শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

উদার ইসলামের কথা বলে বিপাকে এক সউদী ধর্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

॥ চার ॥
ইনকিলাব ডেস্ক : একটি ফতোয়া আছে যা সরকারী ওয়েবসাইটে ইংরেজিতে এখনো পাওয়া যায় এবং যা আগের গ্র্যান্ড মুফতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত, তা হচ্ছে যেসব দেশ সত্যের পথ অনুসরণে অস্বীকৃতি জানায়, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও শান্তি এবং জীবন, সম্মান ও সম্পদ রক্ষার স্বার্থে তাদের হত্যা বা ক্রীতদাস করা যাবে।
এতে আরো বলা হয়েছেÑইসলামে দাসত্ব হচ্ছে বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বা সোনার মতো যাতে বন্দীরা প্রবেশ করে তাদের ময়লা ধুয়ে ফেলে এবং পরিষ্কার, পবিত্র ও নিরাপদ হয়ে তারা বের হয়ে আসে।
একবার যখন আমরা কফি পান করছিলাম শেখ তার সেলফোনে কথা বলতে বলতে মনোযোগ সহকারে কথা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ফতোয়া প্রদান করলেন। এ রকম ফোন তিনি অনেক পান।
তার কাছে যে প্রশ্ন এসেছিলÑতা হলো একজন হজযাত্রী মক্কার পথে কোথায় ইহরাম পরিধান করবে? এক্ষেত্রে তার জবাব ছিল জেদ্দা। আরেকটি প্রশ্ন ছিল কঠিন এবং তিনি বিনয়ের সাথে বললেন যে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন। একবার এক মহিলা তাকে নকল আইল্যাশের ব্যাপারে জানতে চায়। তিনি তাকে বলেন যে বিষয়টি তার জানা নেই। পরে তিনি এ বিষয়ে চিন্তা করে তাকে সিদ্ধান্ত দেন যে আইল্যাশ সুন্দর, তবে শর্ত হল যে এটা প্রতারণার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে না।
এক শুক্রবার শেখ আমাকে নিয়ে তার চাচা গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল-শেখের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। আমরা রিয়াদের কাছে মুফতির বাড়িতে একটি বিশাল রিসেপশন হলে প্রবেশ করি। সেখানে দেয়ালের সাথে রাখা গদি লাগানো বেঞ্চে ডজন খানেক ছাত্র ছিল। সবার মুখেই দাড়ি। মধ্যখানে একটি উঁচু আর্মচেয়ারে মুফতি বসেছিলেন। ছাত্ররা পাঠ্য পড়ছিল এবং তিনি ভাষ্য দিচ্ছিলেন। ৭৫ বছর বয়স্ক মুফতি বলেন, তিনি ১৪ বছর বয়স থেকে অন্ধ। এক জার্মান ডাক্তার তার চোখে ব্যর্থ অপারেশন করেন।
শেখ বলেছিলেন, আমি তাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করতে পারব। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, যারা ওয়াহাবিবাদকে ইসলামিক স্টেটের সাথে তুলনা করে তাদের ব্যাপারে তার জবাব কি?
তিনি ইসলামিক স্টেটের আরেক নাম ব্যবহার করে বললেন, এ সবই মিথ্যা ও অপবাদ। দায়েশ হচ্ছে একটি আগ্রাসী, অত্যাচারী গ্রুপ যাদের সাথে ওয়াহাবিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
একটু চুপ করে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মুসলমান হচ্ছেন না কেন? আমি বলি যে আমি একটি খ্রিস্টান পরিবার থেকে এসেছি।
তিনি বললেন, আপনি যে ধর্মের অনুসারী তার কোনো উৎস নেই। আপনার উচিত ইসলাম গ্রহণ করা। আপনার ধর্ম কোনো ধর্মই নয়। কিয়ামতের দিন আপনাকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে।
অনাকাক্সিক্ষত সংস্কারক
আমি এ বছরে প্রথম ৫১ বছর বয়স্ক সাবেক ধর্মীয় পুলিশ ঘামদির সাথে লোহিত সাগর তীরবর্তী বন্দর জেদ্দায় তার অ্যাপার্টমেন্টের বসবার ঘরে সাক্ষাৎ করি। ঘরটি বেদুইনদের একটি তাঁবুর মতো করে সাজানো ছিল। তিনি আমাকে বলেন কীভাবে শেখদের জগৎ, ফতোয়া ও ধর্মের সযতœ প্রয়োগ তার জীবন নির্ধারণ করেছে। তবে এ জগৎÑতার জগৎÑতাকে নিস্পন্দ করে দিয়েছে।
তিনি সংস্কারক হওয়ার কথা ভাবেননি বলা চলে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তিনি জেদ্দা বন্দরে কাস্টম অফিসে একটি চাকরি পান। কিন্তু একজন শেখ যখন তাকে বলেন যে শুল্ক আদায় করা হারাম তখন তিনি সে চাকরি ত্যাগ করেন।
¯œাতক ডিগ্রি লাভের পর অবসর সময় তিনি ধর্ম অধ্যয়ন করেন এবং একটি সরকারী অফিসে আন্তর্জাতিক হিসাব রক্ষার কাজ করেন। এ চাকরিতে অমুসলিম দেশে ভ্রমণ করতে হত। এ সময় আলেমরা ফতোয়া দেন যে প্রয়োজন না হলে কাফেরদের দেশে ভ্রমণ করা ঠিক নয়। সুতরাং এ চাকরিও ছাড়েন তিনি।
এরপর তিনি সউদী আরবের একটি কারিগরি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তবে তা তার পছন্দ হয়নি এ জন্য যে তা শুধু পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র শেখায়। তাই তিনি পাঠ্যে ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে কিছু বিষয় যোগ করেন। কিন্তু ছাত্ররা অতিরিক্ত পড়া নিয়ে প্রতিবাদ জানালে তিনি সে চাকরিও ত্যাগ করেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি তার ধর্মবোধের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ধর্মীয় পুলিশের চাকরিতে জেদ্দায় যোগ দেন। কয়েক বছর পর তিনি মক্কায় বদলি হন এবং বিভিন্ন পদে কাজ করেন। সেখানে মাঝে-মধ্যে পতিতাবৃত্তির ঘটনা তার কাছে এসেছে, কখনো কখনো তার লোকজন গণকদের ধরে এনেছে যারা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি মৃত্যুদ-।
তবে তিনি তার লোকদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে কড়াকড়ি অবলম্বন করেন। তার সহকর্মীদের ধর্মপ্রীতি কখনো কখনো মাত্রা ছাড়ায়। তারা মানুষের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়ে কিংবা আটকদের নিগ্রহ করে। তিনি বলেন, তাদের কেউ কেউ মদ পান করত। তা ধর্মের উপর হামলা নয়, কিন্তু লোকজনের সাথে আচরণে তারা বাড়াবাড়ি করত। তিনি বলেন, প্রায়ই লোকজনের উপর অমানবিক নির্যাতন করা হয় এবং এ নির্যাতন ধর্মের উপর ঘৃণার সৃষ্টি করে।
২০০৫ সাল ধর্মীয় পুলিশের মক্কা অঞ্চলের প্রধান মারা গেলে ঘামদি সে পদে উন্নীত হন। এ ছিল বড় চাকরি। ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলোসহ ৯০টি স্থান সম্বলিত বিরাট এলাকা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি সাধ্যমত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। তবে কমিশনের ভুল পদক্ষেপের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।
বক্তিগতভাবে তিনি হারাম ও হালাল বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসের শরণাপন্ন হয়েছেন। এ বিষয়ে যা সাক্ষ্য -প্রমাণ পেয়েছেন তা দলিল হিসেবে রেখেছেন। তিনি বলেন, ওলামাদের কাছে শুনে আমরা হারাম বলি। কিন্তু তারা প্রমাণ সম্পর্কে কখনো কিছু বলেন না।
তার মত উচ্চপদস্থ ব্যক্তির এ ধরনের সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি নিশ্চুপ থাকেন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দূরে সরিয়ে রাখেন। কিন্তু শিগগিরই তার মুখ খোলার প্রয়োজন দেখা দেয়।
তিনি যখন তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুনঃচিন্তা করছিলেন এ সময় বাদশাহ আবদুল্লাহ দেশে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন যার নাম হবে বাদশাহ আবদুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কাউস্ত)। সউদি ওলামা মহল ধাক্কা খায় যখন দেখে যে এক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের পৃথক ভাবে শিক্ষা নেয়া বা মেয়েদের জন্য পোশাকের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি।
দেখা যায়, কাউস্তের ক্ষেত্রে সউদি আরামকোর পূর্বদৃষ্টান্ত অনুসরণ করা হয়েছে, যেখানে সউদি ওলামা মহলের কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই যাতে কিনা সউদী নীতির বৈপরীত্যই প্রকাশিত। সউদী রাজপরিবার ইসলামী মূল্যবোধের গুণকীর্তন করে সেটা বিষয় নয়, তারা যখন টাকা আয় করে বা আয়ের পথ তৈরি করে তখন ওলামা মহলের পরামর্শ নেয় না। তারা এর মাঝে একটি দেয়াল তৈরি করে ও তাদের আলাদা করে রাখে।
অধিকাংশ ওলামাই বাদশাহর সাথে তাদের মতানৈক্যের বিষয়ে চুপ থাকেন। কিন্তু এক শীর্ষ ওলামা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের মিশ্র শিক্ষার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এতে যৌন হয়রানি বাড়বে, ছেলেমেয়েরা প্রেম করবে এবং পড়াশোনায় অমনোযোগী হবে, স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হবে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে।
শেখ সাদ আল-শাথরি বলেন, ছেলেমেয়েদের মেলামেশার বহু খারাপ দিক আছে এবং তার কুপ্রভাব বিরাট। তিনি বলেন, বাদশাহ যদি এ পরিকল্পনার কথা জেনে থাকেন তার উচিত এটা বন্ধ করা।
তবে মিশ্র শিক্ষার পরিকল্পনা আসলে বাদশাহরই চিন্তাপ্রসূত। এক ফরমান জারি করে তিনি শেখের আশঙ্কা বাতিল করেন।
মক্কায় ঘামদি বিষয়টি লক্ষ করেন। তিনি হতাশ হন যখন দেখেন যে দেশের জন্য ভালো এমন একটি প্রকল্পকে ওলামারা সমর্থন দিচ্ছে না।
তিনি তার বক্তব্যকে দুটি দীর্ঘ প্রবন্ধে রূপ দেন ও তা ২০০৯ সালে ওকাজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এগুলো ছিল ঘামদি ও ধর্মীয় মহলের মধ্যে কয়েক বছরের লড়াইয়ের প্রথম আক্রমণ। তিনি এর পর আরো প্রবন্ধ লেখেন। টিভিতেও বক্তব্য রাখেন। তিনি অন্য ওলামাদের বিরোধিতার সম্মুখীন হন যারা তাকে অপমান ও তাদের কথার সমর্থনে কুরআন-হাদিস থেকে সাক্ষ্য পেশ করেন। ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীতে তার সহকর্মীরা তাকে এড়িয়ে চলতে থাকেন । এ অবস্থায় তিনি আগাম অবসরের আবেদন করেন এবং তা দ্রুত মঞ্জুর হয়।
বাহিনী থেকে সরে আসার পর তিনি নামাজের সময় দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য করা, লোকজনকে মসজিদে যাওয়ার আহবান জানানো, ঘোমটায় মুখ আবৃত করা, মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তার প্রতিটি মন্তব্য নতুন করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
২০১৪ সালে তিনি একটি জনপ্রিয় টকশো’তে উপস্থিত হন। সেখানে তার স্ত্রীও ছিলেন যার মুখ সম্পূর্ণ খোলা ছিল। তার স্ত্রী বলেন, তিনি স্বামীর কথা সমর্থন করেন। ওলামা মহলের উচ্চ পর্যায় থেকে এর কঠোর প্রতিবাদ আসে। এক শীর্ষ ওলামা শেখ সালেহ আল লুহেইদান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি একজন খারাপ লোক। তাকে তলব করা ও শাস্তি দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাউকে নিয়োগ করা দরকার ।
সউদি গ্র্যান্ড মুফতি বলেছেন, বোরকা একটি প্রয়োজনীয় আদেশ এবং তা ইসলাম নির্দেশিত। তিনি ধর্ম, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধকে কলুষিত করে এমন বিষয় প্রচার নিষিদ্ধ করার জন্য দেশের সব টিভি চ্যানেলের প্রতি আহ্বান জানান।
ওলামা মহলের আক্রমণ যখন প্রবল তখন সমাজের কাছ থেকেও তিনি বেদনাদায়ক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন। তার গোত্র এক বিবৃতি দিয়ে তাকে পরিত্যাগ করেছে এবং তাকে সমস্যাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেছে। তার সেলফোনে দিন-রাত লোক তাকে গালাগালি করছে। তার বাড়ির দেয়ালে দেয়াল লেখা পড়েছে। তার ঘরের দরজায় কয়েকজন এসে পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে মেলামেশা করার দাবি জানায়। সূত্র দি নিউইয়র্ক টাইমস। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
* নিবন্ধকার বেন হাবার্ড দি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন