করোনাভাইরাস আজ এক মহাআতঙ্কের নাম। যেকোন মানুষ এই মহামারীর সংবাদ শোনার সাথে সাথেই আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ছোট একটি অণুজীবের ভয়ে মানুষ এত দিশেহারা, যা কল্পনার বাইরে। এই অণুজীবের ভয়েই পুরো বিশ^ আজ প্রায় লকডাউন! যাদের একটি হুমকির ভয়ে পুরো পৃথিবীর দেশগুলো কোনঠাসা হয়ে থাকে, সেই পরাশক্তিগুলোর মানুষজনও আজ এই ছোট্ট একটি অণুজীবের ভয়ে গৃহবন্দি জীবন-যাপন করছে। কেউ জানেন না, পৃথিবীতে এই অণুজীব কতদিন স্থায়ী হবে? আর এই মহামারী প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে খুঁজতে বিশে^র চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ প্রায় অসহায় হয়েই শুধুমাত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে চলাকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। বিশে^র সবচেয়ে মানবতাবাদী ধর্ম ইসলাম চৌদ্দশত বছর পূর্বেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে জীবন-যাপন করাকে একজন সুস্থ মানুষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছে, যার বর্ণনা এই ধর্মের প্রধান দু’টি উৎস কুর’আনুল কারীম ও হাদীসে অসংখ্যবার উঠে এসেছে। ইসলাম ধর্মে যেকোন ইবাদতের পূর্বে পবিত্রতা অর্জন করাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর এই ধর্মের প্রধান ইবাদত নামাজ আদায়ের জন্য শুধু নিজের পবিত্রতা অর্জন ও ওজুকে শর্ত করে দেওয়া হয়েছে তা নয়, বরং শরীরের পবিত্রতার সাথে সাথে কাপড় ও নামাজের স্থান পবিত্র হওয়াও নামাযের অন্যতম ফরজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর নামাজের পূর্বে দৈনন্দিন পাঁচবার ওজু করার সময় শরীরের প্রত্যেক অঙ্গকে তিনবার করে ধৌত করারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যাকে আধুনিক যুগের চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ একজন মানুষের সুস্থ থাকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করছেন।
বর্তমান বিশে^র চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ করোনাভাইরাস নামক মহামারী থেকে আত্মরক্ষায় নিয়মিত ভালভাবে হাত ধোয়া ও হাঁচি আসলে টিস্যু বা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। আর সেই চৌদ্দশ বছর পূর্বেই মানবতার নবী মুহাম্মদ (দ.) কখন কীভাবে হাত ধুতে হবে এবং হাঁচি আসলে কী করতে হবে, তা মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আস্হাবুস্্ সুফ্ফা’র অন্যতম সদস্য আবূ হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হয়, তখন সে যেন তার হাত তিনবার ধৌত করা ব্যতীত পাত্রে প্রবেশ না করে। কেননা ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত কোথায় ছিল সে জানে না।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ১৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৭৮।) আর হাত ধোয়ার সময় আঙ্গুল খেলাল করার বর্ণনা হাদীসে এসেছে, যাতে হাত উত্তমরূপে ধোয়া সম্পন্ন হয়। প্রখ্যাত সাহাবী ইব্নে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তুমি নামায আদায়ের ইচ্ছা পোষণ করবে, তখন পূর্ণভাবে ওজু করে নিবে। আর তোমার উভয় হাত ও পায়ের অঙ্গুলসমূহের মাঝখানে পানি পৌঁছে দিবে।’ (সুনানু ইব্নে মাজাহ্, হাদীস নং: ৪৪৭।)
উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি উত্তমরূপে হাত ধৌত করার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং হাতের ফাঁকফোঁকে অজান্তে কোনো ময়লা যেন না থাকে সেই জন্য হাঁত ধৌত করার সময় ভালভাবে আঙ্গুল খেলাল করারও নির্দেশ দিয়েছেন। আর চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ বর্তমানে বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত করোনাভাইরাস থেকে অত্মরক্ষায় যেভাবে হাত ধৌত করার পরামর্শ দিয়েছেন তা চৌদ্দশত বছর পূর্বে মানবতার নবী মুহাম্মদ (দ.) কর্তৃক নির্দেশিত পন্থার সাথে হবহু মিলে যায়।
প্রিয় নবী (দ.) খাবারের আগে এবং পরেও হাত ধোয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সুনানু আবি দাউদে বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় শয়ন করে যে, তার হাতে ঝোল জাতীয় কিছু লেগে থাকে এবং সে তা ধৌত করে না; এর ফলে যদি তার কোনো ক্ষতি হয়, সে নিজেই তার জন্য দায়ী হবে।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদীস নং- ৩৮৫২।)
এই হাদীসের মধ্যে খাওয়ার পরে এমনভাবে হাত ধৌত করার বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে হাতের মধ্যে কোনো প্রকারের উচ্ছিষ্ট লেগে না থাকে। আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, খাওয়ার পর ভালভাবে হাত না ধোয়ার ফলে যে ভ্যাকটেরিয়াগুলো হাতে লেগে থাকে তার কারণে ঐহাত দিয়ে শরীরের যে অঙ্গ স্পর্শ করবে সেই অঙ্গই সংক্রমণের সম্মুখীন হবে। তাই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ খাওয়ার পরে সাবান দিয়ে উত্তমরূপে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর রহমতের নবী মুহাম্মদ (দ.) চিকিৎসকদের এই পরামর্শকে উম্মতের জন্য নির্দেশনা হিসেবে অনেক আগেই ঘোষণা করেছিলেন।
চিকিৎসকগণ করোনা ভাইরাস বিস্তারের অন্যতম কারণ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচিকে উল্লেখ করেছেন। আর এই হাঁচি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা চৌদ্দশত বছর পূর্বে প্রিয়নবী (দ.) নিজে প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। আবূ হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হাঁচি দিতেন, তখন মুখে হাত অথবা কাপড় দিতেন এবং তার মাধ্যমে হাঁচির আওয়াজ কমাতেন বা নিয়ন্ত্রণ করতেন।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদীস নং: ৫০২৯।) অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁচি পরবর্তী ‘আল্হামদুলিল্লাহ্’ বলার নির্দেশনা দিয়েছেন। আবূ হুরারয়রাহ্ (রা.) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (রাসূল দ.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা হাঁচি দেওয়া পছন্দ করেন, আর হাই তোলা অপছন্দ করেন। তোমাদের মধ্য কেউ যখন হাঁচি দেয়, সে যেন ‘আল্হামদুলিল্লাহ’ বলে, আর তা শুনে প্রত্যেক মুসলমান যেন ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ আপনার উপর রহমত বর্ষণ করুক) বলে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৬২২৬।)
উপরোক্ত হাদীসদ্বয়ের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রিয় নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁচি আসলে মুখে হাত বা কাপড় দিয়ে চেপে ধরতেন, যাতে অওয়াজ নিয়ন্ত্রণ হয়, যা আমরা তার প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা পাই এবং হাঁচি পরবর্তী ‘আল্হামদুলিল্লাহ্’ বলার নির্দেশনা দিয়েছেন, যা তার বাক্যের মাধ্যমে শিক্ষা পাই। কারণ হাঁচির কারণে মানুষের ফুসফুসে যে আঘাত হয় তার ফলে অনেক সময় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই প্রিয় নবী (দ.) ‘আল্হামদুলিল্লাহ্’ বলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদ দিয়েছেন এবং যিনি বা যারা এই বাক্য শুনবেন, তাদেরকে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ আপনাকে রহম করুক) বলে তার জন্য দো’য়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, হাঁচির মাধ্যমে মানুষের শরীর থেকে যে প্রচুর পরিমাণ জীবাণু বের হয়, তা অন্য লোকের জন্য ক্ষতিকারক। তাই চিকিৎসকগণ হাঁচি আসলে টিস্যু অথবা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। একইভাবে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, বর্তমান করোনাভাইরাস যেহেতু হাঁচির মাধ্যমে বেশি ছড়ায়, সেহেতু মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ, যা চৌদ্দশত বছর পূর্বে বিশ^নবী (দ.)’র নির্দেশনা ছিল।
অনুরূপভাবে চিকিৎসকগণ গণ-জমায়েত ও সংস্পর্শকে করোনা বিস্তারের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা হাদীসে দেখতে পাই, এই ধরনের ছুঁয়াচে মহামারীর উদ্ভব হলে বিশ্ব নবী (দ.) এক এলাকার লোককে অন্যত্র যেতে নিষেধ করেছেন। সা’দ (রা.) নবী কারীম (দ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (নবী) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো এলাকায় প্লেগ (এক প্রকারের মহামারী) রোগের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, তথায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না’ (সহীহ বুখারী, হদীস নং- ৫৭২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২২১৮)।
এই হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অন্য এলাকার লোকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করবে না এবং এই মহামারীতে আক্রান্ত এলাকার লোকজন ভয়ে অন্যত্র চলে যাবে না, বরং ধৈর্য্য ধরে আল্লাহর উপর নির্ভর করে নিজ নিজ স্থানেই অবস্থান করবেন, যাতে করে গণ-জমায়েত এড়ানো যায়।
মহান আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে নবী (দ.)’র নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করুন। আমিন
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুলআজীজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদি আরব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন