করোনাভাইরাস নামক এই অণুজীবকে মোকাবেলা করার জন্যে পুরো বিশ্বই আজ হিমশিম খাচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই পর্যন্ত কোনো মহামারীই পুরো বিশ্বকে এতটা উদ্বেগে ফেলতে পারেনি। নিঃসন্দেহে এটি মহান আল্লাহর পক্ষ হতে একপ্রকারের শাস্তি। মানুষ যখন দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে সুদ, ব্যাভিচার, অশ্লীলতা, খুন, অন্যায়, অত্যাচার, অবাধে মিলামেশা, দুর্নীতিসহ যাবতীয় পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তখন মহান আল্লাহ তার আসমানী বাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে মানুষকে দুনিয়াবী শাস্তি প্রদান করেন। মানব সৃজনের শুরু থেকে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিকে তার বাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি প্রদান করেছেন। তার বাহিনী সর্ম্পকে মহাগ্রন্থ আল্-কুরআনে বলা হয়েছে: ‘তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সর্ম্পকে একমাত্র তিনিই জানেন’ [সূরা আল্-মুদ্দাছির, আয়াত:৩১]। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তিনি (আল্লাহ) এমন বাহিনী অবতীর্ণ করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখনি’ [সূরা আত্-তাওবাহ, আয়াত-২৬]।
সহীহ বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (দ.)কে প্লেগ রোগ (এক প্রকারের মহামারী) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। প্রতি উত্তরে তিনি (রাসূল দ.) বললেন: ‘এটা একপ্রকারের আল্লাহর শাস্তি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার উপরই প্রেরণ করেন। তবে আল্লাহ তায়ালা এটা মু’মিনদের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কোন বান্দা (মানুষ) যেন প্লেগাক্রান্ত হওয়ার কারণে ঐ এলাকা থেকে বের হয়ে না যায়। বরং ধৈর্য্যধারণ করে বিশ্বাস নিয়ে সেখানেই অবস্থান করে। সে যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহ তা’য়ালা তার জন্য ভাগ্যে যা লিখেছেন তা ব্যতীত তাকে কিছুই স্পর্শ করবে না। যদি স্পর্শ করেও তাহলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে’ (সহীহ আল-বুখারী, নবীদের বাণীসূমহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ:৫১, হাদীস নং- ৩৪৭৪)।
তবে কোনো মহামারীর উদ্ভব হলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের স্বভাবের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো বিষয় ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। এই জন্যই মানুষের জান-মাল সংরক্ষণের উপর ইসলাম বারংবার তাগিদ প্রদান করেছে। আর জানের হেফাজত (আত্মরক্ষা) ইসলামি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দ্যেশ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম। মহাগ্রন্থ আল্-কুরআ’ন ও হাদীস আত্মরক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না’ [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১৯৫]। এই আয়াতে সরাসরি আত্মরক্ষার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
হাদীসেও মহামারীর ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আবু হুরায়রাহ (রা.)-কে বলতে শুনেছেন, নবী কারীম (দ.) বলেছেন: ‘কেউ যেন কখনো রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের সাথে না রাখে’ (সহীহ আল্-বুখারী, চিকিৎসা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৪৪, হদীস নং- ৫৭৭১; সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৩৩, হাদীস নং- ১৭৪৩)। এই হাদীসে যেখানে অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের সাথে না রাখার জন্য প্রিয় নবী (দ.) নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে সৃষ্টির সেরা জীব একজন সুস্থ মানুষ কীভাবে অসুস্থ মানুষের সাথে থাকবে?
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সা’দ (রা.) নবী কারীম (দ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (নবী) বলেছেন: ‘যখন তোমরা কোন এলাকায় প্লেগ রোগের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, তথায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’ (সহীহ আল্-বুখারী, চিকিৎসা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ২৯, হদীস নং- ৫৭২৮; সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৩২, হাদীস নং- ২২১৮)।
এই ধরনের মহামারী থেকে পরিত্রাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, তাওবা করে সর্বদা দয়াময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং নিয়মিত নামায আদায় ও কুর’আন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা। আর হাদীসে বর্ণিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়া।
প্রসিদ্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইব্নে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী (দ.) বিভিন্ন প্রকারের রোগ থেকে বাঁচতে সকাল-সন্ধ্যায় নিম্নােক্ত দোয়াটি বেশী পড়তেন: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমার দীন, আমার দুনিয়া, আমার পরিবার ও আমার সম্পদ সর্ম্পকে আপনার কাছে অনুকম্পা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমার লজ্জাস্থানকে ঢেকে দিন এবং আমার ভয়গুলো বিদূরিত করুন এবং আমাকে আমার সামনে থেকে এবং আমার পিছন থেকে এবং আমার ডান দিক থেকে এবং আমার বাম দিক থেকে এবং আমার উপরের দিক থেকে আমাকে রক্ষা করুন। এবং আমার নিচে দিয়ে আমাকে ধসিয়ে দেওয়া থেকে আমি অপনার কাছে পানাহ চাই’ (সুনানু আবি দাউদ, শিষ্টাচার অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৮, হাদীস নং- ৫০৭৪; সুনানু ইবনে মা’জাহ, দু’য়া অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ১৪, হাদীস নং- ৩৮৭১)। অন্য হদীসে বর্ণিত হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারীম (দ.) এরূপ দোয়া বেশি করতেন: ‘হে আল্লাহ! আমি শে^ত (কুষ্ঠ) রোগ হতে, পাগলামী হতে, খুঁজলী-পাঁচড়া হতে এবং বিভিন্ন প্রকারের ঘৃণ্য রোগ হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ (সুনানু আবি দাউদ, নামায অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ৩৬৭, হাদীস নং- ১৫৫৪)।
এইধরনের আরো অনেক প্রকারের দু’য়া বিভিন্ন হাদীসের মধ্য রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে সর্বক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহকে আহবান করলে তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং এই প্রাণঘাতী মহামারী থেকে অমাদেরকে পরিত্রাণ দিবেন।
এই ধরনের মহামারী থেকে বাঁচতে মুসলমানদের করণীয়:
এক. তাওবা করে প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং রাসূল (দ.) কর্তৃক নির্দেশিত দু’য়াগুলো বেশি বেশি পড়া। দুই. নিয়মিত নামায ও কুরআ’ন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সময় ব্যয় করা। তিন. পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা। চার. গণ-জমায়েত ও আক্রান্ত লোকের সংষ্পর্শ থেকে দূরে থাকা। পাঁচ. কোন মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবে না। বরং ধৈর্য্য ধরে পরম করুণাময় আল্লাহর উপর নির্ভর করে ঐ এলাকায় অবস্থান করবে। অনুরূপভাবে অন্য এলাকার কোন মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করবে না। ছয়. রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এই মহামারী মোকাবেলায় সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাত. অধিক লোকের সমাগম হয় এমন যাবতীয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা। আট. এই মহামারী মোকাবেলায় সরকার যত ধরনের যুক্তিসংঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন, সব সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে সরকারী কাজে সহযোগিতা করা প্রত্যেক নাগরিকের উপর আবশ্যক।
পরিশেষে, মহাগ্রন্থ আল্-কুরআ’নের একটি আয়াতের মাধ্যমে ইতি টানতে চাই। ইরশাদ হচ্ছে: ‘হে নবী (দ.) আপনি বলে দিন: আল্লাহ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা ছাড়া অন্য কোন বিপদ আমাদের উপর আসবে না, তিনিই আমাদের প্রকৃত অভিভাবক আর সকল মু’মিনের কর্তব্য হল যাবতীয় কাজে আল্লাহর উপরই নির্ভর করা’ [সূরা তাওবা, আয়াত:৫১]।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন