সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে কবিতার পংক্তি ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ একটি শিশুর জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের যদি স্বাভাবিক বৃদ্ধি না ঘটে তাহলে একটি দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যে সকল শিশু প্রতিকূল পরিবেশে জন্মে ও বড় হয় তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে তারা জর্জরিত। সুবিধাবঞ্চিত এসব পথশিশুর অনেকেই এসেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে, না হয় জন্ম হয়েছে শহরের কোনো এক জায়গায়। কাজের অভাবে খেয়ে না খেয়ে তাদের রাত কাটে রাস্তার ধারে বা সরকারি স্থাপনার খোলা বারান্দা বা রেললাইনের পাশে। অভিভাবকহীন এসব শিশুর পথচলা নিজেদের খেয়াল খুশি মত।
পথশিশুদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা তাদের কপালে কখনো জোটে না। আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থকে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়। এসব শিশুই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়। পথশিশু হওয়ার পেছনে বিভিন্ন নিয়ামক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন দারিদ্র্য, বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা-মা মারা যাওয়া বা বাবা মায়ের অসচেতনতা অথবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এখন কিছু শিশু পথে দিন কাটায়। ফলে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের জন্য ভবিষ্যতে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত দুর্বিষহ। শহরের খোলা আকাশের নিচে, ব্রিজের নিচে, মার্কেট, পার্ক, বাস ও রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান তাদের আশ্রয় কেন্দ্র। বাজার ও নৌ বা বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক তাদের বসবাস।
নৌ বা বাস টার্মিনালে তারা রাত-দিন কাজ করে সামান্য টাকা আয় করে। এ টাকা দিয়ে তারা রাস্তার ধারের ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে খায়। আয় না হলে না খেয়েই দিনযাপন করে। এজন্য অধিকাংশ পথশিশু অপুষ্টিতে ভোগে। চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, জন্ডিসসহ নানা রোগে তারা আক্রান্ত হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাবে পথশিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সকল প্রকার নিষ্ঠুরতা, জোর, জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেখানে দুঘর্টনার আশঙ্কা রয়েছে এবং যার ফলে তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমন ধরনের কাজ থেকে শিশুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। যেসব কাজ শিশুর স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর এবং যে কাজ তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যে সকল কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকারও শিশুর রয়েছে।
বাংলাদেশে বয়স অনুযায়ী শিশু অধিকার: ৭ বছরের নিচে শিশুর কোন আইনগত দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা নেই, ৬-১০ বছরের নীচে নিষিদ্ধ। ১৫ বছরের নিচে পরিবহন খাতে কাজ নিষিদ্ধ। ১৬ বছরের নিচে শিশু অপরাধীকে কারাগারে রাখা বে-আইনি। শিশুদের প্রতি সহিংসতা, অপব্যবহার ও শোষণের মতো প্রধান প্রধান যেসব হুমকি আছে সেগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে তাদের কিশোর বয়সেই। এই বয়সের শিশুদের মধ্যে প্রধানত কিশোরেরা অনিচ্ছাসত্তে¡ও দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে অথবা শিশুশ্রমিক হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব কারনে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ কমে যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব পথশিশু জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্মে। একশ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী আছেন, যারা পথশিশুদের দিয়েই মাদক সরবরাহ, ব্যবসা কিংবা পাচার করে। অনেক সময় পথশিশুরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিদেশে পাচারেরও শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। দারিদ্র্যের কারণে নিজের ভালো-মন্দ না বুঝেই নানামুখী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।
এছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাবও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো রকমের অসামাজিক কার্য সম্পাদনের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। প্রথমে পথশিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পলিসি তৈরি করা উচিত। পথশিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা ও তাদের পুনর্বাসন বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের ভাবতে হবে। পথশিশুদের যেন কোনোভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা টার্গেট করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ শিশুবান্ধব সংস্থার উন্নয়নকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশু রয়েছে যারা দুই বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না। অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের দিন কাটে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার জোগাতে পারে না। তারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে? এজন্য এসব শিশুকে শিক্ষাদানের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব শিশুর অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশে দেখা যায়, শিশুর সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের সব দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলে সমাজে আর কোনো অরাজকতার সৃষ্টি হবে না। অবশেষে বলবো, শিশুরা হচ্ছে সমাজ নামক বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল। এ ধরণের শিশুদের লেখাপড়া, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন