জোবায়ের মিলন
কারো কারো দৃষ্টিতে ‘হুমায়ূন আহমেদ’ নশ্বর এক নাম। কারো কারো মতে, “বেঁচে থাকার মতো কোনো কৃতকর্ম রচিত হয়নি তার হাতে। বেঁচে থাকতে হলে সৃষ্টি লাগে। তার সৃষ্টি কী?” কেউ তো আবার ‘ফুঁ’ দিয়ে উড়িয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ নামটি। সাহিত্যে বোদ্ধা অবোদ্ধা থাকবেই। তাই বলে হেয় করাটা কোন বোধের কাজ তা আজও দুর্বোধ্য। না হয় বুঝলাম হুমায়ূন আহমেদ ‘কপাল কু-লা’ রচনা করতে পারেননি, ‘মেঘদূত’ তার হতে প্রসব হয়নি, ‘দেনা-পাওনা’ নামেনি ধরায়, লিপিবদ্ধ হয়নি ‘শেষের কবিতা’ বা ‘পথের পাঁচালী’ -তাই বলে কি মিসির আলিকে ছুঁড়ে ফেলা যায় আঁস্তাকুড়ে? হিমু যে এক পরাবাস্ত তাকে কি দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে সময়ের গতিধারায়? শুভ্র হয়তো বেঁচে থাকবে না ‘সোনার তরী’র মতো বা অপু লাবণ্যের মতো কিন্তু বাস্তবে যাকে দেখি শুভ্রের অবয়বে ঘুরে বেড়ায় পথে, গলিতে, দালানে, মেলায়, আড্ডায় তাকে কি-বলে সরিয়ে দেব সময়ের গহর থেকে? হিমু সেজে যখন ঘরের পুত্রটিই একটি ধারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চোখের সামনে তখন তাকে আঘাত করে কোন সে অভিভাবক? প্রত্যেকেই মধ্যমণি না। কেউ কেউ হয়। যারা হয় তাদেরকে চাঁদের জ্যোৎ¯œাধাম থেকে ধরাধামে টেনে-হিঁচড়ে নামানোর চেষ্টাই যদি নিজের জাহিরতার জন্য যথেষ্ট হয় তবে তা হোক। যারা পারে তারা পারুক। ‘হুমায়ূন আহমেদ’ না পেরেই থাকুক না হয় না ফেরার দেশে। যদি তাকে কেউ পড়তে চায় তাতে অন্তত বাঁকা দৃষ্টিওয়ালাদের কোন আক্ষেপ থাকবে না বলে বিশ্বাস। দেখি তাদের কে পড়ে, কে তাদের নাম বাঁধিয়ে রাখে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবির মতো দরজার পরে। দেখি লাবণ্য আর অপুর পর হিমুহীন এ পাড়ায় কে পারে আর-একটি চরিত্র আঁকতে যার ভাব আচার সময়ের চূড়ায় উঠে জ্যোতি ছড়ায় সূর্যের মতো। যদি কেউ পারে তার তরে মুছুক হুমায়ূন আহমেদ নাম। না হয় হুমায়ূন আহমেদনামে তর্ককে তর্ক বলেই গ্রহণ করে যারা সাধুর বেশে বসতে চায় আসনে তাদেরকে নিন্দুক বলেই সময় নিন্দা করবে চিরকাল।
ফেলে আসা নব্বইয়ের দশকে যে প্রজন্ম হাতে শখের পড়া নিতে শিখছে মাত্র, দেখেছি তারা বুদ হয়ে থাকত মাসুদ রানায়। কিছুটা পক্ব হলে শরৎ বাবুকে চিনতে শিখত বাবা-মা বা দাদা-দিদির পড়ুয়া অভ্যাস দেখে দেখে। রবীবাবু হাতে নিলেও বঙ্কিমে ভয় ধরে যেত দু’এক পাতা পড়েই। বরং মাসুদ রানাই সুখ দিত কাউকে কাউকে। সে সময়ে আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, জহির রায়হান ক’জনার ঘরে পাওয়া যেত তা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানার প্রয়োজনই হতো। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাবাজার বসে ইমদাদুল হক মিলনকে অভিমানে বলেছিলেন, দেখ আমরাই একদিন বাংলাবাজার থেকে দাদাদের তাড়াব। সে সময়ে একটি বইয়ের রয়েলটির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে অভিমানের স্বরটি কি বলে না, বাবুরা কতটা দখলে ছিল! পাঠক যখন পাধ্যায় আর বাবু ছাড়া কিছুই দেখে না আর তরুণ শ্রেণী যখন সাহিত্য থেকে ছিটকে পড়ছিল অন্য কিছুতে তখন উল্কাচ্ছাটা হয়ে হুমায়ূন আহমেদ নামটি নেমেছিল এপাড়ার বাংলা সাহিত্য মাঠে। তা স্বীকার্য হোক আর নাই হোক তা-ই সত্য। হালকা চালের লেখব বলে হুমায়ূন আহমেদকে হালকায় উড়িয়ে দিতে পারে তারা যারা বঙ্কিমের রসে রসিক, যারা বাবুর নেশায় বোর, যারা আত্মজাহিরে দিশাহারা। কিন্তু তারা ছোট করবে কি ভাবে যারা হুমায়ূন আহমেদ পড়তে পড়তে বড় হয়েছে, পড়তে পড়তে চিনেছে চ-িদাস, বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎ, পাবলো নেরুদা, ফ্রোয়েড, শেকসপিয়র, দান্তে! যারা আনন্দ খুঁজে পেয়েছে সেই বাহাত্তরের ‘নন্দিত নরকে’ তারপর শঙ্খনীল কারাগারে, যারা নিজেকে দেখতে পেয়েছে হিমুর মতে, ঢংয়ে!
সাহিত্যের ধারা এক বাঁকে চলে সে জানা নেই। সাহিত্য নানা ধারায় নানান বাঁকে নানান রসে গন্ধে রূপে এগোয় কালের পিঠ ভেদ করে এটাই তো সত্য। সেই সত্যের এক উপাদান সাহিত্যের ¯্রষ্টা বাঁচে কিংবা মরে তা তো সময়ের বিষয়, মানুষের নয়। কার্লহুগো বেঁচে থাকেননি, কেউ তাকে বাঁচিয়ে রাখেননি, সময় তাকে ধরে রেখেছে সময়ের উপাদান তার সৃষ্টিতে আছে বলে। ‘মধ্যাহ্ন’ এ সময়ের, মধ্যবিত্ত পরিবার আর সমাজের সে বীজ আছে, যা আয়না হবে সময়ে সময়ে। ‘নন্দিত নরকে’ পরিবর্তিত এক সমাজের অবক্ষয় স্পষ্ট যা সময়কে বুকে নিয়ে এগিয়ে যায় সময়ান্তরে। ‘আগুনের পরশমণি’ ক্ষুদ্র করে হলেও একটি জাগ্রত সময়, ইতিহাসকে পকেটে পুরে বেঁচে আছে। ‘জোছনা জননীর গল্প’ কী কথা বলে? ‘দেয়াল’ কিসের চিহ্ন এঁকেছে? হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিতে সত্যের সে উপাদান পরিলক্ষিত সুস্পষ্টভাবে।
মৃত্যুপর-যুগের অমৃত ভোগের লোভ ‘হুমায়ূন আহমেদ’র ছিল না। পরিকল্পিতভাবেই সাজেছে তার সাহিত্য রচনা। নকশা করাই ছিলÑ সে কি রাজ হবে না প্রজা হবে না সামান্য সময়ের ¯্রােত হয়ে আপন বেগে চলে যাবে ছোট ছোট ঢেউ তুলে কূলের কিনারে। কেউ যদি দুঃখ করে বা অভিযোগ করে ঝরনাধারা কেন নদী হলো না, নদী কেন সাগরে গেল না, সাগর কেন মহাসাগরে মিলল না তবে সে দুঃখ অলিক হয়েই থাকবে তাদের বুকে। কেননা হুমায়ূন আহমেদ’নদী হয়ে সাগরে, সাগর হয়ে মহাসাগরের পতিত হওয়ার কামনা নিশিঘুম নির্ঘুম জাগেন কি ব্যাকুল। ছোট্ট একটি ঝরনা হয়েই গড়িয়ে পড়তে চেয়েছেন মানুষের মনে। বার বার প্রশ্ন করেছেন ‘সাহিত্য’ কার জন্য। সময়ের মানুষে নাকি কালের জন্য? ভিতর থেকে ‘মানুষের জন্য’ উত্তরটিই তাকে কাঁদিয়েছে, বাদ্যযন্ত্রের মতো বাজিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ মানুষের জন্যই রচনা করেছেন। সময়ের মহারাজা হওয়ার বাসনা কখনো তাকে তাড়া করেনি। কালের রঙধনু হওয়ার ইচ্ছা কখনো তাকে মোহাবিষ্ট করেনি। যুগের হিরো হতে চাননি চিন্তায় স্থির ও সিদ্ধ এ লেখক। যতটুকু সময় বেঁচে থাকবেন ততটুকু সময়ই তিনি পাঠকের মনে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন, আনন্দ উল্লাস করে। তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণও তাই প্রমাণ করে। তিনি দেখাদেখি, ভাবে পড়ে, আবেগে সাহিত্যকে সঙ্গী করে লেখক হয়ে যাননি। কাজের ধরনেই বোঝা যায় সুপরিকল্পনা করেই মুখ ঘুরিয়েছেন সাহিত্যের দিকে। তা না হলে কে এমন সাহস করে অধ্যাপনাকে রেখে! ‘নন্দিত নরক’ সে তা শুরু ছাত্রাকালেই। সে বয়সেই সমাজ পরিবারকে দেখার সে কি তুখোড় দৃষ্টি।
নৃতাত্ত্বিকতাকে বুঝে সাহিত্যে ডুব দেয়া সাহিত্যকারের সংখ্যা পৃথিবীতে হাতে গুনলে দু-চারজনের অধিক পাওয়া দুসাধ্য। হুমায়ূন আহমেদপ্রথমে সামাজিকতাকে, মুক্তিযুদ্ধকে ধরার চেষ্টা করলেও পরে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করেছেন নিপুণভাবে। একটি শ্রেণীকে অনুধাবন করেছেন পরতে পরতে। সেই নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে ধরেই তৈরি করেন ‘হিমু চরিত্র’, মিসির আলি চরিত্র’, ‘শুভ্র’ চরিত্র। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বুঝে সুকৌশলে তরুণ শ্রেণীর মনকে জয় করেন হুমায়ূন আহমেদ। তরুণরা সবসময়ই আনন্দ চায়, হাসতে চায়, আবিষ্কার চায়, উদ্ধার চায়, অজানাকে জানতে চায়, পাগলামি করতে চায়, ভাবাবেগে ভাসতে চায়; তারা কখনো বোদ্ধার মতো ভারি ভারি কথা বলতে চায় না, জটিলতার ভিতর ডুবতে চায় না; হুমায়ূন আহমেদ নৃতাত্ত্বিক এই বৈশিষ্ট্যকে ধরতে পেরেছিলেন এবং তাদের নিয়েই কাজ করতে চেয়েছিলেন তাই ‘হিমু চরিত্র’ একটি উপন্যাসের চরিত্র না হয়ে বাস্তবিক একটি চরিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘মিসির আলি’ একটি উপন্যাসের চরিত্র না হয়ে তরুণের মনে যে যুক্তি খ-নে জয়ী হওয়ার আনন্দ তার প্রতিচ্ছবি হয়ে বাস্তবে ফুটে উঠেছে। আর এ কাজটি হুমায়ূন আহমেদ অচেতনে নয়, পুরোপুরি সচেতনভাবেই করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার কোন গ্রন্থকে জাদুবিদ্যা দ্বারা জনপ্রিয় করে তোলেননি বরং পাঠকই তার উপন্যাস গল্প প্রিয় করে তুলেছে। তিনি শুধু কিছু উপাদান তাতে ঢেলে দিয়েছেন। এখানেই হুমায়ূন আহমেদ-এর কৃতিত্ব। সাফল্য। একজন সাহিত্যিক হয়ে একটি শ্রেণীর বা একটি সময়ের গতিবিধি ধরতে পারাটা দুর্দান্ত এক বিচক্ষণতা। হুমায়ূন আহমেদও বিচক্ষণ একজন সাহিত্যিক।
শিল্পের মাঠে ‘জনপ্রিয়’ শব্দটিকে অবজ্ঞা করা হয় আজীবন। ‘জনপ্রিয়কে’ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয় অবলীলায়। প্রশ্ন জাগে, কেউ কি জনপ্রিয় হয়ে জন্মলাভ করতে পারে। পরিকল্পনা করে কি কেউ জনপ্রিয় হয়। প্রিয় কিছু দিতে পারলেই না তার সাথে ‘জন’ শব্দটি যোগ হয়ে জনপ্রিয় হয়? হুমায়ূন আহমেদ তার সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন ধারার দিক থেকে অনেক দিকেই যেতে পারতেন। তিনি কোন পথে না গিয়ে একটি পথেই থেকেছেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং ইচ্ছায়। এটিও একটি অসাধারণ গুণ। কে পারে এমন হালকা করে কলম চালিয়ে ভারি ভারি বুদ্ধিকে কবজা করতে! মানুষের মন সে তো সহজে বুঝবার নয় আর সহজে কাবু করার নয়, সেই কঠিন কাজটিই হুমায়ূন আহমেদ করেছেন অত্যন্ত সহজ বুদ্ধি দিয়ে, বাক্য দিয়ে। তিনি ধরতে পেরেছিলেন সময়ের চালক যারা তারা কী পেলে খুশি হবে। সাহিত্য ময়দানে তারা কী চাচ্ছে। সে রঙ বুঝে হুমায়ূন আহমেদ ঢেলেছেন রস। যেই না প্রয়োগ সেই ফল। এমন সরল কারিগর যুগের পিঠ খুঁড়ে পাওয়া দুষ্কর। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে কালের সেই সরল যোদ্ধা যে তার সরল বুদ্ধি আর সহজ বোধ দিয়ে জয় করে নিয়েছেন ভারি ভারি কলমে লিপ্ত যুদ্ধক্ষেত্র। সময়ে নিংড়ে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ রচনা, জোছনা জননীর গল্প, শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, অয়োময়, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, মধ্যাহ্ন, দেয়াল। শুধু সাহিত্যে কেন, নাটকে, চলচ্চিত্রে, গীতে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যে, নাটক নির্মাণে, চলচ্চিত্র তৈরিতে কঠিনেরে ভেদ করে সহজ দিয়ে সহজ জয় কার আছে এমন সাধ্য! হুমায়ূন আহমেদ কালের বৈতরণীতে সাহিত্যের বৈঠা ধরে বেঁচে থাকবেন অনেক অনেক বছর, নাটকের ধারা তাকে মনে রাখবে বহুকাল, চলচ্চিত্রে তিনি হয়ে থাকবেন এক মহাপুরুষ। বাংলা গীত যদি কোনো দিন খোঁজে মাটির গান সেখানেও তার নাম উঠে আসবে সময়ের আস্তিন থেকেই। কেউ তাকে হাতে টেনে নিচে নামাতে পারবে না যদি না সময় তাকে কালের গহরে নিক্ষেপ না করে। তার গল্প, উপন্যাস, হিমু, আর মিসির আলির জন্যই হুমায়ূন আমেদ বাংলা সাহিত্যে হয়ে থাকবেন যুগের অমৃত পুত্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন