, দক্ষতার শ্রেণি হিসেবে যা খুবই নিম্ন। এ তালিকায় ভারত ৩৪তম (স্কোর ৫৫.৪৯), নেপাল ৬৬তম (স্কোর ৪৯)। অথচ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৮.৭২। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদদের অভিমত: ‘প্রাথমিক স্তর থেকেই দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ভীতি তৈরি হচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষকের অভাব ও দুর্বল পাঠক্রমের কারণে পরবর্তী ধাপগুলোতে এ দুর্বলতা আর কাটিয়ে উঠতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। ইংরেজিতে দুর্বলতা নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করছে তারা।’ যা’হোক, শিক্ষার মান বৃদ্ধির চেয়ে অনৈতিকভাবে শিক্ষার হার বৃদ্ধির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সামাজিক উত্তরণ সূচক ২০২০ এর মূল্যায়ন হচ্ছে: ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জীবনভর শিক্ষার সুযোগে। এ উপসূচকে ৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮২তম। শিক্ষকদের দুর্বল প্রশিক্ষণ, বাজার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষানীতির অভাব, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবের কারণে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে আছে। গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের চেয়ে বেশ পিছিয়ে।’ এছাড়া, শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষ তা নির্বাহ করতে পারছে না। ফলে, তাদের সন্তানদের শিক্ষার মান নিম্নতর হচ্ছে।

দেশের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত। আর যারা শিক্ষিত, তাদেরও শিক্ষার মান নিম্ন। সর্বোপরি সে শিক্ষা সেকেলে-কর্মমুখী নয়। তাই একদিকে বেকারত্ব সর্বোচ্চ হয়েছে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকের অভাবে সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ টিকতে পারছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অভিবাসনের ক্ষেত্রেও তাই। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট- ২০২০’ অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসীর সংখ্যা ২৭.২০ কোটি। এর মধ্যে ৭৮ লাখ প্রবাসী নিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু রেমিট্যান্স আয়ের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। অদক্ষতার কারণেই বিদেশে বাংলাদেশিদের মজুরী অনেক কম, অন্য দেশের শ্রমিকের তুলনায়। তাই রেমিট্যান্সের পরিমাণও কম। অন্যদিকে, দেশেও দক্ষ লোকের প্রচন্ড অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি দক্ষ লোক নিয়োগ করেছে, যার সংখ্যা ১০ লাখের বেশি এবং তার বেশিরভাগই অবৈধ। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ডয়চেভেলের খবরে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশে কম করে হলেও পাঁচ লাখ ভারতীয় কাজ করে। এর পরেই শ্রীলঙ্কা ও চীনের অবস্থান৷ তবে মোট বিদেশির কমপক্ষে অর্ধেক ভারতীয়। বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জানান, ‘প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে চার-পাঁচ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ দেশে যে রেমিট্যান্স আসছে তার প্রায় এক তৃতীয়াংশই চলে যাচ্ছে। স্মরণীয় যে, দক্ষতার অভাবের কারণে বৈশ্বিক আউটসোর্সিংয়ের বিশাল বাজারেরও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না তেমন। গত বছর এ খাতে আমাদের আয় মাত্র ১০ কোটি ডলার। এই অবস্থায় চলতি বছরে দেশে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা হবে ৭ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার বলে জানা গেছে। অথচ এই বিপুল সংখ্যক দক্ষ লোক দেশে নেই! যে সামান্য দক্ষ লোক তৈরি হচ্ছে, তারও বেশিরভাগ চলে যাচ্ছে বিদেশে (যার ক্ষতি বিপুল অর্থ পাচারের ক্ষতির চেয়ে কম নয়)। আর যাদের বিদেশে যাওয়ার সামর্থ নেই, তারাই থেকে যাচ্ছে দেশে, যাদের সংখ্যা সামান্যই। এই সামান্য দক্ষ লোক দিয়ে ছোট্ট দেশে বিশাল জনগোষ্ঠির কাক্সিক্ষত সার্বিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নতি কি করা সম্ভব? তাও আধুনিকতা (ম্যানুয়াল থেকে মেশিন ও প্রযুক্তিতে রূপান্তর), বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট, ভয়াবহ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, জটিল ও কুটিল আমলাতন্ত্র ও বিশ্বের সর্বাধিক আয় বৈষম্য এবং বেশিরভাগ অদক্ষ লোক ইত্যাদি মোকাবেলা করে? মোটেও না। তাই দেশের কাক্সিক্ষত পরিবেশ বান্ধব সার্বিক উন্নতির জন্য দেশের মানুষকে দক্ষ করে তুলতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন আধুনিক কর্মমুখী শিক্ষা।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৮ সালের তথ্য মতে, দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের হার মাত্র ১৪%। তবে বাস্তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটি মূলত ৮.৪৪%। উপরন্তু এই শিক্ষার মানও আশানুরূপ নয়। কারণ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও ল্যাবরেটরি নেই। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবশ্য শিক্ষা উপমন্ত্রী গত ৫ ফেব্রæয়ারি বলেছেন, বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার হার ১৭%। সকল শিক্ষার্থীকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ ও পরিধি বাড়ানো হবে। প্রতিটি সাধারণ ধারার বিদ্যালয়ে কমপক্ষে দুটি বৃত্তিমূলক ট্রেড চালু করা হবে। এছাড়া, সম্প্রতি উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় ২০,৫২৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। সরকার দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ২০২১ সালের আগেই কারিগরি শিক্ষার হার ২০%, ২০৩০ সালে ৩০% এবং ২০৪০ সালে ৪০% করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া, সরকার ৫টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করছে। তন্মধ্যে ৩টিতে শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারই ভর্তি হতে পারবে। হ্যাঁ, এসব উদ্যোগ ভালো ও সময়োপযোগী। কিন্তু উদ্যোগ যতই ভালো হোক না কেন, তা যদি সঠিক সময়ে ও মানসন্মতভাবে বাস্তবায়ন না হয়,তাহলে তার সুফল পাওয়া যায়না। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এতগুলো কারিগরি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ শিক্ষক পাওয়া যাবে কি-না। কারণ, দীর্ঘদিন যাবত বিজ্ঞান, ইংরেজি, অংক ও আইটি বিষয়ে অসংখ্য শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। এছাড়া, ক্লাসে মাল্টিমিডিয়া ও কম্পিউটার চালু করা যাচ্ছে না বহু শিক্ষাঙ্গনে। কারণ, উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। সায়েন্সে পড়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। কারণ, যেখানে সাধারণ বিষয়ের পড়ুয়া কর্মীর আর বিজ্ঞান, ইংরেজি, অংক ও আইটির পড়ুয়া কর্মীর বেতন-মর্যাদা সমান, সেখানে কষ্টদায়ক ও ব্যয়বহুল বিজ্ঞান ও ইংরেজি পড়তে যাবে কেন? তাই সাধারণ বিষয় ছাড়া কঠিন বিষয়ের শিক্ষক পাওয়া কঠিনই হবে ততদিন, যতদিন না তাদের বেতন ও মর্যাদা ২-৩ ধাপ উপরে উঠানো হবে। একই অবস্থা করতে হবে সব পেশার ক্ষেত্রেও। সর্বোপরি প্রশাসনকেও পেশাভিত্তিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এসব হলেই বিজ্ঞান ও ইংরেজি পড়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয়ত মেধা পাচারও বন্ধ হবে। শিক্ষাসহ সব খাতেই দক্ষ ও মেধাবী লোক পাওয়া যাবে। উপরন্তু কারিগরি শিক্ষার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। দেশের কাক্সিক্ষত সার্বিক উন্নতির জন্য শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বন্ধ ও শিক্ষার মানোন্নয়ন করা অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার হার বৃদ্ধির চেয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষামন্ত্রীও সেরূপ কথাই বলেছেন। তিন গত ৮ ফেব্উয়ারি বলেছেন, ‘সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা আমরা আর চাই না।’ তার এই বক্তব্য বাস্তবায়ন হোক, সেটিই কাম্য দেশবাসীর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন