নিদেল শরিফ
শাহবাগের বইমেলা শেষ হয়েছে বেশি দিন হয় না। আজিজ সুপার মার্কেট এবং একুশে বইমেলা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগে। এবারের মেলা নাকি বেশ জমেছিল! এবার ঘুরে ঘুরে অনেক বই কেনার ইচ্ছা ছিল জয়ার। অথচ সেই বইপাগল মেয়েটি আসেনি এবার। যে মেয়েটি বাহারি ধরনের সমসাময়িক ফ্যাশনের ধার না ধরে তার জমানো টাকা দিয়ে বই কিনতো- সে আসেনি কোন বইমেলায়। যে মেয়েটির ঘরে বসার জায়গা ছিল না কারণ সেখানে শুধুই বইয়ের ছড়াছড়ি ছিল; যার একটা বিশাল বইয়ের তালিকা ছিল যা সে পড়তে চায়তো এবং প্রতিনিয়ত সে তালিকা বেড়েই যেত; সে এবার একটা বইমেলায়ও আসতে পারেনি। পারেনি নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে কাটিয়ে দিতে একটা বেনামী বিকেল।
জয়ার বই পড়ার অভ্যাসটা ছিল সেই ছোটবেলা থেকে। যখন মা তাঁর মাথার কাছে বসে বসে রুশ গল্প শোনাতো-তখন থেকেই তাঁর বইয়ের সাথে পরিচয়। আর আমার সাথে পরিচয় সেই বইয়ের সূত্র ধরেই। ‘সে মেয়েকেই খুঁজে বের কর যে পড়তে পছন্দ করে’ এই নীতিই আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিল। নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানে বই কিনতে কিনতে আলাপ। তারপর বই নিয়ে আলোচনা হৃদয় পর্যন্ত গড়ালো। তার সাথে সবসময় না পড়া বা অর্ধেক পড়া একটা বই থাকতো। নিউমার্কেট বা নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে খুঁজে যখন তার প্রিয় বইটি খুঁজে পেত- খুশিতে তার চোখ অন্যরকম হয়ে যেত। সে চোখ আমাকে দিতো প্রশান্তি। সেই প্রশান্তি ভরা চোখে আমি তাঁকে প্রশ্ন করতাম, ‘আর কতকাল তুমি এভাবে বই পড়ে কাটাবে?’
আমার দিকে না তাকিয়েই সে উত্তর দিতো, ‘যতকাল আমার দৃষ্টি শক্তি থাকবে?’
আমি তাঁর চশমা পরা চোখে দৃষ্টি খোঁজার চেষ্টা করে হারিয়ে যেতাম চোখের অনেক গভীরে।
প্রায় রাস্তার পাশের কোন কফিশপে বসে সে একটা বই পড়তো আর আমার জন্যে অপেক্ষা করতো। উঁকি দিলে দেখা যেত মগে ক্রিম রয়ে গেছে, কারণ সে একটা চুমুক দিয়েই হারিয়ে যেত তাঁর বইয়ে। মুখোমুখি চেয়ারটায় আমি বসতাম আর দেখতাম সে একটু রাগতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ ফিরিয়ে নিত।
আমি প্রায়ই তাঁর মনোযোগ নষ্ট করতাম; তাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘তোমার কি আরও কফি লাগবে?’
সে চোখ তুলে আমাকে দেখে নিত আর বলত, ‘কফি হয়তো ফুরাবে না, সময় তো ঠিকই ফুরাবে।’
আমিও কাব্য করে বলতাম, ‘কফির পেয়ালা হাতে এক চুমুকে কৈশরটাকে পাশ কাটিয়ে এসেছি; এবার যৌবনে হোক পূর্ণ বিকাশ।’
আমার কাব্য প্রতিভাতে সে হেসে লুটিয়ে পড়ত আর বলত, ‘তোমার যৌবনের পূর্ণ বিকাশ কখনোই হবে না।’ তারপর হাতে হাত ধরে চুপ করে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ। আমাদের নিঃশ্বাস যেন বলত- সারাজীবন এমনি কাটুক এক সাথে হাতে হাত ধরে।
একটা পড়ুয়া মেয়েকে ভালোবাসা অনেক সহজ। যে কোনো বিশেষ দিনে একটা বই উপহার দিলেই সে খুশি হয়ে যেত। সাথে সুন্দর একটা কথা, একটা কবিতা, কিংবা গানের দুটো লাইন লিখে দিলে তো সোনায় সোহাগা। অনুপ্রেরণা, রসবোধ আর মতবিরোধের মাঝে আমাদের দিনগুলো ছিল উচ্ছল। খুনসুটি, কবিতা আর গানে ভরপুর ছিল আমাদের যুগল সময়। আজ সে সময় ডেকে নিয়ে গেছে বৈরী বাতাস।
এতক্ষণ আমাকে অতীতের কথা লিখতে হলো কারণ জয়াও আজ অতীত; সুদূরের অতীত-যেখান থেকে ফেরে না কিছুই। তার না পড়া গল্পের মতো, না লেখা কবিতার মতো রহস্য নিয়ে সে হারি গেল আমাকে হারিয়ে দিয়ে।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। জয়ার বাসার সবাই গেছে তার নানু বাড়ি বেড়াতে। একলা সময় পেয়ে খুশিই হয়েছিল জয়া। কিন্তু প্রকৃতি খুশি হতে পারেনি। জয়া কফি বানাতে রান্নাঘরে গিয়েছিল। চুলা ধরাতে দেশলাই জ্বালাতেই গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ সে। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসলো, হাসপাতালে নেয়া হলো, বার্ন ইউনিটে কান্নার রোল পড়লো কিন্তু জয়া আর ফিরলো না। আমাকে কে যেন ফোন করে জানলো হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আছে জয়া। আমার হৃদয় যেন তখনি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার মৃত্যু দেখার চেয়ে কষ্টের আর কিছু আছে কিনা সে আমি জানি না। শুধু এতটুকু জানি আমি সেদিন যুগল মৃত্যু কামনা করেছি। সফেদ কাপড়ে মোড়ানো ঝলসে যাওয়া শরীরে শুধু চোখ দুটাই আমার পরিচিত ছিল। এ চোখে কবিতা, গল্প আর উপন্যাসের কত লাইন যে জমা আছে সে বিধতা জানেন! রবীন্দ্রনাথের মতো তখন আমারও বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, “মুদিত নয়ন খুলিয়ে আমার সাধের স্বপন যায় রে যায়।” তারপর আমি কাঁদার শক্তি হারিয়েছি; হাসার শক্তিও। চোখের জমানো সব জল যেন শুকিয়ে গেছে নিমিষে। এ যে আমার বর্ণনার বাইরের কিছু; ঠিক যেন ‘নয়নের জল নয়নে শুকায়-মরমে লুকায় আশা।’
দুর্ঘটনাটির ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে যে ওই এলাকায় মাটি কেটে পয়োনিষ্কাশন নালার কাজ করার সময় ভূগর্ভস্থ গ্যাসলাইনের কোথাও ছিদ্র হয়েছে এবং সে ছিদ্রপথে গ্যাস নির্গত হয়ে ওই বাসাটি গ্যাসে ভরে গিয়েছিল। এই অবস্থায় বাসার বাসিন্দাদের কেউ গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলে বিস্ফোরণটি ঘটে।’ বর্ণনাটা চমৎকার ছিল, কিন্তু যাঁদের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়ে গেছে তাঁরা ছাড়া কে বুঝবে ক্ষতের কী জ্বালা! কে বুঝবে প্রিয় হারা বেদনা।
আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে আমাকে তার স্বপ্নের গল্প শুনিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কী করতে চাও এই জীবনে?’
সে বলেছিল তাঁর পরিকল্পনার কথা, ‘অনেক দূরে, নাগরিক কোলাহল যেখানে পৌঁছাবে না, সেখানে একটা পাঠাগার বানাবো। নির্জনে একটা ছোট ঘর বাঁধবো- সেখানে বই আমি আর প্রকৃতি।’
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাকে নিবে না তোমার সাথে?’
সে খুব করুণভাবে বলেছিল, ‘সেখানে তোমার দম বন্ধ হয়ে আসবে আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।’
তখন আমি হেসে বলেছি, ‘আমি তোমার জন্য সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি।’
এখন আমি বুঝতে পারি কেন তাঁর এত ভয় ছিল; আমার দম বন্ধ হওয়ার ভয়। সে বুঝি আগেই বুঝতে পেরেছিল তার অনাগত আগামী! সে কি তার প্রিয় কবি কিটস আর সুকান্তের পথ অনুসরণ করতে চেয়েছিল তাহলে?
নীলক্ষেতের সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে হলদে হয়ে যাওয়া একটা প্রথম এডিশনের বইয়ের পাতার গন্ধে চোখ বন্ধ করে যদি একটা মেয়ে হারিয়ে যেতে পারে কল্পনার রাজ্যে; সেই বইপাগল মেয়েটির জীবন একটা দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাবে সে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। আমার অবিশ্বাসকে তাড়াতে সে প্রতিদিন উঁকি দেয় আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা হয়ে। আমি সে তারার নাম রেখেছি জয়া। জানালার পাশে আমার পড়ার টেবিলে বসে যখন আকাশ দেখি- জয়া বলে উঠে, ‘তোমার আলসেমি আর গেল না! টেবিলের সব বই যে পড়া বাকি!’
জীবনের প্রতিটা অভাবনীয় সাফল্যের পিছনে নাকি একটা ব্যর্থতার গল্প থাকে। সবকিছুই নাকি একটা সময় শেষ আসে; ভাটা পড়ে জীবন সমুদ্রে। আমাদের সমাপ্তিও তার পড়া কোন এক গল্পের মতো ছিল হয়তো! জীবনে প্রতিটা মানুষই কি একেকটা গল্পের চরিত্রের মতো? আমাকে দেয়া তার শেষ বইটিতে লেখা ছিল রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো-
‘হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।’
আমি জয়াকে বিদায় বলতে পারিনি। পারিনি বলতে খুব গভীরে জমে থাকা অনেক কথা। তবে আলেকজান্ডার পুশকিনের মতো আমারও বলার আছে-‘তোমাকে ভালবাসতাম, বোধকরি এখনো বাসি/ সে দীপশিখাটি নিভেনি আজো।’
অথবা রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়-
‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে-
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন