বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

উদার ইসলামের কথা বলে বিপাকে এক সউদী ধর্মীয় পুলিশ কর্মকর্তা

প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

॥ পাঁচ ॥
ইনকিলাব ডেস্ক : এ গোলমাল শুরু হওয়ার আগে ঘামদি একটি সরকারী বৃত্তি লাভ করে মক্কার একটি মসজিদে জুমআর খুৎবা পাঠ করতেন। কিন্তু তার মন্তব্য প্রকাশ পাওয়ার পর মুসল্লিরা আপত্তি জানায়। তাকে বাড়ি থাকতে বলা হয়। সরকারী বৃত্তিও হারান। ঘামদি কোনো আইন লংঘন করেননি, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও কখনো হয়নি। কিন্তু সউদী আরবের ঘনিষ্ঠ বন্ধনযুক্ত সমাজে তার পরিবারের মাধ্যমে আক্রমণ আসে। তার বড় ছেলের বাগদত্তার পরিবার তার পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চায় না জানিয়ে তাদের বিবাহ বাতিল করে দিয়েছে।
ঘামদি তার বোনের কথা জানান। বোনের স্বামী তার বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি তোমার ভাইয়ের পক্ষে না আমার পক্ষে? বোন জবাব দিয়েছিলেন, আমি ভাইয়ের পক্ষে। অচিরেই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
ঘামদির ১৫ বছর বয়স্ক ছেলে আম্মার স্কুলে উপহাসের শিকার হয়েছে। এক সহপাঠী তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার মা কি কিভাবে টিভিতে গেল? এটা ঠিক হয়নি। তোমরা রীতি-নীতি মান না। তার কথা সহ্য করতে না পেরে আম্মার তাকে ঘুষি মারে।
কথা বলার জায়গা নয়
জেদ্দায় এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক তার বাড়িতে রাতের খাবারের জন্য আমাকে দাওয়াত করেন। তার স্ত্রী একজন ডাক্তার । খাবার টেবিলে তিনিও যোগ দেন। চমৎকার ফ্যাশনের একটি বোরকায় তার মাথা ঢাকা ছিল। তাদের সম্প্রতি বিবাহ হয়েছে। অধ্যাপক কৌতুক করে বললেন যে, তারা একে অপরের জন্যই তৈরি হয়েছেন। কারণ, স্ত্রী ভালো রান্না করেন আর তিনি একজন ভোজন রসিক। তার স্ত্রী মুখ টিপে হাসলেন স্বামীকে আরো স্যুপ ঢেলে দিলেন।
আমি তাকে ঘামদির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি যা পড়েছি ও দেখেছি, আমি মনে করি তিনি ঠিক বলছেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আমি তার প্রশংসা করি। কিন্তু কথা হচ্ছে, সউদী সমাজে মতবিরোধিতা সহ্য করার শিক্ষা দেয়া হয় না।
তিনি বলেন, আমি যা বলি তা মানবে, অন্যথায় আমি তোমাকে শ্রেণিকরণ করব, আমি তোমাকে আহত করব, আমি তোমাকে আলোচনার বাইরে ঠেলে দেবÑ এটা ইসলাম বিরোধী। বহুলোক আছে যারা ভিন্ন চিন্তা করে। আপনি লড়াই করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে একই ছাদের নিচে বাস করতে হবে। ছেলেমেয়েদের মিশ্র শিক্ষা বা মেয়েদের কাজ করার ব্যাপারে তার স্ত্রীর কোনো সমস্যা নেই। তবে ঘামদি তার মতের কথা প্রকাশ্যে বলে যে ঝামেলার সৃষ্টি করেছেন তা তিনি পছন্দ করেন না। রাজপরিবার আইন প্রবর্তন করেছে, তা পরিবর্তনের জন্য প্রকাশ্যে প্রচারণা চালানো ঠিক নয়। তার উচিত শাসককে মেনে চলা। সবাই যদি নিজ নিজ মতানুসারে চলতে চায় তাহলে গোলযোগ দেখা দেবে।
রাতের খাবারের পর নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত এক তরুণ ইমাম আসেন। তিনিও ঘামদির সাথে একমত প্রকাশ করেন, কিন্তু সে কথা প্রকাশ্যে বলতে চান না। তিনি বলেন, রক্ষণশীল ওলামা মহল উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তরুণ আলেম নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন, তা নিয়ে পরে হয় আলোচনা। তিনি বলেন, তাকে যে প্রশ্ন সবার কাছ থেকে শুনতে হয় তা হচ্ছে ঃ সামরিক বাহিনীর ইউনিফরম কি হারাম নয়? তিনি মনে করেন, ইউনিফরম পরা ভালো। তিনি উদ্বিগ্ন যে এ ধরনের সংকীর্ণ চিন্তা লোকজনকে উগ্রপন্থা বিষয়ে সন্দেহভাজন করে তোলে।
আমি ঘামদির সাবেক অফিস পরিদর্শন করতে পারিনি, কারণ অমুসলিমদের জন্য মক্কায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই কমিশনে (ধর্মীয় পুলিশ) যারা চাকরি করে তাদের আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতকার জন্য আমি বিভিন্ন লোকের মাধ্যম যোগাযোগ করি, কিন্তু তারা সবাই কথা বলতে অস্বীকার করেন। আমি কমিশনের মুখপাত্রকে ফোন করলে তিনি বলেন তিনি ভ্রমণ করছেন এবং ফোন বন্ধ করে দেন। রিয়াদ অভিমুখী এক মহাসড়কে কমিশনের সদর দফতরে আমি হাজির হই। এটি হচ্ছে একটি গ্যাস স্টেশন ও একটি গাড়ি বিক্রির দোকানের মধ্যে আয়তাকার ইস্পাত ও কাচ নির্মিত ভবন। কমিশনের ওয়েব সাইটে পরিচালকের সাথে সাক্ষাতের সময় দেখেছিলাম। আমি তার অফিসে গেলাম। তার সেক্রেটারি জানান, তিনি আজ আসেননি। আগামী সপ্তাহে আসতে পারেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এলে দু’ব্যক্তি আমাকে একটি অফিসে নিয়ে যান ও কফি খেতে দেন। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, কমিশনে কাজ করতে কেমন লাগে?
একজন বলেন, যারা এ কাজ পছন্দ করে তারা সবাই কমিশনকে ভালবাসে। এটা হচ্ছে গোটা ইসলামী রাষ্ট্রের কাজ। লোকজনকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনার ব্যাপারটি ভাল লাগে। অন্যজন ১৫ বছর ধরে এ বাহিনীতে আছেন এবং এখানে কাজ করা পছন্দ করেন। এক ব্যক্তি দরজায় উপস্থিত হন ও চোখ গরম করে বলেন, কারো সাথে আমার কথা বলার অনুমতি নেই। প্রথম ব্যক্তি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি আমাকে আবার কফি, তারপর চা দেন। তিনি আমাকে জোর করে এক বোতল পানি দেন। তারপর আমি চলে আসি।
সংস্কার, কঠিন পথ
ঘামদির ঘটনায় পরিহাস হল যে রাজপরিবারের সদস্য, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ আলেমরাও তার সাথে একমত, কিন্তু অধিকাংশই গোপনে। কিছু স্থান যেমন হাসপাতাল, সম্মেলন এবং মক্কায় হজের সময় নারী-পুরুষকে একসাথে দেখা যাওয়া সাধারণ বিষয়। কয়েকটি সউদী শহরে নারীদের মুখ, এমনকি তাদের চুলও চোখে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু সউদী সমাজ বিভক্ত। যারা রক্ষণশীল তারা রাষ্ট্রের খাঁটি ইসলামী পরিচয় বহাল রাখতে চায়। অন্যদিকে উদারপন্থীরা চায় আরো ব্যক্তি স্বাধীনতা। উদারপন্থীরা ঘামদির সপক্ষে, কিন্তু শেখদের কাছে তিনি বিশ্বাসঘাতক।
দ্বিতীয় পরিহাস হচ্ছে, ঘামদি যেসব সংস্কার চেয়েছিলেন, সউদী আরব এ বছর তার কিছু কার্যকর করেছে। কমিশনের জন্য বছরটি খারাপ যাচ্ছে। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায় যে, রিয়াদের একটি মলের বাইরে কমিশনের পুলিশদের সাথে ধস্তাধস্তির সময় এক তরুণী চিৎকার করছে। তার আবায়া মাথার উপর উড়ছে এবং তার পা ও শরীর দেখা যাচ্ছে। বহু সউদীর কাছেই এ ‘নাখীল মল তরুণী’ ধর্মীয় পুলিশের বাড়াবাড়ির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এরপর কমিশন প্রায়ই বিশিষ্ট ওলামাদের সমালোচনাকারী এক জনপ্রিয় টক শো’র আয়োজক আলী আল ওলিয়ানিকে গ্রেফতার করে। অনলাইনে মদের বোতল হাতে হ্যান্ডকাফ পরা ওলিয়ানির ছবি দেখানো হয়। এ ছবি যে বানানো তা সুস্পষ্ট এবং মনে হয় তার চরিত্র হননের জন্যই তা করা হয়েছে। বহু লোক এতে ক্ষুব্ধ। এপ্রিলে সরকার ধর্মীয় পুলিশকে অকার্যকর করে আকস্মিক এক ডিক্রি জারি করে। এতে তাদের গ্রেফতার করা, আটকদের প্রশ্ন বা ধাওয়া করা, পুলিশের সাথে কাজ করতে বাধ্য করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয় এবং নাগরিকদের সাথে কাজ করার সময় তাদের আরো ভদ্র ও দয়ালু হতে উপদেশ দেয়া হয়।
ঘামদি এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন যদিও তিনি একজন অনাহুত ব্যক্তি হয়ে আছেন। সউদী আরবে তার কাজ করে খাওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমানে তিনি প্রায় নীরব অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। এখনো জনসমক্ষে বের হলে তিনি অপমানের শিকার হন। তার কোনো চাকরি নেই, তবে তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন যার অধিকাংশ দেশের বাইরে প্রকাশিত হয়।
তার সাথে শেষ যেদিন কথা হয়, সেদিন তার স্ত্রী জাওয়াহির ঘরে প্রবেশ করেন। তার পরনে ছিল কালো আবায়া, মুখ ছিল খোলা। তিনি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে স্বামীর পাশে বসলেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি তাদের জীবনকে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবে স্বামীর মতই তারও কোনো দুঃখ নেই। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বার্তা পাঠিয়েছি। সে পথে এগোনো বা বিখ্যাত হওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা বলেছি ধর্ম রীতিনীতি ও ঐতিহ্য নয়। ধর্ম অন্যকিছু। সূত্র : দি নিউইয়র্ক টাইমস। (সমাপ্ত)
*নিবন্ধকার বেন হাবার্ড দি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন