করোনাভাইরাস বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট করে দিলেও আমরা মানবিকতা ভুলে অমানবিকতার নিকৃষ্ট উদাহরণ সমাজে দেখতে পাচ্ছি। ভাবা কি যায়, একটি মুসলিম প্রধান দেশ হয়েও লাশ দাফনে বিড়ম্বনা হতে পারে! যে দেশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে মুয়াজ্জিনের সমুধুর আজান শুনে সে দেশের মানুষের হৃদয় এত পাষাণ কী করে হয়? তা ভাবতেই হৃদয়টা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। চীনের উহান থেকে ওয়াশিংটন অথবা ওয়াশিংটন থেকে উহানে কোনো মিসাইল হয়তো যেতে পারত না। কিন্তু করোনা মিসাইল কিংবা এটমবোমার চেয়ে দ্রুত গতিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। এ বিদঘুটে অন্ধকার চিরদিন থাকবে না। কিন্তু কত দিন থাকবে তা কেবল আরশের মালিকই জানেন। করোনাভাইরাস কিছু মানুষের বিবেক, মানবিকতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। এমন বিবেকহীন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু করোনা যুগে যা দেখছি তা যে কারো মনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু এটাই সত্যিই যে, সন্তান নিজে বাঁচতে গিয়ে মা’কে জঙ্গলে ফেলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাবার লাশ হাসপাতালে। কিন্তু সন্তান সে লাশ আনতে যায়নি, জানাজা পড়ারও চেষ্টা করেনি। অনেক স্থানে গ্রামবাসী করোনা আক্রান্তদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে কিংবা গ্রামে লাশ দাফন করতে দেয়নি। বাড়িওয়ালা আক্রান্তদের মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। মহল্লার লোকেরাও এগিয়ে আসার গরজটুকু করেনি। এরকম অমানবিক আচরণ তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কেন হচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, একটি রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়ে পড়ে তখন সেখানকার নাগরিকরাও মনুষ্যত্বহীন নির্মম নিষ্ঠুর আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
করোনাভাইরাসে যেখানে মানুষের মধ্যকার হিংসা, বিদ্বেষ, অসন্তোষ, জাত-পাত, মান-অভিমান দূরিভূত হওয়ার কথা সেখানে আমরা নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি দেখছি। যুগ যুগ ধরে আমরা যে মানবতার কথা, পারিবারিক বন্ধনের কথা বলে আসছি, তা আজ ফাঁকা বুলিতে রূপ নিচ্ছে। কেউ একটু হাঁচি কিংবা কাশি দিলেই আমরা কটু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি। এতে করে অনেকে ভয়ে কাশি দিতেও ভয় পাচ্ছে। করোনার নিষ্ঠুরতা হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু কিছু মানুষের অমানবিক আচরণের কথা মানুষ ভুলবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া অমানবিকতার সব ঘটনা আমরা জানি না। কিন্তু যেটুকু জানি সেটুকু লিখলেও সমাপ্তি টানা যাবে না। স্বামী জ্বর নিয়ে শহর থেকে বাড়ি গেছেন শুনে স্ত্রী বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। জামাই জ্বর নিয়ে এসেছেন শুনে শ্বশুরবাড়ির লোকজন পালিয়ে গেছেন। করোনা সন্দেহে টাঙ্গাইলের সখীপুরের জঙ্গলে মাকে সন্তানরা ফেলে গেছে। ফরিদপুরের মধুখালীতে এক ব্যক্তি রাস্তার পাশে সারাদিন পড়ে কাতরাতে থাকলেও তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। অবশেষে প্রশাসনের লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। করোনা আক্রান্ত এক রোগী ঢাকার সাভার থেকে সাইকেল চালিয়ে বরগুনা গিয়েও নিজ বাড়িতে জায়গা হয়নি। স্ত্রী ঘরে উঠতে দেয়নি। নারায়ণগঞ্জে এক রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। কিন্তু রোগী কাশি দিলে করোনা সন্দেহে তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হয়। অনেককে ডেকেও তার পরিবার কোনো সাড়া পায়নি। বিনা চিকিৎসায় রোগীটি রাস্তায় মারা যায়। এমন নিষ্ঠুর আচরণের অসংখ্য খবর এখন চারদিকে ভাসছে। লাশ দাফনে বাধা। এমন ঘটনা আগে শুনিনি। কিন্তু করোনা যুগে এবার তা প্রত্যক্ষ করলাম। অথচ পীর-আউলিয়া, ওলী-আল্লাহর দেশে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। অনেক জায়গায় লাশ দাফনে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। সুনামগঞ্জে মসজিদের লাশ বহনকারী খাটিয়া পর্যন্ত দেয়া হয়নি। শরীয়তপুরের সদর হাসপাতালে মারা যাওয়া সন্তানের লাশের পাশে বসে মা আহাজারি করছেন। কিন্তু স্বজন বা গ্রামবাসী কেউ লাশ নিতে আসেনি। নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নের এক নারী পোশাককর্মীর মৃত্যু হয়। এলাকাবাসী ভয়ে ওই নারীর লাশ দাফন করতে দেয়নি। পরে তার লাশটি নদীর ধারে নৌকার মধ্যেই পড়ে ছিল। করোনা উপসর্গে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে। এসময় তার পাশে ছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। ঘরের মধ্যে তার মৃতদেহ রেখে আত্মগোপনে যান স্ত্রী ও সন্তানসহ আত্মীয়-স্বজনেরা। এ পরিস্থিতিতে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হুদা নিজেই ঘর থেকে বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরীর লাশ বের করেন, চিতায় উঠান এবং সৎকারের ব্যবস্থা করেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ ও জামালপুরের বকশীগঞ্জে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের লাশ দাফন করতে বাধা দেয়া হয়েছে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানের বাইরে ব্যানার টানিয়ে দেয়া হয়েছে, এখানে যেন করোনা আক্রান্ত কোনো মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করা না হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে মৃতদেহের কাছে যেতে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে, এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু লাশ দাফন করতে সমস্যা কোথায়? ভাইরাস কি কবর থেকে উঠে এসে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়বে?
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াটা কি দোষের? নিশ্চয় না। যেকোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি মারাও যেতে পারেন। জীবিত থাকতে যে মানুষটাকে আমরা সম্মান-শ্রদ্ধা করি। মৃত্যুর পর কেন ওই মানুষটাকে অসম্মান করছি? এ নশ্বর পৃথিবীতে চিরকাল কেউ বেঁচে থাকবে না। তবু আমরা পৃথিবীর মোহে অন্ধ হয়ে মানবিকতাকে ভুলতে বসেছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লাশ দাফনের ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই? ধর্মীয় রীতি ও নীতি অনুসারে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা তো আমাদেরই দায়িত্ব। অথচ করোনার অজুহাতে সে দায়িত্ব পালন করছি না। বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে গুজবে কান দিচ্ছি। মৃত ব্যক্তির লাশ থেকে করোনা বাতাসে ভাইরাস ছড়ায়। কেউ কাছে গেলে কিংবা ছুঁইলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এরকম ভুল ধারণা আমাদের সমাজে হাওয়ায় ভাসছে। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সেটা মনে করে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে, করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাইরাস ছড়ানো বা কোনো ক্ষতি করে না। একই কথা বলেছেন রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তার মতে, লাশ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায়। আমরা একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছি কীভাবে লাশের জানাজা, দাফন ও সৎকার করা যায়। এটি অনুসরণ করলেই চলবে। এক পরিসংখ্যানে দেখলাম, ২০১৬ সালে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬০ জন মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতিবছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। সেখানে আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি না। অথচ করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে মনুষ্যত্ব হারাতে বসেছি। অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এরকম অমানবিক ঘটনার কথা আমরা শুনিনি। আমরা আশা করব, রাষ্ট্র করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফনে বিড়ম্বনা দূরীভূত করতে উগ্যোগী ভূমিকা পালন করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন