দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির শোচনীয় অবনতি ঘটেছে। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ধরলা নদী অববাহিকায় গড়ে উঠা নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ি-ঘর, ফসলী জমি তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে গবাদিপশুসহ সহায় সম্বল। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৪০টি ইউনিয়নের ২৫০ গ্রামের ৭৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে ছুটছে। চরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হয়ে পড়াসহ দিনমজুরদের কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। অভাব-অনটনে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রোগ-বালাই দেখা দিলে হাসপাতালে নেয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। বন্যায় প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি নদ-নদীতে ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ভাঙ্গনে বসত-ভিটা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামে ইতোমধ্যে ১০০টি বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যা ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করায় লাখ লাখ মানুষ নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বন্যাকবলিত এলাকায় এখনো জোরেশোরে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। যে দুয়েক জায়গায় শুরু হয়েছে, তা নিতান্তই অপ্রতুল। এ অবস্থায় ঘরবাড়ি ও সহায়সম্বলহারা বন্যার্তদের পাশে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
দেশের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার দিকে সরকারসহ সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়ার ফলে ভয়াবহ বন্যাকবলিত মানুষের দিকে যেন কেউ দৃষ্টি দিচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে যে ফসল ও সম্পদসহ লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। এর ফলে বন্যার্তরা অনেকটা তিলে তিলে নিঃশেষ হতে চলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারো হাত নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্যোগ কবলিত মানুষকে উদ্ধারে দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। আমরা দেখছি, প্রতি বছরই বন্যা দেখা দিলে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো অত্যন্ত গড়িমসি করে। যতক্ষণ অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের টনক নড়ে না। ঢিমেতালে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করলেও তা দিয়ে বন্যার্তদের এক বেলা খাবারের সংস্থান করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা সকলেরই জানা, বন্যা দেখা দিলে খাদ্য, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানির সংকট শুরুর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ-বালাই দেখা দেয়। এই সমস্যা চিরকালের। জানা এই সমস্যা মোকাবেলা করতে সরকারের তরফ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার শুরুতে তা দেখা যায় না। এমনকি বেসরকারি কোনো সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। বলা বাহুল্য, বন্যাকবলিত মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে কোনো রকমে আশ্রয়ের সন্ধান করতে পারলেও জীবন বাঁচানোর মৌলিক যে উপকরণ তা থেকে বঞ্চিত হয়। এ সময়েই জরুরী ভিত্তিতে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এবারের বন্যা স্বাভাবিক নয়। বন্যায় নিম্ন ও চারাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি নদ-নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকায় যেসব চরে মানুষের বসবাস রয়েছে, সেসব অঞ্চলে এ ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ধরনের ভাঙ্গন অন্য কোনো সময় দেখা যায় না। সাধারণত বন্যায় মানুষ স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়ার পর বন্যা শেষে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যায়। এবার বন্যার পর দেখা যাবে ভয়াবহ ভাঙ্গনের ফলে অনেকেরই বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি থাকবে না। ফলে এসব মানুষ সর্বহারা হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। কর্মসংস্থানের অভাবে অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হবে। এ ধরনের হাজার হাজার বাস্তু ও সম্বলহারা মানুষের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের আগাম চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীতে তীব্র পানি সংকট ও বর্ষায় বন্যা দেখা দেয়ার মূল কারণই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বৈরী পানি নীতি। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে সে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়, আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। এখানে আমাদের সরকারেরও ব্যর্থতা রয়েছে। ভারতের সব চাহিদা পূরণ করে দিলেও বাংলাদেশের জীবনমরণ হয়ে থাকা পানি সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিছুদিন তিস্তা চুক্তি নিয়ে হবে-হচ্ছে বলে আওয়াজ তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত সবই আষাঢ়ে তর্জন-গর্জনে পরিণত হয়। এই চুক্তি এখন ভারতের উপর নির্ভর করছে এবং আর কিছু করার নেই বলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলে দেয়। এর ফলে ধরে নেয়া যায়, বর্ষায় বন্যা হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে মরা বাংলাদেশের নিয়তিতে পরিণত করা হয়েছে। অথচ পানির সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হলে বাংলাদেশকে এ ভাগ্যবরণ করতে হতো না।
আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারের সাথে যেহেতু ভারত সরকারের অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে, তাই এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পানি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব। পানি সমস্যার সমাধান করতে পারলেই বাংলাদেশকে প্রতি বছর পানি সংকটেও পড়তে হবে না, বন্যায়ও ভেসে যেতে হবে না। একটি স্থায়ী সমাধান হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সুসম্পর্কের মাধ্যমে যদি পানি সমস্যার সমাধান না করা যায়, তাহলে এ সুসম্পর্কের কোনো অর্থ হয় না। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সবধরনের সহযোগিতা করার যে আশ্বাস দিয়েছেন, এ আশ্বাসের ভিত্তিতে পানি সমস্যার সমাধানটিকেও নতুন করে সামনে নিয়ে আসা উচিত। এখন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যেসব মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে, তাদের মাঝে দ্রুত ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আগেই বন্যাদুর্গতদের সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। শুকনো খাবার, ঔষধ, মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। এ ব্যাপারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সমাজসেবামূলক সংগঠনগুলোর বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসা দরকার। শুধু বন্যার সময়ই নয়, বন্যা পরবর্তী সময় যে সংকট দেখা দেয়, সেই সময় পর্যন্ত বন্যার্তদের পুনর্বাসন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন